ভারত গরু রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে॥
ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং (বি এস এফ) কে বলেছেন, "আপনারা নজরদারি আরো বাড়িয়ে দিন যাতে গরু পাচার পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় এবং বাংলাদেশে গরুর মাংসের দাম আরো ৭০-৮০ শতাংশ বেড়ে যায় যাতে বাংলাদেশের মানুষ গরুর মাংস খাওয়া ছেড়ে দেয় [1]।" বিজেপ এমপি শঙ্কর ভাই এন বলেছেন, ‘গোহত্যা আসলে মহাপাপ। বেদ-এ গরুকে মা বলে বর্ণনা করা হয়েছে। আর কেউ কেউ সেই গরুর মাংস খান। তিনি বলেন, ‘কী হচ্ছে এসব! এদেশে গরুদের রক্ষা করতে না পারলে দেশকে ধ্বংসের হাত থেকে কেউ রক্ষা করতে পারবে না। "বিজেপি’র ওই এমপি সংসদে দাঁড়িয়ে দাবি করেছেন, 'গোমূত্র খেলে ক্যান্সার রোগ সম্পূর্ণ সেরে যায় [2]।" 'ভারতে গরুকে রাষ্ট্রীয় মা স্বীকৃতির দাবী তুলেছেন ক্ষমতাসীন দল বিজেপির এমপি যোগী আদিত্যনাথ [3]।'
হিন্দু জনসমষ্টি গো মাংস খায় না। গো হত্যা ও গো মাংস খাওয়াকে তারা পাপ হিসেবে গণ্য করে। এ প্রসঙ্গে আমরা হিন্দু ধর্মীয় অনুশাসনে গরুর অবস্থান সম্পর্কে আলোকপাত করতে পারি। হিন্দু ধর্ম বিশ্বাসীদের মধ্যে গরুর মাংস এতটাই নিষিদ্ধ এবং ধর্মীয় দিক থেকে স্পর্শকাতর যে, বৃটিশ ভারতে এনফিল্ড নামক রাইফেল এ গরুর চর্বি ব্যবহারের গুজব থেকে ভারতীয় হিন্দু সৈন্যগণ ১৮৫৭ সনে সিপাহি বিদ্রোহে যোগদানে উৎসাহিত হয়েছিল। গাভী থেকে দুধ, দধি, ঘি, বাটার, মল-মূত্র পাওয়া যায় তার সকল গুলোই প্রয়োজনীয় এবং হিন্দুদের ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতায় ব্যবহার করা হয়। এমনকি "হিন্দুদের স্বধর্মে প্রত্যাবর্তনের ক্ষেত্রে গোবর খাওয়ারও প্রচলণ রয়েছে। গোড়া হিন্দুদের কপালে ব্যবহৃত ধর্মীয় চিহ্নতেও অন্যান্য উপাদানের সংগে গোবর ব্যবহার করা হয় [4]।"
ধর্মীয় কারণে ভারত সরকার গরু রপ্তানি বন্ধ করেছে এবং কঠোর অবস্থানে আছে। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন আসতে পারে আসলেই কি গরু খাওয়া হিন্দু ধর্মে নিিষদ্ধ??? আসুন দেখে নেই হিন্দু ধর্ম গ্রন্থগুলো কি বলছে॥ 'গাভী মানুষের জন্য ভোজনীয় [বেদ:৪/১/৬]।' ইন্দ্রের জন্য গো বৎস উৎসর্গ করা হয়েছে। [ঋকবেদ:১০: ৮৬: ১৪]। এমনকি উপনিষদ বলছে: ‘বেদজ্ঞান লাভ করতে হলে,স্বাস্থ্যবান সন্তান লাভ করতে হলে ষাঁড়ের মাংস খাওয়া জরুরি। "রাম গোমাংস ভক্ষণ করিতেন। বনগমনের পথে রাম, লক্ষ্মণ ও সীতা ভরদ্বাজ মুনির আশ্রমে উপস্থিত হলে মুনিবর বৃষ এবং ফলমূল দিয়ে তাদের ব্যবস্থা করেছিলেন (বাল্মীকি রামায়ণ ২/৫৪)।" 