(ষড়ঋপু সিরিজের শেষ পর্ব ”অহংকার”)
নারায়ণগঞ্জ—শহর নয়, যেন এক আত্মা। তার অলিগলি, ধুলোমাখা রাস্তা আর শীতলক্ষ্যার ঢেউয়ে মিশে আছে শতাব্দীর ঘাম, রক্ত আর অভিমান। সন্ধ্যার পর, যখন আলো-অন্ধকারের ফাঁকে পুরনো বাতিস্তম্ভগুলো কাঁপে, তখন শহরের ভেতর এক অদৃশ্য গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে—যেটা শুধু গর্বীদের জন্য সংরক্ষিত।
সেই গন্ধ, যেটাকে শহরের প্রাচীনরা বলে—“অহংকারের ছায়া”।
১
রাজীব চৌধুরী দাঁড়িয়ে ছিল ফতুল্লা রেলস্টেশনের এক কোণে। সিগারেটের ধোঁয়ার মধ্য দিয়ে তার চোখ জ্বলছিল। এই চোখ কোনো মানুষের ছিল না। যেন দু’টি আঁধারের দরজা—যেখানে আলো ঢুকেও আর ফিরে আসে না।
লোকমুখে শোনা যায়, শীতলক্ষ্যার জলে এক অভিশপ্ত মূর্তি চাপা পড়ে আছে, যেটা নাকি চৌধুরী বংশের পূর্বপুরুষরা নিজের হাতে পূজো করতেন। তার অভিশাপ আর আশীর্বাদ মিলেমিশে জন্ম দিয়েছে এক অনন্য বংশধারার—ক্ষমতার, ভয়ংকর আত্মবিশ্বাসের।
রাজীব সেই ধারারই উত্তরসূরি।
তার এক দৃষ্টি বদলে দিতে পারে মানুষের ভাগ্য।
কিন্তু সেই চোখেই এক কিশোরের মৃত্যু লিপিবদ্ধ হয়েছিল।
২
আরিফিন জামান—১৬ বছর বয়সী এক কিশোর।
স্বপ্ন দেখত কবি হওয়ার।
তার ডায়েরির পাতায় লেখা থাকত এমন লাইন—
“আমার শহর একদিন আলোতে জ্বলে উঠবে।
আর সব ছায়া সেদিন ভয় পেয়ে পালাবে।”
কিন্তু সেই ছেলেটির মৃতদেহ পাওয়া যায় ডিএনডি বাঁধের পাশের ঝোপে, চোখ খোলা, অথচ মৃত—যেন মৃত্যুর মুহূর্তেও কেউ তাকে চমকে দিয়েছে।
ময়নাতদন্তে উঠে আসে—শ্বাসরোধ করে হত্যা।
কিন্তু সবচেয়ে ভীতিকর ছিল—তার চোখের মণিতে এক পর্দা কালো দাগ, যেটা নাকি অনেকটা কাঁচে জমে থাকা ছায়ার মতো।
তার পরিবার কাঁদতে কাঁদতে হাজির হয় নিশাত রায় এর চেম্বারে।
৩
নিশাত—শহরের একমাত্র আইনজীবি, যার কাছে কেস নিয়ে যাওয়া মানেই নিশ্চিত বিচার।
তার কণ্ঠের ভার, চোখের তীক্ষ্ণতা, এবং যুক্তির ধার যেন বাঘের নখ।
নিশাত জানত—এই লড়াই শুধু একটি খুনের বিচার নয়,
এই লড়াই তার নিজের অতীত, তার পিতার অসমাপ্ত যুদ্ধের বহিঃপ্রকাশ।
তার বাবা—প্রয়াত মানবাধিকার আইনজীবি দেবজ্যোতি রায়—এক সময় চৌধুরী বংশের অপরাধ চক্রকে ফাঁস করতে গিয়েই ‘দুর্ঘটনায়’ প্রাণ হারান।
তখন থেকেই নিশাত জানত, একদিন ফিরে আসবে সে... সেই ছায়াকে চূর্ণ করতে।
৪
আদালতে ঝড় ওঠে।
নিশাত তার যুক্তি দিয়ে কোর্টকে অবাক করে।
সে তুলে আনে সিসিটিভি ফুটেজ, আরিফিনের বন্ধুর সাক্ষ্য, রাসায়নিক বিশ্লেষণ, এবং এমনকি চৌধুরী হাউজের পুরোনো কর্মচারীদের গোপন স্বীকারোক্তি।
রাজীব দাঁড়িয়ে থাকে—প্রথমে হাসি, তারপর ঠোঁট চেপে ধরা দম্ভ।
কিন্তু সবকিছুকে ছাপিয়ে যায় নিশাতের সেই বক্তব্য—
“এই কোর্ট শুধু একটি হত্যার বিচার করছে না।
এই কোর্ট বিচার করছে এক শহরের আত্মার।
সেই আত্মা, যাকে অহংকারে আচ্ছন্ন করে রেখেছে এমন কিছু মানুষ, যারা মনে করে—আইন তাদের জন্য নয়।”
কোর্ট নিস্তব্ধ।
অবশেষে রায় আসে—রাজীব চৌধুরী দোষী।
৫
তবে গল্প থেমে থাকে না।
কারাগারে নিয়ে যাওয়ার সময়, রাজীব একবার থেমে যায়।
তার চোখে তখন আর আগের সেই দম্ভ নেই।
বরং এক অজানা অন্ধকার যেন কুণ্ডলি পাকাচ্ছে।
সে নিশাতের দিকে তাকিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে—
“তুই জিতেছিস... এইবার।
কিন্তু খেলা আবার হবে।
আমি না হই, আমার ছায়া ঠিক ফিরবে।”
তার ঠোঁটে এক অস্পষ্ট হাসি।
তার চোখের মণি তখন হঠাৎ এক ঝলকে লালচে হয়ে ওঠে।
এক পুরোনো পুলিশ অফিসার পরে বলে উঠেছিল—
“আমার মনে হলো, আমি রাজীব না, ওর পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা কারো দিকে তাকিয়ে ছিলাম। কে জানে, ও আসলে কার দৃষ্টিতে হাঁটছিল।”
৬
রাতের নারায়ণগঞ্জ ফিরে যায় নিজের ছায়ায়।
শীতলক্ষ্যার ঢেউয়ে আবারও ছড়িয়ে পড়ে এক চাপা গন্ধ—অহংকারের, প্রতিশোধের।
নিশাত জানে—রাজীব পরাজিত।
কিন্তু চৌধুরী বংশের ছায়া এখনো বেঁচে আছে।
আরিফিনের মৃত্যু হয়তো এক সূচনা।
নিশাতের লড়াই তো এখনই শুরু।
শেষ কথা
"ষড়ঋপু" সিরিজের এই পর্ব ‘অহংকার’ আমাদের দেখায়—ক্ষমতা যখন সীমাহীন হয়, যখন আত্মবিশ্বাস হয়ে ওঠে আত্ম-অন্ধতা, তখন তা ছড়িয়ে পড়ে বিষের মতো।
কিন্তু প্রতিটি বিষের বিপরীতে থাকে এক প্রতিশোধ।
আর প্রতিশোধের নাম যদি হয় ছায়ার শহরের রক্তচিহ্ন, তাহলে লড়াই থামে না—চোখ জ্বলে, আইন দাঁড়ায়, ছায়া ভাঙে।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৫ ভোর ৬:২২