গবেষক ফ্যামিলিন কে মারাক তার হবেষনায় গারো বা আচিকদের ১২টি বিশেষ কৃষি বা ফসল সংক্রান্ত উৎসব পালনের কথা বর্ণনা করেন তার গ্রন্থে । ১) আ-আ আপাটটা বা জুমাং সিয়া ২) গিটচিপং আসিরকা ৩) আ-গালমাকা বা গাল-মাক-দআ ৪) সালবাক টাটা বা সালগ্রোআ ৫) ওয়াচি টাটটা বা ওয়াচি সআ ৬) মি আমুয়া বা আ-কিরিটা ৭) রংচৃ গালা ৮) আহাইয়া ৯) নকপান্থে মিসি চাআ ১০) ওয়ানগালা ১১) ওয়াংবাসালা ১২) ওয়াক দআ ।
উপরের তালিকাগুলোর মধ্যে ওয়ানগালাটি যেহেতু বর্তমান সময়ে সবচেয়ে পরিচিত ও জনপ্রিয় আমাদের কাছে তাই এ ওয়ানগালা সম্পর্কিত গবেষনায় যে তথ্য রয়েছে তার আংশিক তথ্য এখানে অনুবাদ করে তুলে ধরছি ।
ওয়ানগালা উৎসবটি সাধারনত ফসল কাটার পর করা হয় যা সেপ্টেম্বর থেকে শুরু করে অক্টোবর পর্যন্ত পালন করা হয় বলে উল্লেখ রয়েছে । এটি গারোদের খুব পরিচিত একটি পর্ব তবে এ ওয়ানগালা মেঘালয়ে কোথাও কোথাও দ্রওয়াংবলা নামেও পরিচিত । বাস্তবে এ উৎসবটি আচিকদের জন্য ঐতিহ্যগতভাবে একটি গুরুত্বপূর্ন উৎসব যা আধুনিক সময়েও একটি জনপ্রিয় উৎসব হিসাবে পালিত হচ্ছে ও কৃষ্টি সংস্কৃতির একটি বিষয় বলে বিবেচনা করা হয় যার কারনে ১৯৭০ সন থেকেই প্রতিবছর আসানাং এ হানড্রেড ড্রামস নামে এ উৎসবটি পালন করে আসছে ।
১) ওয়ানগালা উৎসবের বৈশিষ্ট্যঃ এটি একটি বিশেসভাবে উল্লেখযোগ্য যে, বিভিন্ন অঞ্চলে, বিভিনন্ন গ্রামে, সমাজে এ ওয়ানগালা উৎসবটি বিভিন্ন দিনে ও ভিন্ন ভিন্ন তারিখে পালন হয়ে থাকে । যতদূর সম্ভব প্রতিটি অঞ্চলে বা গ্রামেই আলাদাভাবে তারিখ নির্ধারন করে যেন প্রতিটি অনুষ্ঠানে তারা অংশগ্রহন করতে পারে । যখন ওয়ানগালা পালন করা হয় তখন এই উপস্থিতির বিষয়টি বিশেষভাবে বিবেচনা করা হয় ।
২) ওয়ানগালার উদ্দেশ্যঃ ওয়ানগালা উৎসবের মূল উদ্দেশ্য হলো মিসি সালজয় দেবতাকে ধন্যবাদ ও প্রশংসা জানানোর জন্য করা হয় । ফসল ঘরে তোলার পর এ ফসল মিসি সালজয় দেবতার আশীর্বাদে ভাল হয়েছে বলে বিশ্বাস করার কারনে এই দেবতাকে সন্তোষ্ট করার জন্য, ধন্যবাদ দেয়ার জন্য তা পালন করা হয় ।
