১৯৭১ সালে যে গণহত্যা চালানো হবে তা ছিল পুর্ব পরিকল্পনা। ফেব্রুয়ারীতে কনফারেন্সে তৎকালীন প্রেসিডেণ্ট ইয়াহিয়া খান বলেছিলেন, "ওদের তিরিশ লক্ষ মানুষকে হত্যা কর, তাহলে বাকি সবাই নতি স্বীকার করবে। (রবার্ট পেণ, ম্যাসাকার [১৯৭২], পৃষ্ঠা ৫০ )।"
ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সালে সরাসরি বাঙালিদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য পাকিস্তান আর্মিকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। যশোরে কিছু সাংবাদিকের সাথে কথা বলার সময় ইয়াহিয়া খান একদল বাঙালির দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বলেন যে,‘আগে এদেরকে মুসলমান বানাও’। অর্থাৎ ইয়াহিয়ার ভাষ্য অনুযায়ী
বাঙালিরা সাচ্চা মুসলমান না।
পাকিস্তান আর্মি অফিসার এবং সাধারণ সৈনিকদের মনে এই ধারণা বদ্ধ মূল ছিল যে বাঙালিরা খাঁটি মুসলমান নয় এবং তারা হিন্দু ভারতের সাথে অনেক বেশি ঘনিষ্ট। ইয়াহিয়া খানের ঐ উক্তিতে উৎসাহিত হয়ে পাকিস্তান আর্মি বাঙালিদেরকে মুসলমান বানানোর ধান্দায় নেমে পরে॥ আর এর জন্য সহজ রাস্তা ছিল বাঙালি মেয়েদেরকে জোরপূর্বক ধর্ষণ করে তাদেরকে দিয়ে খাটি মুসলমান বাচ্চা পয়দা করানো। মনে হয় পাকিস্তানি বীর্যে জন্ম হলেই সাচ্চা মুসলমান হওয়া যায়। পাকিস্তানী সৈন্য এবং তার এদেশীয় রাজাকাররা শুধু যত্র তত্র ধর্ষণ করেই ক্ষান্ত হয়নি। জোর করে মেয়েদেরকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ধর্ষণ ক্যাম্পে। নিউইয়র্ক টাইমসের সাংবাদিক অব্রে মেনেন জুন-জুলাই ৭২ নাগাদ এসেছিলেন এদেশে। তার সাড়া জাগানো আর্টিকেল 'দ্য রেপ অব বাংলাদেশ' এ পাক সেনাদের অনেক নির্যাতনের কথা বর্ণনা করেছেন। লেখক ব্রাউনমিলার, এগেইনস্ট আওয়ার উইল বইয়ে, পাকিস্থানি সেনাদের হাতে
একটি নব বিবাহিতা মেয়েকে নির্যাতনের
বর্ণনা করেছেন এভাবে - "দুইজন পাকসেনা সদ্য বিবাহিত দম্পতির জন্য তৈরী ঘরে ঢুকল । অন্য সৈন্যরা দাঁড়াল বাইরে। ভিতর থেকে ভেসে এল ধমকের সুরে একটা আদেশের মত আওয়াজ আর মেয়েটির স্বামীর প্রতিবাদ। তার পর একটু নীরবতা, এবং তার পরেই মেয়েটির আর্তনাদ আর মাঝে মাঝে কান্নার আওয়াজ॥ তারপর আস্তে আস্তে ছয়জন সৈন্যই নব বিবাহিত মেয়েটিকে তার স্বামীর সামনেই ধর্ষণ করলো।" ব্রাউন মিলার তার বইয়ে আরো লিখেছেন, বাংলাদেশে ধর্ষণের কোন বাছ বিচার ছিলনা। "আট বছরের মেয়ে থেকে ৭৫ বছরের বুড়ি ॥ এমনকি কোন কোন মহিলাকে একই রাতে আশি বার পর্যন্ত ধর্ষণ করা হয়েছিল।" ১৯৭১ এর ২৫শে মার্চ রাজারবাগ পুলিশ লাইনে পাকিস্থানি হায়েনারা নির্মম গণহত্যা, নারী নির্যাতন শুরু করে॥ সেই সময় রাজারবাগ পুলিশ লাইনের রাবেয়া খাতুনের উপর অমানুষিক নির্যাতন করে পাক বাহিনী॥
‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ও দলিলপত্র: অষ্টম খন্ডে’ রাবেয়া খাতুনের জবানবন্দি আছে॥ সেখানে তিনি বলেছেন - "পাকসেনারা আমাকে (রাবেয়া খাতুন) লাথি মেরে মাটিতে ফেলে দেয় হয় এবং আমার উপর প্রকাশ্যে পাশবিক অত্যাচার করছিল আর কুকুরের মতো অট্ট হাসিতে ফেটে পড়ছিল। আমি হাউমাউ করে কাঁদছিলাম, আর বলছিলাম আমাকে মেরো না, আমি সুইপার, আমাকে মেরে ফেললে তোমাদের পায়খানা ও নর্দমা পরিষ্কার করার কেউ থাকবে না, তোমাদের পায়ে পড়ি তোমরা আমাকে মেরো না, মেরো না, মেরো না! কিন্তু তখন কোনো দয়া না করে আমার উপর এক পাঞ্জাবী কুকুর, আমাকে উপর্যুপরি ধর্ষণ করছিল।" পাকসেনারা সেইসময় রাজাকারদের সাহায্যে ঢাকার বিভিন্ন স্কুল,কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা এবং অভিজাত এলাকা থেকে বহু বাঙালি যুবতী মেয়েদের ধরে এনে ব্যারাকে জামায়েত করে। তারপরই আরম্ভ হয়ে গেল সেইসব বাঙালি নারীদের উপর বীভৎস ধর্ষণ। লাইন থেকে পাক সেনারা কুকুরের মতো জিভ চাটতে চাটতে ব্যারাকের মধ্যে প্রবেশ করে প্রতিটি মহিলার পরনের কাপড় খুলে একেবারে উলঙ্গ করে মাটিতে লাথি মেরে ফেলে দিয়ে বীভৎস ধর্ষণে লেগে গেল। কেউ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই সেই নিরীহ বালিকাদের উপর ধর্ষণে লেগে গেল। রাবেয়া খাতুন তার জবান বন্দিতে আরো উল্লেখ করেছেন, "সেনারা এই নিরীহ বাঙালি মেয়েদের শুধুমাত্র ধর্ষণ করেই ছেড়ে দেয় নাই, আমি দেখলাম পাক সেনারা সেইসব মেয়েদের ধারালো দাঁত বের করে বক্ষের স্তন ও গালের মাংস কামড়াতে কামড়াতে রক্তাক্ত করে দিচ্ছে। মেয়েদের স্তন, গাল, পেট , ঘাড়, বক্ষ, পিঠে ওদের অবিরাম দংশনে রক্তাক্ত হয়ে গেল। যে সকল মেয়েরা ওদের পাশবিকতার শিকার হতে অস্বীকার করল পাকসেনারা তাদের স্তন টেনে ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে ওদের যোনি ও গুহ্যদ্বারের মধ্যে বন্দুকের নল, বেয়নেট ও ধারালো ছুরি ঢুকিয়ে দিয়ে দেহ ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছিল। এমনকি অনেক মেয়েদের ছুরি দিয়ে তার স্তন কেটে পাছার মাংস কেটে, যোনি ও গুহ্যদারের মধ্যে সম্পূর্ণ ছুরি চালিয়ে দিয়ে অট্টহাসিতে ফেটে পরতো। কেউ তাদের বক্ষের স্তন কেটে নিয়ে যেতো, কেউ হাসতে হাসতে তাদের যৌনপথে লাঠি ঢুকিয়ে আনন্দ উপভোগ করতো। কেউ ধারালো চাকু দিয়ে কোনো যুবতীর পাছার মাংস আস্তে আস্তে কেটে কেটে আনন্দ করতো। ধর্ষণ করে হত্যার পর মেয়েদের লাশ অন্য মেয়েদের সম্মুখে ছুরি দিয়ে কেটে কুচি কুচি করে বস্তার মধ্যে ভরে বাইরে ফেলে দিত।" "অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে মেয়েরা যখন একটু পানি চাইতো তখন হানাদার এবং রাজাকাররা ডাবের খোসায় প্রসাব করে সেটা খেতে দিত। তাদের পরবার জন্য কোন শাড়ি দেয়া হতো না (যদি শাড়ি পেচিয়ে আত্মহত্যা করে তাই)। গোসলের প্রয়োজন হলে তিন জন করে দড়ি দিয়ে বেঁধে দেয়া হতো, রাজাকার ও পাকিরা দড়ির এক প্রান্ত ধরে রেখে তাদের নিয়ে যেতে গোসলে। (বাংলাদেশের স্বাধীনতার দলীলপত্র, ৮ম খন্ড, হাসান হাফিজুর রহমান )।"
.
