"তম্বুরার কাণ মুচড়াইতে দাড়িধারী তাহার তারে আঙ্গুলি দিতেছিল। যখন তারের মেও মেও আর তবলার খ্যান্ খ্যান্ ওস্তাদজীর বিবেচনায় এক হইয়া মিলিল তখন তিনি সেই গুম্ফশ্মশ্রুর অন্ধকারমধ্য হইতে কতকগুলি তুষারধবল দন্ত বিনির্গত করিয়া, বৃষভদুর্লভ কণ্ঠরব বাহির করিতে আরম্ভ করিলেন। রব নির্গত করিতে করিতে সে তুষারধবল দন্তগুলি বহুবিধ খিচুনিতে পরিণত হইতে লাগিল; এবং ভ্রমরকৃষ্ণ শ্মশ্রুরাশি তাহার অনুবর্ত্তন করিয়া নানাপ্রকার রঙ্গ করিতে লাগিল। তখন যুবতী খিচুনিসন্তাড়িত হইয়া সেই বৃষভদুর্লভ রবের সঙ্গে আপনার কোমলকণ্ঠ মিশাইয়া গীত আরম্ভ করিল - তাহাতে সরু মোটা আওয়াজে, সোণালি রূপালি রকম এক প্রকার গীত হইতে লাগিল।"
উপরের এই অংশটুকু বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের "কৃষ্ণকান্তের উইল" বই এর দ্বিতীয় খন্ডের পঞ্চম পরিচ্ছেদ থেকে নেওয়া হয়েছে।
তখন পড়ি ক্লাস এইট কি নাইনে। বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের সদস্য ছিলাম। পড়ার বই দেখলে বমি বমি ভাব আসলেও বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র থেকে প্রতি সপ্তাহে পাওয়া বইগুলো গোগ্রাসে গিলতাম। তো একবার দুর্ভাগ্যক্রমে আমার ভাগে পড়ল বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের "কৃষ্ণকান্তের উইল"। মাইরি একটা বই! কয়েক পৃষ্ঠা পড়ে বাংলা সাহিত্যের প্রতি চরম ভীতি চলে আসল। একে তো সাধু ভাষায় লেখা তার উপর কিছু কিছু শব্দ পড়ার সময় দাঁত ভেঙে যাবার জোগাড়।
"গোবিন্দলাল তখন কথা কহিল না। তাহার অগ্রে, আলুলায়িতকুন্তলা, অশ্রুবিপ্লুতা, বিবশা, কাতরা, মুগ্ধা, পদপ্রান্তে বিলুন্ঠিতা সেই সপ্তদশবর্ষীয়া বনিতা।".......এমন বাক্য আমার মত মোটামুটি ফাঁকা মস্তিষ্কের অধিকারিনীকে যথেষ্ট পরিমাণে বিভ্রান্ত করে ফেলল। ১০/ ১২ পাতা পড়ে আমি আর ঐ বইয়ের ধারে কাছেও ঘেঁষিনা। তারপর পড়ার চেষ্টা করেও মন বাসাতে পারিনি। আসলে মনটা তখন ঘুরত তিন গোয়েন্দা, শার্লক হোমস, টম সয়্যার, ফেলুদার পিছু পিছু। সময় অনেক গড়িয়েছে......আজ বহুবছর পর সেই বইটা পড়লাম। এখনও যে বাংলা ভাযার কঠিন কঠিন শব্দ আমার দাঁত ভেঙে ফেলেনা তা নয়.....তবে মনে হলো বইটা আগে না পড়ে ভালোই হয়েছে। ক্লাস এইটের মানসিকতা নিয়ে বইটা পড়লে হয়ত কোন মজাই পেতামনা উল্টো বঙ্কিমচন্দ্রের প্রতি একটা বিতৃষ্ণা সৃষ্টি হত। বাংলা সাহিত্যে এত অসাধারণ সব বই আছে যে না পড়লে সেটা আঁচ করা যায়না। "কৃষ্ণকান্তের উইল" বইয়ে বর্ণনাগুলো এক কথায় অসাধারণ.....কয়েক পরিচ্ছেদ পড়লেই ভাষার বিন্যাস মনকে আকৃষ্ট করে ফেলে (আমার ক্ষেত্রে যা হয়েছে)। খুব পরিচিত কাহিনী অথচ কি চমৎকার লেখনী।
কৃষ্ণকান্তের উইল এর গুনকীর্তন আপাতত থাক। এবার আসি আব্জাব্ কথাবার্তায়.....
আমার এক আত্মীয়ার চরম এস্কেলেটর ভীতি আছে। আধুনিক শপিং কম্প্লেক্সের বিজ্ঞাপণে সিঁড়ির বদলে এস্কেলেটর দেখলে তার চোখ মুখ রক্তশূন্য হয়ে যায়। কোন শপিং মলে গেলে তিনি সবার আগে সিঁড়ির খোঁজ নেন। এস্কেলেটরে উঠলে তার মনে হয় তার পা আটকে গেছে কিন্তু পৃথিবী ফুল স্পীডে ঘুরছে.....মাথাটা ভোঁ ভোঁ করতে থাকে....এসব চিন্তা করতে করতেই শেষ ধাপে এসে চরম একটা হোঁচট খান। তিনি খুব লজ্জিত হন। আমি তাকে নিশ্চয়তা দিয়ে বললাম "কোন ভয় নেই...প্রতিদিন নামাজের মোনাজাতে চাইবেন দেশের তাবৎ এস্কেলেটর যেন সিঁড়ি হয়ে যায়।"
কথাটা মজা করে এমনি এমনি বলেছিলাম কিন্তু এটা সত্য হয়ে যাবে ভাবিনি। সেই এস্কেলেটর ফোবিয়ায় আক্রান্ত আত্মীয়া ঈদের শপিং করে এসে অত্যন্ত খুশী হয়ে আমাকে একটা ধন্যবাদ দিলেন। তিনি হেসে বললেন, "এস্কেলেটরগুলো আসলেই চলেনা..."। পরে বুঝলাম সব হলো লোডশেডিং এর কেরামতি। বিদ্যুৎ সাশ্রয় করার জন্য কোন কোন শপিংমলে এস্কেলেটর বন্ধ করে রাখে । দেশের বাকি সবার জন্য লোডশেডিং অভিশাপ আনলেও তাঁর জন্য আশীর্বাদ বয়ে এনেছে
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা সেপ্টেম্বর, ২০০৯ রাত ১১:০৬