somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রক্তকমল

০৯ ই এপ্রিল, ২০২৫ রাত ১০:৪৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


(ষড়ঋপু সিরিজের প্রথম কাহিনি — কাম)

সে ছিল এক স্বপ্নের মতো কিশোর—নিরীহ, শান্ত স্বভাবের, যাকে দেখলে মনে হতো যেন নিসর্গের আঁচলে গড়া কোনো দুর্লভ মানুষ। নাম তার শুদ্ধ। নামের মতোই যার চোখে মুখে ছিল এক পবিত্র মায়া, যার আচরণে ছিল আস্থা আর শ্রদ্ধার আশ্বাস। প্রতিবেশীরা তাকে ভালোবাসত। শিক্ষকেরা বলত, "শুদ্ধর মতো ছেলে আজকাল আর হয় না।"

কিন্তু এই প্রশংসার জবাব সে কখনো দেয়নি। হাসি দিয়ে পাশ কেটে গেছে। কারণ সে জানত, তার ভেতরে গোপনে বেড়ে উঠছে এক অজানা আগুন—নিবৃত্ত কামনার নিঃশব্দ দাবানল।

শুদ্ধর দিন কাটত লেখাপড়া, বই আর ছাদের খোলা হাওয়ায়। কিন্তু রাত… রাত ছিল ভিন্ন এক পৃথিবী। তার শোবার ঘরের জানালা থেকে দেখা যেত পাশের বাড়ির লোহার গেট, উঠোন, আর মাঝে মাঝে খোলা জানালার আলোকিত চৌকাঠ।

সেই জানালাতেই মাঝে মাঝে দেখা যেত লীলাকে—এক পরিণত নারীর, সদ্য বিধবা। লীলা ছিলেন এক রহস্যময় উপপত্তি। শুদ্ধ তাকে দেখত দূর থেকে—বিভোর হয়ে, বরং যেন এক নিষিদ্ধ ফুলের ঘ্রাণ নিতে আসা প্রজাপতির মতো।

লীলার চলাফেরা ছিল একধরনের ধীর অভিজাততা, প্রতিটি ভঙ্গিতে ছিল স্তব্ধ এক বেদনার ছাপ। কিন্তু সেই বেদনার মধ্যেও যেন কামনার এক অদ্ভুত আলো জ্বলে থাকত, যা শুদ্ধর নিস্তব্ধ হৃদয়ে এক পশু সত্তার ঘুম ভাঙিয়ে দিত।

সে লুকিয়ে দেখত, যখন লীলা বাথরুমে যেতেন, উন্মুক্ত জানালার হালকা পর্দায় ছায়া আঁকতেন। তাঁর পিঠের রেখা, ভেজা চুল থেকে ফোঁটা ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়া, কিংবা বুক ঢেকে রাখা হাত—এই সবকিছুই একেকটা ছায়া যেন শুদ্ধর মনের ভেতর নতুন করে কামনাবোধ জাগিয়ে তুলত।

তাকে দেখার পরে, সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকত—নিজের চোখের গভীরে সেই আলো-ছায়ার খেলা খুঁজে পেত। আর তখন, আয়নার মধ্যেই সে দেখতে পেত এক বিকৃত প্রতিবিম্ব।

সেই ‘অন্য’ শুদ্ধ ছিল হিংস্র, জর্জরিত, আর তীব্রভাবে কামনার্ত। তার চোখ জ্বলত। ঠোঁটের কোণে একধরনের নির্লজ্জ হাসি। যেন সে বলছে:"তুমি ভাবো তুমি বিশুদ্ধ? আমি তো তোমারই ছায়া।"

এই ছায়াটি প্রথম সে অনুভব করেছিল তেরো বছর বয়সে, এক রাতে, যখন হঠাৎ করে তার শরীরে শিহরণ হয়েছিল—কারণ, সে প্রথমবার লীলাকে দেখেছিল সাদা শাড়িতে, সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে। সেই দৃশ্য তার মনে গেঁথে যায়। তখন সে জানত না, এই অনুভবের নাম কী, কিন্তু এখন জানে—এই কামনাবোধ তাকে ধীরে ধীরে গ্রাস করছে।

তবে শুদ্ধ চেয়েছিল মুক্তি। সে লিখত, আঁকত, ভাবত—এই পাপবোধ থেকে রক্ষা পেতে। কিন্তু লীলার প্রতিটি উপস্থিতি তার ভেতরের ছায়াকে শক্তিশালী করে তুলছিল। সে রাত্রিবেলা বইয়ের ফাঁকে তার বর্ণনার ছবি আঁকত, বৃষ্টির শব্দে কল্পনায় তার শরীরের ধ্বনি শুনত।

এভাবেই দিন চলছিল। আর তার মনোজগতের ছায়া ঘন হচ্ছিল।

এক রাতে, ঝড় উঠল। শহরে বিদ্যুৎ নেই। ছাদ থেকে ভেসে এল শব্দ। শুদ্ধ বাইরে বেরিয়ে এল—হাতে একটা পুরোনো টর্চ। ছাদে গিয়ে সে দেখতে পেল লীলা—ভেজা, চোখে আতঙ্ক।

"ছাদে কেউ ছিল… আমি চমকে গেছি," লীলা বলল।

শুদ্ধ তার দিকে তাকাল। সে অনুভব করল, তার ভেতরের ‘ছায়া’ এবার সত্যিকার অর্থে শ্বাস নিচ্ছে। লীলার ভেজা শাড়ি, ভিজে চুল থেকে গড়িয়ে পড়া জলের ধারা—তাকে যেন দুঃস্বপ্নে ডুবিয়ে দিল।

সে বলল, "আপনি ভেতরে যান। আমি দেখছি।"