.
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে পরিকল্পিত ভাবে গণ ধর্ষণের শিকার হয়েছে প্রচুর বাঙালি রমণী। ঠিক কতজন যে ধর্ষণের শিকার হয়েছে তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান কারোর জানা নেই। বীণা ডি’ কস্টা তার 'Bangladesh’s erase past' প্রবন্ধে জানাচ্ছেন যে, সরকারি হিসাব অনুযায়ী একাত্তরে ধর্ষণের শিকার হতে হয়েছিল দুই লক্ষ নারীকে। লন্ডন ভিত্তিক International Planned Parenthood Federation (IPPF) এই সংখ্যাকে বলেছে দুই লাখ। অন্যদিকে যুদ্ধ শিশুদের ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত সমাজকর্মী ডঃ জিওফ্রে ডেভিসের মতে এই সংখ্যা এর চেয়েও অনেক বেশি। সুজান ব্রাউনমিলারও ধর্ষিতার সংখ্যা চার লাখ বলে উল্লেখ করেছেন। নির্যাতিত নারীদের নিয়ে ডাব্লিউসিএফএফসি’র গবেষণায় ধর্ষিতা নারীর সংখ্যা সাড়ে চার লাখেরও বেশি বলা হয়েছে । নির্যাতিত নারীদের মধ্যে মুসলমান: ৫৬.৫০% এবং হিন্দু: ৪১.৪৪%। খ্রিস্টান ও অন্যান্য: ২.০৬%। বিবাহিত: ৬৬.৫০% এর চেয়ে বেশি। অবিবাহিত: ৩৩.৫০% এর চেয়ে কম।
সেনাক্যাম্পে নির্যাতিতা সন্তান সম্ভবা অধিকাংশ বীরাঙ্গনাই ছিলেন মুসলিম সম্প্রদায়ভুক্ত।
.
.
রারেয়া খাতুনের জবানবন্দিতে যে লোমহর্ষক কাহিনী বর্ণনা পাওয়া যায়, সে কাহিনী এ যাবৎ বাংলাদেশের কতজন জানে? পৃথিবীর কোথাও এমন ঘৃণ্যতম ঘটনা ঘটেছে বলে শুনেছেন কি?
আফসোস, তরুণ প্রজন্মের জামায়াত শিবির কর্মী ভাইয়েরা একবারও কি ভাববেন না সেইসব মায়েদের আত্মত্যাগের কথা! ৩০ লাখ শহীদের অভিশাপ নিও না ভাইয়েরা। লাখো বীরাঙ্গনার লুটানো সম্ভ্রমের কথা একবার চিন্তা করো। নিজের মা কিংবা বোনকে তাদের জায়গায় বসিও পারলে।
মুসলমান হওয়ার পরেও
এই পাক বাহিনী এবং রাজাকাররা আমাদের মা বোনদের রেহাই দেয়নি।
আজ কার রক্ত মাড়িয়ে কার ছিন্ন শাড়ি পায়ে ঠেলে রাজাকারদের ভালোবাসবে?? ৪৩ বছর কি খুব দীর্ঘ সময় সব অপমান ভুলে যাওয়ার? জাতীয় পতাকার কথা ভাবো, ওই লালটা শহীদের রক্ত, ওই সবুজটা বীরাঙ্গনাদের শাড়ি। এবার সিদ্ধান্ত নাও, শহীদ, বীরাঙ্গনা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগকে অস্বীকার করবে কিনা! যদি করো, তোমার কোনো যোগ্যতা নেই এই দেশকে ধারণ করার। তুমি বিশ্বাসঘাতক। তুমি বেঈমান। দেশপ্রেম যদি ঈমানের অঙ্গ হয়, সেই ঈমান তোমার নেই। আরেকবার ভাবো। ভুল হয়, ভুল শোধরানো যায়। এদেশ তোমার-আমার। যারা এই দেশের জন্মকে অস্বীকার করেছিলো এইদেশ তাদের নয়, তোমরা তাদের গোলাম নও। তুমি কি আমাদের দলে নাকি ওদের? তোমাদের রক্ত কার কথা বলে???
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা অক্টোবর, ২০১৫ রাত ১০:১৭