somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ছায়ার শহরের রক্তচিহ্ন

১৪ ই এপ্রিল, ২০২৫ রাত ৮:৪৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


(ষড়ঋপু সিরিজের শেষ পর্ব ”অহংকার”)

নারায়ণগঞ্জ—শহর নয়, যেন এক আত্মা। তার অলিগলি, ধুলোমাখা রাস্তা আর শীতলক্ষ্যার ঢেউয়ে মিশে আছে শতাব্দীর ঘাম, রক্ত আর অভিমান। সন্ধ্যার পর, যখন আলো-অন্ধকারের ফাঁকে পুরনো বাতিস্তম্ভগুলো কাঁপে, তখন শহরের ভেতর এক অদৃশ্য গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে—যেটা শুধু গর্বীদের জন্য সংরক্ষিত।
সেই গন্ধ, যেটাকে শহরের প্রাচীনরা বলে—“অহংকারের ছায়া”



রাজীব চৌধুরী দাঁড়িয়ে ছিল ফতুল্লা রেলস্টেশনের এক কোণে। সিগারেটের ধোঁয়ার মধ্য দিয়ে তার চোখ জ্বলছিল। এই চোখ কোনো মানুষের ছিল না। যেন দু’টি আঁধারের দরজা—যেখানে আলো ঢুকেও আর ফিরে আসে না।

লোকমুখে শোনা যায়, শীতলক্ষ্যার জলে এক অভিশপ্ত মূর্তি চাপা পড়ে আছে, যেটা নাকি চৌধুরী বংশের পূর্বপুরুষরা নিজের হাতে পূজো করতেন। তার অভিশাপ আর আশীর্বাদ মিলেমিশে জন্ম দিয়েছে এক অনন্য বংশধারার—ক্ষমতার, ভয়ংকর আত্মবিশ্বাসের।

রাজীব সেই ধারারই উত্তরসূরি।

তার এক দৃষ্টি বদলে দিতে পারে মানুষের ভাগ্য।

কিন্তু সেই চোখেই এক কিশোরের মৃত্যু লিপিবদ্ধ হয়েছিল।



আরিফিন জামান—১৬ বছর বয়সী এক কিশোর।

স্বপ্ন দেখত কবি হওয়ার।

তার ডায়েরির পাতায় লেখা থাকত এমন লাইন—

“আমার শহর একদিন আলোতে জ্বলে উঠবে।
আর সব ছায়া সেদিন ভয় পেয়ে পালাবে।”


কিন্তু সেই ছেলেটির মৃতদেহ পাওয়া যায় ডিএনডি বাঁধের পাশের ঝোপে, চোখ খোলা, অথচ মৃত—যেন মৃত্যুর মুহূর্তেও কেউ তাকে চমকে দিয়েছে।

ময়নাতদন্তে উঠে আসে—শ্বাসরোধ করে হত্যা।

কিন্তু সবচেয়ে ভীতিকর ছিল—তার চোখের মণিতে এক পর্দা কালো দাগ, যেটা নাকি অনেকটা কাঁচে জমে থাকা ছায়ার মতো।

তার পরিবার কাঁদতে কাঁদতে হাজির হয় নিশাত রায় এর চেম্বারে।



নিশাত—শহরের একমাত্র আইনজীবি, যার কাছে কেস নিয়ে যাওয়া মানেই নিশ্চিত বিচার।

তার কণ্ঠের ভার, চোখের তীক্ষ্ণতা, এবং যুক্তির ধার যেন বাঘের নখ।

নিশাত জানত—এই লড়াই শুধু একটি খুনের বিচার নয়,
এই লড়াই তার নিজের অতীত, তার পিতার অসমাপ্ত যুদ্ধের বহিঃপ্রকাশ।

তার বাবা—প্রয়াত মানবাধিকার আইনজীবি দেবজ্যোতি রায়—এক সময় চৌধুরী বংশের অপরাধ চক্রকে ফাঁস করতে গিয়েই ‘দুর্ঘটনায়’ প্রাণ হারান।

তখন থেকেই নিশাত জানত, একদিন ফিরে আসবে সে... সেই ছায়াকে চূর্ণ করতে।



আদালতে ঝড় ওঠে।

নিশাত তার যুক্তি দিয়ে কোর্টকে অবাক করে।

সে তুলে আনে সিসিটিভি ফুটেজ, আরিফিনের বন্ধুর সাক্ষ্য, রাসায়নিক বিশ্লেষণ, এবং এমনকি চৌধুরী হাউজের পুরোনো কর্মচারীদের গোপন স্বীকারোক্তি।

রাজীব দাঁড়িয়ে থাকে—প্রথমে হাসি, তারপর ঠোঁট চেপে ধরা দম্ভ।

কিন্তু সবকিছুকে ছাপিয়ে যায় নিশাতের সেই বক্তব্য—

“এই কোর্ট শুধু একটি হত্যার বিচার করছে না।
এই কোর্ট বিচার করছে এক শহরের আত্মার।
সেই আত্মা, যাকে অহংকারে আচ্ছন্ন করে রেখেছে এমন কিছু মানুষ, যারা মনে করে—আইন তাদের জন্য নয়।”