'পূর্বে ব্রাহ্মণরা গো-মাংস ভক্ষণ করতেন [5]। রিক বেদে বলা হয়েছে — 'Agni is described as “fed on ox and cow” In the Rig Veda (RV: VIII.43.11)'
তবে যে কারণেই গরু রপ্তানি বন্ধ হোকনা কেন তা অবশ্যই ভারতীয় অর্থনীতির জন্য সুখকর বিষয় না। Times of india খবরে বলা হয়েছে - Every year, on an average, close to 25 lakh cattle are smuggled from India to Bangladesh illegally across the border. এবং গরু রপ্তানি বন্ধের ফলে -
"Starving Bangladesh of beef' would cost India Rs 31,000 crore [6]." বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৩৯ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হবে ভারতের॥
কারণ ভারতের বিভিন্ন গোশালায় যে সোয়া কোটি গরু রয়েছে তাদেরকে স্বাভাবিক ভাবে মৃত্যু পর্যন্ত লালন-পালন করতে হবে। এমনকি ভারতের শিশুদের পুষ্টির জন্য ‘সমন্বিত শিশু উন্নয়ন প্রকল্পের’ আওতায় ভারত সরকার যে অর্থ বরাদ্দ দেয় এই অর্থ ঠিক তার চারগুণ। ভারতে গরুর গড় আয়ু সাধারণত ১৫-২০ বছর। তবে আয়ু শেষ হওয়ার ৫ বছর আগ থেকেই ওই গরুর দুধ নেয়া বন্ধ করে দেয় ডেইরি ফার্মগুলো। প্রতি বছর বাংলাদেশে পাচার হয় ২৫ লাখ গরু। যদি পাচার একেবারেই বন্ধ করে দেয়া হয় তবে অকর্মণ্য সোয়া কোটি গরুকে স্বাভাবিক মৃত্যু পর্যন্ত লালন-পালন করতে হবে। একটি গরু লালন-পালনের জন্য রাখালের বেতন, রক্ষণাবেক্ষণ, খাবার কেনা ইত্যাদি বাবদ বছরে খরচ হয় ২৫০০০ রুপি। ফলে সর্বসাকুল্যে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে ৩১,২৫০ কোটি রুপি (প্রায় ৩৯,০০০ কোটি টাকা)। আগে প্রতি বছর গড়ে ২৫ লাখ গরু ভারত থেকে বাংলাদেশের সীমান্ত পার হয়েছে। "দুই দেশের মধ্যে চলমান অঘোষিত এ বাণিজ্যের আর্থিক ব্যাপ্তিটাও কম ছিল না, গড়ে বার্ষিক ১০০ কোটি ডলার প্রায় [7]।"
তবে যে কারণেই গরু রপ্তানি বন্ধ হোকনা কেনো আমি বলবো এটা বাংলাদেশের জন্য ভালো। "আমাদের দেশে বর্তমানে মোট গরুর সংখ্যা২ কোটি ৮১ লাখ ৮৯ হাজার। এর মধ্যে ষাঁড় এক কোটি ৯ লাখ ৭৬টি এবং গাভী ১ কোটি ৭২ লাখ ১৩ হাজারটি। অন্যদিকে, দেশে মোট মহিষের সংখ্যা ৫ লাখ ৫২ হাজার। আর মোট ছাগলের সংখ্যা এক কোটি ৯২ লাখ ৮৮ হাজারটি। এছাড়া দেশে মোট ভেড়া আছে ১৩ লাখ ৮৫ হাজারটি [8]।" "বলদ ও গাভী যথাক্রমে ৫১ ও ৪৯ ভাগ। আবার এর মধ্যে আনুমানিক দুধেল গাভী ৩৫.৩০ লাখ, দুগ্ধহীন ২৬.১০ লাখ, ভারবাহী ২১.৩০ লাখ ও উন্নতমানের গরু প্রায় ৩৩.০০ লাখ [9]।"