৩) ওয়ানগালা সম্পর্কিত আদি তথ্যঃ এ ওয়ানগালা সম্পর্কে গারো/আচিকদেও মধ্যে একটি কাহিনী প্রচলিত আছে । ডি এস রংমথু কয়েকটি সূত্র থেকে উল্লেখ করে বলেন যে মানবজাতি কিভাবে শস্যবীজ উপহার পেয়েছিল তা বিভিন্ন আচিকদেও পৌরাণিক কাহিনী থেকে পাওয়া যায় ।এ কাহিনীটি আচিকদেও কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ন কারন ভাত গারোদের প্রধান খাদ্য ও শষ্য যা বীজ বপন থেকে শুরু করে তা তোলা পর্যন্ত গারোদের জীবন ও অস্তিত্বের সাথে মিশে আছে । তার কাহিনী অনুযায়ী- মিসি সালজং দেবতা অনুগ্রহ করে আনি আগিলপ চিনি সালাপ্প নামের এক মানুষের কাছে ধানের বীজ উপহার প্রদান করে । তাপপর তাকে নির্দেশ দিয়ে ছিলেন ধান রোপন করে তা সংগ্রহ করার পর প্রথম যে ফসল তুলবে তা তার নামে উৎসর্গ করার জন্য । সেই অনুযায়ী মিসি সালজং দেবতাকে সেই মানুষটি প্রথম ফসলকে উৎসর্গ করে । এভাবেই প্রতি বছর উৎসর্গের সময়টি প্রথা হিজসাবে প্রচলিত হয়ে ওয়ানগালা রুপ ধারন করে যা বর্তমানেও পালন করো আসছে ।
আচিকরা এই ধারাবাহিকতায় মিসি সালজং দেবতাকে শ্রদ্ধা জানাতে প্রথম ফসল ধান উৎসর্গ করার পাশাপাশি ভাতের তৈরী বিশেষ বিয়ার/চু পানীয়, আঠালো বিন্নির রান্না করা ভাত ও ধূপ পোড়িয়ে পূজা করে । মিসি সালজং দেবতাকে শ্রদ্ধা জানালে তিনি সন্তোষ্ট হয়ে প্রচুররুপে আশীর্বাদ করে বলে বিশ্বাস করা হয়, যা এখনো ওয়ানগালা উৎসবের মধ্য দিয়ে পালন কওে তা অনুশীলন করা হয় । রংমথুর রেকর্ড অনুযায়ী মিসি সালজং দেবতার উক্তি হলো- ” আমি যখন সাপ্তাহিক বাজার থেকে ফিরবো, তখন তোমাকে ধানের শস্য বীজ উপহার দিবো, ধান পেকে গেলে প্রতিবছর সঠিক মাসে আমাকে নৈবেদ্য দিতে ভুলবেনা সাথে পানীয় ও বলি দিতেও ভুলবেনা আমার জন্য । আমার এই উপহার স্মরণ করে আমাকে স্মরন করতে ও সম্মান জানাতে ভুলনা ।”
টটিং সাংমা নেংমিনজার একটি বই ”আপসান অংআনা” তে লিপিবদ্ধ আছে যে, ধন্যবাদ ও প্রশংসার একটি অনুষ্ফান হলো ওয়ানগালা । সেখানে বলা আছে – মিসি সালজং দেবতা নিজেই ধূপ পোড়াতে নির্দেশ দেন আসি সেগ্রী দতদী পাগড়ী নামক এক বিধবা নারীকে । যখন তার কথামত ধূপ পোড়ানো হলো তিনি খুব সন্তোষ্ট হয়ে বলেছিলেন- সত্যি এটি খুব সুগন্ধযুক্ত, র্স্পশকাতর সুন্দর একটি দৃশ্য যা আমাকে সন্তোষ্ট করেছে । এ শব্দগুলোর মাধ্যমে প্রতীয়মান হয় যে, মানব জাতি তাকে সম্মান করার কারনে তিনি খুব খুশি হয়েছিলেন এবং প্রচুর রুপে আশীর্বাদ করে ফলে ফলবান, প্রাচুর্যবান ও সম্পদশালী করেছিলেন আনি আগিলপ চিনি সালিপপাকে । এই দেবতা আরো বলেন – আমি প্রতিবছর এই সময়ে আবির্ভাব হবো সেই সময় তোমরা আমার নামে প্রথম ফসল উৎসর্গ করবে , আমার নামে ধূপ জ্বালিয়ে ও পানীয় দিবে বলে নির্দেশ করেন ।