কোর্ট নিস্তব্ধ।

অবশেষে রায় আসে—রাজীব চৌধুরী দোষী।



তবে গল্প থেমে থাকে না।

কারাগারে নিয়ে যাওয়ার সময়, রাজীব একবার থেমে যায়।

তার চোখে তখন আর আগের সেই দম্ভ নেই।

বরং এক অজানা অন্ধকার যেন কুণ্ডলি পাকাচ্ছে।

সে নিশাতের দিকে তাকিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে—

“তুই জিতেছিস... এইবার।
কিন্তু খেলা আবার হবে।
আমি না হই, আমার ছায়া ঠিক ফিরবে।”


তার ঠোঁটে এক অস্পষ্ট হাসি।

তার চোখের মণি তখন হঠাৎ এক ঝলকে লালচে হয়ে ওঠে।

এক পুরোনো পুলিশ অফিসার পরে বলে উঠেছিল—

“আমার মনে হলো, আমি রাজীব না, ওর পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা কারো দিকে তাকিয়ে ছিলাম। কে জানে, ও আসলে কার দৃষ্টিতে হাঁটছিল।”



রাতের নারায়ণগঞ্জ ফিরে যায় নিজের ছায়ায়।

শীতলক্ষ্যার ঢেউয়ে আবারও ছড়িয়ে পড়ে এক চাপা গন্ধ—অহংকারের, প্রতিশোধের।

নিশাত জানে—রাজীব পরাজিত।

কিন্তু চৌধুরী বংশের ছায়া এখনো বেঁচে আছে।

আরিফিনের মৃত্যু হয়তো এক সূচনা।

নিশাতের লড়াই তো এখনই শুরু।

শেষ কথা

"ষড়ঋপু" সিরিজের এই পর্ব ‘অহংকার’ আমাদের দেখায়—ক্ষমতা যখন সীমাহীন হয়, যখন আত্মবিশ্বাস হয়ে ওঠে আত্ম-অন্ধতা, তখন তা ছড়িয়ে পড়ে বিষের মতো।

কিন্তু প্রতিটি বিষের বিপরীতে থাকে এক প্রতিশোধ।

আর প্রতিশোধের নাম যদি হয় ছায়ার শহরের রক্তচিহ্ন, তাহলে লড়াই থামে না—চোখ জ্বলে, আইন দাঁড়ায়, ছায়া ভাঙে।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৫ ভোর ৬:২২
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মুনাজাত

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৫ সকাল ৯:৫৫

ধরতে ধরতে হয়না ধরা,
ফসকে গেল শেষে।
মান-অভিমান দিলাম ঝেড়ে,
তোমার কাছে এসে।

ঠকতে ঠকতে যায়নি ঠেকা,
অতলে গেলাম ভেসে।
ধূলির মতো জীবন হেসে যায়,
তোমায় ভালোবেসে।

কত শতবার পাশ কেটে যাই,
অবহেলার মন ঠেসে।
হোঁচট খেলেই ফের... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারত একটি মানবিক দেশ

লিখেছেন রাজীব নুর, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৫ দুপুর ১:৩৮



যতদিন বাংলাদেশ থাকবে ততদিন আমরা ভারতবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকব।
ভারতের মানুষের সঙ্গে আমাদের কোনো শত্রুতা নেই। আমরা বাংলাদেশি তোমরা ভারতীয়। আমরা মিলেমিশে থাকতে চাই। ভারতের বাংলাদেশের সাথে সাংস্কৃতিক,... ...বাকিটুকু পড়ুন

লামিয়ার আত্মহনন: রাষ্ট্রীয় অক্ষমতা, সামাজিক নিষ্ঠুরতা ও মনুষ্যত্বের অন্তর্গত অপমান !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৫ বিকাল ৫:৫১


সেদিন ছিল ১৮ মার্চ ২০২৫। পটুয়াখালীর দুমকীতে বাবার কবর জিয়ারত করে ফেরার পথে ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন শহীদ জসিম হাওলাদারের ১৭ বছরের কলেজপড়ুয়া মেয়ে লামিয়া। সে বাবা, যিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সমুদ্রের গভীরে 'অন্ধকার অক্সিজেন'!

লিখেছেন শাহ আজিজ, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:৩৩



সমুদ্রের গভীরে 'অন্ধকার অক্সিজেন'! তৈরি হচ্ছে সূর্যালোক ছাড়াই, বিস্মিত বিজ্ঞানীরা:—

♦️সমুদ্রের ৪ হাজার মিটার তলদেশ। অন্ধকারে আচ্ছন্ন এক জগৎ। আর সেখানেই নাকি রয়েছে অক্সিজেন! বিজ্ঞানীরা যাকে ডাকছেন 'ডার্ক অক্সিজেন' নামে। 'নেচার... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে বললেন প্রধান উপদেষ্টা !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৫ রাত ১০:০৪


আজ বিমান বাহিনীর বার্ষিক মহড়ায় এমনটাই বলেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস। এমন বক্তব্যের পর সোশ্যাল মিডিয়ায় নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। অনেকেই প্রশ্ন করছেন বাংলাদেশ কি তবে মিয়ানমারের সাথে যুদ্ধ... ...বাকিটুকু পড়ুন

×