গর্ভকালীন রক্তস্বল্পতা ভীষণ এক সমস্যা। উন্নয়নশীল দেশে প্রায় ৪০-৮০ শতাংশ গর্ভবতী নারী রক্তস্বল্পতায় ভোগে, বাংলাদেশে এদের সংখ্যা মোটামুটি ৮০ শতাংশ। তৃতীয় বিশ্বে রক্তস্বল্পতা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মাতৃমৃত্যুর একটি অন্যতম প্রধান কারণও বটে।
রক্তস্বল্পতা কী
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মান অনুযায়ী গর্ভাবস্থায় রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ যদি ১১ দশমিক ০ গ্রাম/ডেসি লিটারের কম থাকে, তাহলে তাকে গর্ভকালীন রক্তস্বল্পতা বলে।
কেন হয়
গর্ভকালীন সময়ে বিভিন্ন কারণে রক্তস্বল্পতা হয়। যেমন -
আয়রনসমৃদ্ধ খাবার, আমিষ জাতীয় খাবার অথবা ভিটামিনের (ভিটামিন বি১২/ ফলিক অ্যাসিড) অভাব হলে।
গর্ভকালীন সময়ে রক্তক্ষরণ হলে। গর্ভাবস্থায় যেসব কারণে রক্তক্ষরণ হয় সেগুলো হলো - গর্ভপাত, গর্ভফুল ছিঁড়ে যাওয়া বা অস্বাভাবিক স্থানে থাকা। তৃতীয় বিশ্বে গুঁড়ো কৃমি আরেকটি অন্যতম কারণ। প্রতিটি কৃমি প্রতিদিন শূন্য দশমিক ২৫ মিলি লিটার পর্যন্ত রক্ত শোষণ করতে পারে। এছাড়া রক্ত আমাশয়, এনাল পাইলস থেকেও রক্তক্ষরণ হয়। গর্ভাবস্থায় এনাল পাইলস আরো তীব্র হতে পারে।
রক্তকণিকা বা হিমোগ্লোবিনে বংশানুক্রমিক কোনো সমস্যা থাকলে।
সংক্রমণ বা ইনফেকশনের কারণে, ম্যালেরিয়া, যক্ষ্মা এমনকি মূত্রথলির সংক্রমণের কারণেও রোগী রক্তস্বল্পতায় ভুগতে পারে।
এছাড়া গর্ভাবস্থা নিজেই রক্তস্বল্পতার একটি কারণ হয়ে দাঁড়ায়। রক্তে মূলত দুটি অংশ - তরল অংশ এবং কোষ ও কণিকা। গর্ভকালীন সময়ে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তরল অংশ বৃদ্ধি পায় প্রায় ৪০-৫০ শতাংশ এবং লোহিত কণিকা বৃদ্ধি পায় মাত্র ২০-২৫ শতাংশ। এই অসামঞ্জস্যতা স্বাভাবিকভাবেই গর্ভাবস্থায় রক্তস্বল্পতার একটি প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
রক্তস্বল্পতার কারণে যেসব উপসর্গ দেখা দিতে পারে
এটি মূলত নির্ভর করে গর্ভবতীর রক্তস্বল্পতার পরিমাপের (degree of anaemia) ওপর। রক্তে হিমোগ্লোবিন ৮-১০ শতাংশ গ্রাম হলে সাধারণত কিছুটা দুর্বল লাগে। এর চেয়ে কম হলে অনেক উপসর্গ দেখা দিতে পারে। যেমন দুর্বলতা, ক্ষুধামন্দা, হজমে অসুবিধা, বুক ধড়ফড় করা, পায়ে পানি আসা ইত্যাদি। জিহ্বা বা মুখে ঘা হতে পারে। কখনো কখনো শ্বাসকষ্ট পর্যন্ত হতে পারে।
মা ও গর্ভস্থ শিশুর জন্য রক্তস্বল্পতার জটিলতা
অতিরিক্ত রক্তস্বল্পতা অর্থাত্ রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ ৭ শতাংশ গ্রামের কম হলে মা এবং গর্ভস্থ শিশুর বিভিন্ন জটিলতা দেখা দিতে পারে। যেমন মায়ের ক্ষেত্রে - প্রি-একলাম্পসিয়া, কার্ডিয়াক ফেইলর, সংক্রমণ, প্রসব-পরবর্তী অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ ইত্যাদি। সন্তানের ক্ষেত্রে - গর্ভস্থ শিশুর পর্যাপ্ত বৃদ্ধি না হওয়া, নির্দিষ্ট সময়ের আগে প্রসব হয়ে যাওয়া, কম ওজনের শিশু জন্ম নেয়া ইত্যাদি।
প্রতিকার ও করণীয়
কোনো মেয়েকে ১৮ বছরের আগে বিয়ে দেয়া যাবে না।
দুটির বেশি সন্তান না নেয়া এবং এই দুটি গর্ভধারণের মাঝে অন্তত দুই বছরের বেশি সময় থাকতে হবে।
গর্ভধারণের আগে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো এবং রক্তে হিমোগ্লোবিন শতকরা ১০ গ্রামের কম থাকলে চিকিত্সকের পরামর্শ নিতে হবে।
গর্ভবতী মায়ের আমিষ, ভিটামিন ও আয়রনসমৃদ্ধ খাবার যেমন কলিজা, মাংস, ডিম, সবুজ শাকসবজি, মটরশুঁটি, শিম বা যেকোনো বিচি, কলা, পেয়ারা ইত্যাদি বেশি করে খেতে হবে। পাশাপাশি ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী অবশ্যই আয়রন ট্যাবলেট খেতে হবে।
কোনো ইনফেকশন বা রোগ থাকলে দ্রুত চিকিত্সা করাতে হবে।
গর্ভকালীন সময়ে নিয়মিত চেক-আপ এবং শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতি তিন মাসে অন্তত একবার করে হিমোগ্লোবিন পরীক্ষা করাতে হবে।
রক্তস্বল্পতা থাকলে চিকিত্সকের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিত্সা করাতে হবে। প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে।
একটি সুস্থ শিশুর জন্মের জন্য প্রধান শর্ত হলো মায়ের পূর্ণ সুস্থতা। তাই গর্ভবতী মায়ের সুস্থতা নিশ্চিত করতে হবে।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে জানুয়ারি, ২০১৮ দুপুর ১২:২৬