এই ধারাবাহিকতায় ও তার নির্দেশ অনুসারে এ উৎসব পালন করার জন্য প্রতীজ্ঞা করে ও প্রতিবছর বিভিন্নভাবে ওয়ানগালা পালন করে আসছে বিভিন্ন জায়গায় ।
৪) কাঁকড়াকে ওয়ানগালায় উৎসর্গের জন্য ব্যবহারঃঅতীতে মিমা কিরি রকিনী শস্যের দেবী যিনি ধান কাটার সময় সামনের ফসল কাটার সময় তিনি মৃত্যুবরন করেছিলেন বলে বিশ্বাস করা হয় এটি একটি আমা রাটটা বা আহাইয়া উৎসব । এটি শস্যদেবীর মরনদিবস পালন করার সময় কাকঁড়া উৎসর্গ করা হতো তখন যার কারনে এখনো এ কাকঁড়া উৎসর্গেও রীতি এখনো কোথাও কোথাও অনুসরন করে বলে প্রচলিত রয়েছে ।
৫) ওয়ানগালা উৎসবের প্রস্তোতিঃ
৬) ওয়ানগালার আচার অনুষ্ঠানঃ প্রথমদিন গ্রামে সবাই যার যার বাড়ীতের নিজের উৎপাদিত ফসল, শাকসবজী, ফলমূল সবকিছুই মিসি সালজং দেবতার জন্য বেদীতে উৎসর্গ করে পরে সন্ধায় নকমার বাড়ীতে জড়ো হয়ে একসাথে ভোজ করে সারারাত আনন্দ ও নাচ গান করে সাথে নিজেদের তৈরী পানীয় জলও গ্রহন করে ।
৭) ধারাবাহিক আনুষ্ঠানিকতাঃ ১ম দিনঃ রুগালা যা মুক্তি বা সাবধীনতার অনুষ্ঠান হিসাবে পালন করা হয় ।
২য় দিনঃ ক) ওয়ান্না স্তিতা গুড়ি জাংগিয়া মানে দেবতার সাথে একটি চুক্তি খ) মিপানচি মেয়ান গোআ, দেবতার সাথে মিলিত হয়ে ভোজ করা গ) সাঁসাত সোআ, দেবতার কাছে ধূপ জ¦ালানোর রীতি ঘ) জল আন-জল ওয়াটটা, দ্বিতীয় বা নতুন নকমার বাড়ীতে দেয়ার রীতি ।
৩য় দিনঃ সালজং রদিলা, সালজয় দেবতার সাথে গান প্রার্থনা করে সময় কাটানো ।
৪র্থ দিনঃ বিসরি বিসরা, আত্নীয় স্বজনের সাথে একসাথে মিলিত হয়ে ভোজ করা ও মাহরী সমাবেশ আয়োজন করা ।
৫ম দিনঃ খ্রাম গাটটা, দেবতাদের নিজ বাসস্থানে পাঠিয়ে দেয়ার অনুষ্ঠান করে এবং যন্ত্রপাতিগুলো যাদের কাছ থেকে নিয়ে ব্যবহার করা হয়েছিল তাদের মালিকের কাছে ফিরিয়ে দেয়া হয় সেদিন ।
