( হাজারদুয়ারী এর ডিসেম্বর ইস্যুতে লেখাটা ছাপা হয়েছে, ব্লগেও তুলে রাখলাম)
পাঠককে আগাম ধন্যবাদ
**************************************************************
হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি থেকে পলিটিকাল ইকনমিতে পিএইচডি করা ড. শর্মিলা বোস যখন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যু্দ্ধের ব্যাপারে উৎসাহিত হয়ে রিসার্চ পেপার বা গবেষণা প্রবন্ধ লিখেন, তখন সেটা পড়তে আগ্রহ হওয়াটাই স্বাভাবিক। তারওপর যখন শোনা যায় যে প্রবন্ধটা কনভেনশনাল আইডিয়াগুলোকে চ্যালেঞ্জ করেছে, তখন মানুষ মাত্রেই জানার কৌতুহলটা জন্মাবে যে তিনি কি লিখেছেন। সেইসূত্রেই তাঁর প্রবন্ধটা পড়া, যেটার শিরোনামটা বেশ বড়, "Losing the Victims: Problems of Using Women as Weapons in Recounting the Bangladesh War"।
(প্রবন্ধটির ইন্টারনেট লিংক Click This Link এখানে, কৃতজ্ঞতা@ ব্লগার শিমুল, হযবরল)।
সত্যি বলতে কি, প্রবন্ধটা পড়ে আমার মনটা ভালো হয়ে গেল। কেন? কারণ আগেই শুনেছিলাম এতে দাবী করা হয়েছিল যে ১৯৭১ এ বাংলাদেশে পাকিস্তানী বর্বর আক্রমণ "অপারেশন সার্চলাইটে" ২ লাখের বেশী নারী ধর্ষিত হয়েছেন বলে যে ধারনাটা করা হয়, সেটা বিরাট অতিরঞ্জনে অভিযুক্ত। প্রফেসর বোস দাবী করেছেন যে সংখ্যাটা অনেক অনেক কম, কয়েক হাজারের বেশী হবেনা। সেজন্যই খুব ভয়ে ভয়ে প্রবন্ধটা পড়া শুরু করি, এত বড় প্রফেসর, তার ওপর এত সরাসরি তিনি উপসংহার টেনে ফেলেছেন, না জানি কি অকাট্য প্রমাণ দেখিয়েছেন। সেজন্যই মনটা ভাল হয়ে গেল, কারণ, এমন কোন অকাট্য প্রমাণ তো দূরের কথা, অকাট্য কোন যুক্তিও দেখলামনা। সত্যি বলতে কি, মাত্র সাত বছরের গবেষণার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এই আমার মুখ থেকে শুনতে খুব "ছোটমুখে বড় কথা" ধরনের শোনালেও, এটা বলতেই হচ্ছে যে প্রফেসর বোসের এই গবেষণাকাজটি কোন গবেষণার পর্যায়েই পড়েনা। কেন সেটাই পয়েন্ট বাই পয়েন্ট ভেঙে ভেঙে আলোচনা করব এখানে।
প্রথমেই একটু "অপ্রাসঙ্গিক মনে হলেও হতে পারে" কথাটুকু বলে নিই। বিজ্ঞানই বলুন আর শাস্ত্রই বলুন, এটাকে আজকাল যাচ্ছেতাই ব্যবহার করা হচ্ছে। এ-ফোর সাইজের কাগজে মোটা মোটা দুকলামে ছোট ছোট অক্ষরে ৫/৬ টা চ্যাপ্টারে ভাগ করে একটা প্রবন্ধ লিখেই মানুষ সেটাকে রিসার্চ পেপার হিসেবে চালিয়ে দিচ্ছে। একটা সাধারণ কথাকেও একাডেমিক ফ্লেভার দিয়ে চালিয়ে দেবার জালিয়াতিটা একাডেমিয়াতে যথেষ্ট আগে থেকেই যে শুরু হয়েছে সেটাও সত্য। তবে ইদানিংকার টেন্ডেন্সীটা আসলেই বিপজ্জনক! সিরিয়াস রিসার্চাররা ধারনা করেন, এক্সিস্টিং একাডেমিক জার্নালগুলোতে যে পরিমাণ পেপার প্রকাশিত হয়, তার শতকরা ৯০ থেকে ৯৫ ভাগই কোন রিসার্চ ওয়ার্কই না। আমি নিজেও কিছু পেপার রিভিউ করেছি, এবং কথাটা যে কি পরিমাণ সত্য সেটা গভীরে না ঢুকলে বোঝা যায়না। এমনও দেখেছি যে, ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিজমের একটা এ্যানালাইটিকাল প্রবলেম যেটা কোন