"সব মিলিয়ে গবাদি পশুর সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৫ কোটি [10]। আমাদের দেশে
"প্রতি বছর ১ কোটি গরু ও ১ কোটি ২০ লাখ ছাগল জবাই হয়। যার ৫০ শতাংশ সংগ্রহ করা হয় কোরবানির মৌসুমে [11]।"
অপরদিকে "২০০৬-০৭ অর্থ বছরে মোট মাংসের উৎপাদন ছিল ১০ লাখ টন। এভাবে ২০০৮-০৯ অর্থ বছর পর্যন্ত অতিবাহিত হলেও ২০০৯-১০ অর্থবছরে এসে ১২ লাখ টনে পৌছেছে। এরপর ২০১০-১১ অর্থ বছরে ১৯ লাখ, ২০১১-১২ অর্থবছরে ২৩ লাখ এবং সর্বশেষ ২০১৩-১৪ অর্থবছরে মাংস উৎপাদনের পরিমাণ ছিল সর্বোচ্চ ৪৫ লাখ ২০ হাজার টন। সেখানে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে জানুয়ারি পর্যন্ত মাংস আহরণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৯ লাখ ৮৬ হাজার টন [12।" অপরদিকে ১৬ কোটির মুসলিম অধ্যুষিত বাংলাদেশে কোরবানী উপলক্ষে মাংস খাওয়ার ধুম পড়লেও "বছরে গড় প্রতি একজন বাংলাদেশীর মাংস গ্রহণের হার মাত্র ৩.১ কেজি। যেখানে ডেনমার্ক এ ১৪৫.৯ কেজি, কাতারে ৯০.৫ কেজি, বাহরাইনে ৭০.৭ কেজি , লেবাননে ৬৩.২ কেজি, কুয়েতে ৬০.২ কেজি, ব্রুনাইতে ৫৬.৪ কেজি, সৌদি আরবে ৪৪.৬ কেজি, মালয়েশিয়াতে ৫০.৯ কেজি [13]।"
বস্তুত সীমান্তে এই কড়াকড়ির ফলেই বাংলাদেশের বাজারে গরুর মাংসের দাম বেড়ে গেছে ॥ "প্রতিবার দেশীয় গরুতেই কুরবানির ৭০ শতাংশ চাহিদা মেটে। বাকি ৩০ শতাংশ ভারত থেকে আসে [14]।"
এই ৩০% গরুর চাহিদা মেটানোটা আমাদের জন্য কোন সমস্যাই না।
ভারতীয় গরু সস্তা হওয়ায় গত এক দশকে বাংলাদেশে এ প্রাণীটি পালনের হার সঙ্গত কারণেই তেমন বাড়েনি বরং কমে গেছে। এইতো গত কোরবানি ঈদের পর থেকে ভারত থেকে গরু সরবরাহ ব্যাপক ভাবে কমে যাওয়ায় এই মাংসের মূল্য কেজি প্রতি ৪০ শতাংশ বেড়ে ৩৮০- ৪০০ টাকা হয়েছে। তবে এর ইতিবাচক দিক হলো ভালো দাম পাওয়ায় দেশে এখন গরু পালনের দিকে ঝোঁক দিন দিন বেড়ে চলেছে। আর এই প্রবণতা অব্যাহত থাকলে আগামীতে আমাদের চাতক পাখির ন্যায় ভারতের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবেনা । তাছাড়া গরু পালন দেশে বেড়ে গেলে চামড়া থেকে আগের তুলনায় অনেক বেশী মুনাফা অর্জন করতে পারবে বাংলাদেশ।