ছাদে কিছু ছিল না। শুধু একটা ভাঙা আয়না। সে আয়নার দিকে তাকাতেই নিজের প্রতিবিম্বে সেই ‘অন্য’ শুদ্ধকে আবার দেখতে পেল।

সময় হয়েছে,” সে ফিসফিস করল। “তুমি শুধু দেখনি, আমি তৈরি করেছি তোমাকে।

তারা মুখোমুখি দাঁড়াল। যেন আয়নায় সে নিজেকেই দেখছে না—দেখছে তার কামনাবিধ্বস্ত ছায়ার দৈত্যকে।

সে আয়নার কাচ ভেঙে ফেলল। কিন্তু কিছুতেই কিছু থামল না। সে নিচে নেমে এলো। লীলা তখনও দাঁড়িয়ে। তাদের চোখে চোখ পড়ল। মুহূর্তে সময় থেমে গেল। বাতাস থেমে গেল।

তখন শুদ্ধ তার মনের গভীরে অনুভব করল—সে আর স্বপ্নে নেই। এই নারী, এই কামনা, এই রাত—সবই বাস্তব।

সে চাইল ছুঁতে। কিন্তু হাত বাড়িয়ে থেমে গেল। কারণ জানালার বাইরে দেখা গেল—কেউ দাঁড়িয়ে আছে অন্ধকারে। সেই ছায়ামূর্তি। তার চোখ জ্বলছে। মুখে এক নির্মম হাসি। সে বলল না কিছু, শুধু আঙুল তুলে দেখাল শুদ্ধকে।

শুদ্ধ পিছিয়ে এলো। লীলা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।

পরদিন সকালে কেউ লীলার খোঁজ পায়নি। দরজা খোলা, ঘর খালি, এক কোণে পড়ে আছে একটা ছেঁড়া শাড়ির টুকরো আর কিছু শুকিয়ে যাওয়া পানির দাগ।

শুদ্ধ আগের মতোই শান্ত, বিনীত। স্কুলে যায়, বই পড়ে, হাসে। কেউ বোঝে না, তার ভেতরে এক সত্তা ধীরে ধীরে জয়ী হয়ে উঠছে।

তার ঘরের আয়নায় মাঝে মাঝে দেখা যায়, পেছনে কেউ দাঁড়িয়ে—এক রহস্যময় ছায়া। কারো চোখে পড়লে কেউ হয়তো বলত, ওটা আলোছায়ার খেলা। কিন্তু শুদ্ধ জানে, ওটা ‘সে’। তার কামনাবিধ্বস্ত ছায়া।

আর আয়নার নিচে লুকিয়ে রাখা সেই ছেঁড়া শাড়ির টুকরো, এখনো মাঝে মাঝে জেগে ওঠে রাত্রির বাতাসে।

তখনই শুদ্ধর ঠোঁটের কোণে ফুটে ওঠে এক অদ্ভুত হাসি—
রক্তকমলের হাসি।

শেষ নয়… শুরু মাত্র।



সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৫ ভোর ৬:১৫
৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

উপমা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৫ বিকাল ৫:১৭


ছবি: ইন্টারনেট

আজ তোমার ছুটি দিয়ে দিচ্ছি,
ভোর আর সাঁঝের বেলায় দিন রাত্রি মিলনের যে সময়টুকু পায়,
সেটুকু সময়ও আমার সাথে ছলনা করতে বিন্দুমাত্র ভাবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

তারেক জিয়ার কি হবে তাহলে!

লিখেছেন আবদুর রব শরীফ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৫ বিকাল ৫:৪২

আজকের এই বিশেষ দিনে নাহিদ ইসলাম ঠিক সকাল ৯টায় উঠে দেখলেন, সোশ্যাল মিডিয়া ভরে গেছে শুভেচ্ছাবার্তায়। কেউ লিখছে "আমাদের ভবিষ্যতের নায়ক", কেউ বলছে "নেক্সট লিডার"।

চা হাতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে নাহিদ ভাবছেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

শুভ জন্মদিন নাহিদ ইসলাম

লিখেছেন মেঠোপথ২৩, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৫ রাত ৯:২৪



জন্মদিনের অনেক অনেক শুভেচ্ছা রইল নাহিদ ইসলাম।তোমরা এই জেন-যি প্রজন্ম সবাই আমার সন্তানের বয়সি বলে তুমি হিসাবে সম্বোধন করে এই পোস্ট লিখছি। রাজপথের মিটিং মিছিল থেকে জুলাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দূর্নীতিমুক্ত ?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৫ রাত ১০:০৬


কালের কন্ঠ(বসুন্ধরা গ্রুপ) গত ২১শে এপ্রিল সংবাদ করেছিলো দুদকের চেয়ারম্যান মন্তব্য করেছেন "অন্তবর্তী সরকার দূর্নীতিমুক্ত"। তিনি কিভাবে জানলেন যে সরকার দুর্নীতিমুক্ত ? একজন সংবিধিবদ্ধ স্বতন্ত্র সংস্থার প্রধান হয়ে কোনোরূপ... ...বাকিটুকু পড়ুন

বেহেশত - দোযখ আর ফেরেশতা নিয়ে আমার চিন্তা-ভাবনা

লিখেছেন সত্যপথিক শাইয়্যান, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৫ রাত ১১:১৩

আমার প্রিয় মানুষদের একজন রাজীব নূর ভাই। তিনি তাঁর মেয়েকে মানুষের মতো মানুষ করে গড়ে তুলছেন। আমি তাঁর ভিডিওগুলো দেখি। সেগুলো আমাকে মনে করিয়ে দেয়, আমি তাঁর সম্পর্কে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×