এক পাঠ্যবইয়ের অনুশীলনীতে দেয়া ছিল সেটাকে সল্ভ করে, গ্রাফ-ট্রাফ এঁকে পেপার হিসেবে কনফারেন্স কমিটিতে জমা দিয়ে দিয়েছে!!! অথচ একটা পেপার যথেষ্ট পরিমাণ "একাডেমিক ফ্লেভার" বহন করে, আর যখন এই ফ্লেভারটা কোন নিন্মমানের প্রবন্ধেও লেগে যায়, তখন লোকে দেদারসে সূত্র হিসেবে ব্যবহার করা শুরু করে, আর অধিকাংশ মানুষই লেখাটার "হাইলি একাডেমিক" চেহারা দেখে সেখানেই ভেবে নেয় যা লিখেছে নিশ্চয়ই সত্যিই হবে। গবেষণা বিশ্বের ঠিক এই দূর্বলতাকে ব্যবহার করে যাচ্ছে নানান পদের মানুষ, যেখানে সেখানে, যখন তখন -- একটু ভেবেও দেখছেনা খটকা লাগে কিনা। ভাবটা এমন যে, এরকম পেপারের ফর্মায় প্রকাশিত যাবতীয় লেখাই সত্য। অথচ, সত্যি বলতে শতকরা ৯০ ভাগের বেশীর তো প্রয়োজনই নেই, আর সেই ৯০ ভাগের একটা বিশাল অংশ হলো স্রেফ আবর্জনা। ড. বোসের লেখাটাও তেমন একটা প্রচেষ্টা, সম্ভবতঃ পাকিস্তানী কোনগ্রুপ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে একটা নিরর্থক আঁতলামোর অপচেষ্টা।
তবে ড. শর্মিলা বোসের এই পেপারটা নিয়ে একটা মজার "রিভার্স ইফেক্ট" টাইপের ব্যাপার ঘটেছে বাংলাদেশে। ড. বোস পরিস্কারভাবেই এই প্রবন্ধে পাকিস্তানী হানাদারদের ব্যাপারে সাফাই গেয়েছেন, বোঝাতে চেয়েছেন যে তারা যুদ্ধ করেছে, যুদ্ধে সাধারণত যেটুকু ক্ষয়ক্ষতি হয় সেটাই হয়েছে, সিস্টেমেটিকালি কোন ক্ষতি করেনি যেটাকে যুদ্ধাপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা যায়। বাংলাদেশে এই বক্তব্যকে একেবারে লুফে নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরবে জামাত ইসলামী, যেটা এদেশের একমাত্র সংগঠন যেখানে এখনও যুদ্ধাপরাধীরা একত্র হয়ে আছে, এবং যেখানে তারা এখনও সেই ৭১ এর ব্যাপারে কোন ছাড় দেয়না। এই আচরণ দিয়ে তারাই একমাত্র দল যারা এখনও ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানপন্থী বাংলাদেশীদের প্রতিনিধিত্ব করে যাচ্ছে সমষ্টিগতভাবে। কিন্তু, ড. বোসের কপাল খারাপ আর আমাদের কপাল ভাল যে, তাঁর নামটা পড়েই জামাতীরা আর প্রবন্ধটা উল্টেও দেখবেনা, যেটা দেশের ভেতরের আরো কিছু "ঘটতে পারত" এমন কন্সপিরেসীকে স্বাভাবিকভাবেই জন্মলাভ করতে দেয়নি।
সূচনাটা বিশাল হয়েই গেল, কিছু করার নেই, প্রবন্ধের সমালোচনা লিখতে বসে কিছুটা আবেগপ্রবন হয়ে পড়েছিই, যেহেতু নিজ দেশের ইতিহাস নিয়ে মিথ্যাচার টের পেয়েছি। বাকী অংশে একটা একটা করে কারণ দেখাবো, কেন প্রফেসর বোসের প্রবন্ধ হওয়া সত্বেও রিভিউয়ার হিসেবে এটাকে আমি গ্রহন করতে পারছিনা।
১. ত্রুটিপূর্ণ উপাত্ত সংগ্রহপদ্ধতি (সাক্ষ্য- উপাত্ত)
প্রফেসর বোস তাঁর গবেষণাকাজে কিছু ব্যক্তির সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। ভাসাভাসাভাবে দেখলে, একদম সঠিক পদ্ধতি। কিন্তু একটু গভীরে ঢুকে দেখলেই দেখা যাবে,