৮) ওয়ানগালা উৎসবের রীতিঃ ওয়ানগালা উপলক্ষ্যে গ্রামের সবাই অতিথিসেবার জন্য প্রস্তোত হয় এবং আনন্দের সাথে সবাইকে তারা গ্রহন করে এমনকি অপরিচিত হলেও তাকে আন্তরিকভাবে গ্রহন করে । এদিন মিসি সালজং কে উদ্দেশ্য করে পশু উৎসর্গ করা হয় পাশাপাশি অন্য দেবতাদেরকেও শ্রদ্ধা করা হয় । যেমন – রিসি দেবতা, গয়ড়া-কালকিনি দেবতা, সুসমি সালগিরা ইত্যাদি দেবতা । পশুর রক্তকে তিলটা দিয়ে সুগন্ধিযুক্ত করা হয় তারপর গ্রামের উঠোনের নির্দিষ্ট জায়গায় তা লেপর করা হয় তাছাদা আখিং নকমার ঘরের দেয়ালে, বেড়ায় ও সামনেও রক্ত লেপন করা হয় । এরপর সবাই মিলে ভোজ গ্রহন করে ভাতের তৈরী পানীয় বিয়ার / চু বেদীতে ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি, বাদ্যযন্ত্রগুলোতেও লেপর করা হয় । গ্রামের সবাই , ছেলে মেয়ে যুবক যুবতী নারী পুরুষ একসাথে নকমার বাড়ীতে আনন্দ ও নাচগান করে । সবাই মিলে নিজেদের তৈরী পানীয় গ্রহন করে এদিন ধনী গরীব উচুনীচু কারো কোন ভেদাভেদ নেই ।
৯) বিশ্বাস ও অনুশীলনঃ ওয়ানগালা উৎসব হলো মিসি সালজং দেবতার সাথে মানুষের যে আদিচুক্তি তার একটি অনুষ্ঠান । এদিন দেবতার আশীর্বাদের জন্য ধন্যবাদ দেয়ার দিন যা প্রতিবছর পালিত হয় । আচিক বিশ্বাসীরা কৃতজ্ঞতার চিহ্নস্বরুপ এ ওয়ানগালা পালন করে আর সাংসারেক রা তাদের সাংসারেক বিশ্বাস অনুসারে পদ্ধতি অনুসারে তা পালন করে । এদিন মিসি সালজং দেবতা ও মিমা কিকি রকীম দেবীর কাছে যেন প্রচুর রুপে আশীর্বাদ করে তার জন্য ধূপও জ্বালানো হয় । যদি তা করা না হয় তাহলে মিসি সালজং দেবতা অসন্তোষ্ট হয়ে কঠোর হতে পারে ও শাস্তি দিবে বলে বিশ্বাস করা হয় যাকে আসি মালজা(নামজা) বলা হয় । মনে করা হয় মিসি সালজং দেবতার সাথে অন্যান্য দেবতারাও সেদিন আসে ও তারাও মানুষের সাথে মিলিত হয় । জরুরী অবস্থার জন্য এই দেবতারা প্রয়োজনে বের হওয়ার জন্য তারা সামনের দরজা ব্যবহার না করে পাশের বা পিছনের দরজা ব্যবহার করে । ধূপ জ্জালানোর আগে কোন অতিথিকেই গ্রাম থেকে বের হতে দেয়া হয়না । তাদের আরেকটি বিশ্বাস আছে যে, এ ধূপ সারা ঘরময় , উপরে নীচে আশেপাশে ধোয়ায় ভরপুর করে ধূপ জ¦ালাতে হয় । যদি দেখা যায় যে সারা ঘরময় ধূপের ধোয়ায় ভরে গেছে তাহলে ধারনা করা হয় আগামী বছরে পূর্ন শান্তি ও প্রাচুর্য্যে ভরে থাকবে প্রচুর আর্শীবাদ পাবে । আর যদি এরকম হয় যে, ধূপের ধোয়া ঘরময় না হয়ে পাশ দিয়ে উড়ে চলে যাচ্ছে তাহলে আগামী বছর গ্রামে দুর্দশা দেখা দিবে বলে বা গ্রামে দুর্ভাগ্য হতে পারে বলে ধারনা করা হয় ।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০১৯ বিকাল ৩:৫৫