২০ বর্গফুট গরুর কৈটি চামড়ার ক্রয় মূল্য হচ্ছে ১৭শ থেকে ১৮শ টাকা। চামড়া প্রক্রিয়াজাত করতে প্রায় ৪৮ শতাংশ মূল্য সংযোজন হয়েছে। ফলে মূল্য সংযোজনের পর চামড়ার মূল্য দাঁড়ায় ২৫৫০ টাকা থেকে ২৭০০ টাকায়। ওই হিসাবে কৈ বর্গফুট চামড়ার মূল্য হচ্ছে ১২৩ টাকা থেকে ১৩২ টাকা পর্যন্ত। মার্কিন ডলারের হিসাবে ১ দশমিক ৬০ ডলার। রফতানির ক্ষেত্রে জাহাজীকরণ ব্যয় ও অন্যান্য ব্যয় আরও ১৫ শতাংশ ধরে মূল্য দাঁড়ায় প্রতি বর্গফুট ১ দশমিক ৮০ ডলার। প্রতি বর্গফুট চামড়া বিদেশে রফতানি করে গড় মূল্য হচ্ছে ৩ দশমিক ৭০ ডলার। ওই হিসাবে কৈ বর্গফুট চামড়া থেকে নীট মুনাফা হচ্ছে ১ দশমিক ৯০ ডলার। যা দেশীয় অর্থে আসছে ১৪৮ টাকা। বিএফটিআইয়ের হিসাবে ২০ বর্গফুটের কৈটি চামড়া বিদেশে রফতানি করে আয় হচ্ছে প্রায় ৩ হাজার টাকা। গরু পালন বাড়লে বৈদেশিক মুদ্রাও বাড়বে। বাংলাদেশের চর অঞ্চলগুলোতে প্রচুর পরিমানে গরু উৎপাদন করে থাকে গ্রামীন জনগণ। সরকার যদি ঐ অঞ্চলের মানুষকে গবাদী পশু পালন করতে বিনা শর্তে ঋণ দেয়, তবে ২-৩ বছরের মধ্যে বাংলাদেশে গরু উৎপাদন কয়েক গুন বৃদ্ধি করা সম্ভব। এতে চর অঞ্চলের মানুষদের দারিদ্রতারও হ্রাস পাবে এবং গরুর জন্য বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠবে, ভারতের উপর নির্ভরশীল হতে হবে না, প্রয়োজনে বাংলাদেশের গরুর মাংস বিদেশেও রফতানি করা যাবে, সেই দিন আর হয়তো বেশী দুরে নয়॥ সবশেষে একটি কবিতার লাইন দিয়ে শেষ করলাম ....'জলে না নামিলে কেহ শিখে না সাঁতার / হাঁটিতে শিখে না কেহ না খেয়ে আছাড়।'
.
তথ্য সুত্র -
.
[1] কালের কণ্ঠ ৩ এপ্রিল, ২০১৫ ।
.
[2] রেডিও তেহরান, ২২ মার্চ ১৫ ।
.
[3] Economic times, 3 april 15.
.
[4] দৈনিক সংবাদ, ২১ আগস্ট ১৫ ।
.
[5] হিন্দুধর্ম,এম.কে. গান্ধী,নিউ দিল্লি,১৯৯১,পৃ. ১২০ ।
.
[6] Times of india, এপ্রিল ৩, ২০১৫।
.
[7] বণিক বার্তা, ৪/৯/১৫।
.
[8] বাংলাদেশ প্রতিদিন,১৭ জুন ২০১৫॥
.
[9] ভোরের পাতা, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৫।
.
[10] দেশ বিদেশে, ৬/১২/১৩।
.
[11] যুগান্তর, ১৩ অক্টোবর ২০১৩।
.
[12] আমাদের সময়, ৯ আগস্ট ১৫ ।
.
[13] Guardian News, 2
september 09.
.
[14] ভোরের কাগজ, ১৫ সেপ্টেম্বর ১৫।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৫ দুপুর ২:৫১