বাংলাদেশের মানুষদের সাক্ষাৎকারকে তিনি তার রিসার্চের কোন উপসংহারের সাপোর্টে ব্যবহার করেননি। এমনকি বাংলাদেশের কোথায় কোথায় কতজনের সাক্ষাৎকার তিনি নিয়েছেন সে নিয়ে প্রবন্ধে কোন নির্দিষ্ট তথ্যও নেই! শুধু একটা জায়গাতেই তিনি তাঁর বাংলাদেশে সংগঠিত সার্ভের কথা বলেছেন, যেখানে তিনি দাবী করেছেন যে সাধারণ মানুষ ধর্ষনের কথা বলতে আগ্রহী না। অথচ পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বেশ কয়েকজনের বক্তব্য তিনি নিয়েছেন, তাঁদের নামও তুলে দিয়েছেন, তাঁদের উক্তিও তুলে দিয়েছেন। বোঝা যায়, পাকিস্তানী সাক্ষীদের বেলা তিনি খুব সিস্টেমেটিক উপায়ে গবেষণার উপাত্ত জোগাড় ও প্রকাশ করেছেন।
এখন খেয়াল করে দেখুন, ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশে, ঘটনার শিকার বাংলাদেশী সাধারণ মানুষ, ঘটনার অভিযুক্ত পাকিস্তানী সেনাবাহিনী।
একজন পলিটিকাল ইকনমির প্রফেসরকে যদি এরপরও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে হয় যে, "তোমার গবেষণার জন্য তুমি এই সাবজেক্টদের কাছ থেকে যতবেশী পার তথ্য জোগাড় করো", তাহলে তার গবেষনাকে আমি কিভাবে অনুমোদন করব?
২. ত্রুটিপূর্ণ সূত্র-ব্যবহার পদ্ধতি
প্রফেসর বোস বেশ কিছু ডকুমেন্টও ব্যবহার করেছেন তাঁর গবেষণায়, তবে এখানেও তাঁকে পরিষ্কার পোলারাইজড হতে দেখা গেছে। কেন? তিনি ডকুমেন্টগুলোকে দুটো উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেছেন -- প্রথমটা হলো তিনি তাঁর বক্তব্যের সাপোর্ট হিসেবে কিছু ডকুমেন্টকে উদ্ধৃত করেছেন, আর কিছু ডকুমেন্টের বক্তব্যকে তিনি সমালোচনা করেছেন। এখানেও দেখা যায় তিনি সাপোর্টিং ডকুমেন্ট হিসেবে নিলেন হামুদুর রহমান কমিশনের বক্তব্যকে (!) , অথচ সমালোচনা করলেন ব্রাউনমিলার ও নয়নিকা মুখার্জির সুলিখিত আর্টিকেলের কিছু বক্তব্যের! হামুদুর রহমান কমিশনের রিপোর্ট হলো ৭০ এর দশকে সামরিক শাসক নিয়োজিত সরকারী এক কমিশনের বক্তব্য, যেটার বিশ্বাসযোগ্যতার দূর্বলতা নিয়ে পলিটিকাল ইকনমির প্রফেসরের অজ্ঞতা থাকার কথা না। আচ্ছা, তিনি ব্রাউনমিলার আর মুখার্জির পেপারের সমালোচনা করেছেন, ভালো কথা, কিন্তু একাডেমিক কোন পেপারই কি তিনি পেলেননা যেটাকে তিনি তাঁর গবেষণার কাজে সাপোর্টিং ডকুমেন্ট হিসেবে ব্যবহার করতে পারতেন? তাঁকে যেতে হলো হামুদুর রহমান কমিশনের বক্তব্যের কাছে? আমার সোশিও-পলিটিকাল জ্ঞান খুবই সামান্য, তাও সেটা দিয়েই এই পেপারকে আমি নাকচ করে দেব, কারণ হামুদুর রহমান কমিশন রিপোর্ট যে একটা দূর্নীতিগ্রস্থ দূর্বল রিপোর্ট হবে এটা বোঝার জন্য কারো রকেট-সায়েন্টিস্ট হবার দরকার নেই।
কোন প্রতিষ্ঠিত জার্নাল/সংবাদপত্রের সূত্র না দিতে পেরে তিনি আমাদেরকে গিলতে বলছেন পাকিস্তান সরকারের শ্বেতপত্র, দেখুন তিনি তার প্রবন্ধে লিখেছেন,
"The government of Pakistan’s White Paper on East Paki¬stan in August 1971 listed numerous incidents of atrocities including alleged rape and massacre of non-Bengalis by Bengalis all over East Pakistan"এরচেয়ে হাস্যকর আর কি হতে পারে?
(চলবে ....)
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জানুয়ারি, ২০০৮ দুপুর ২:৩৮