১৯৭৯’র জানুয়ারি; দীর্ঘ ক্লেশ ভোগ করার পর পলপটের রক্ত লোলুপ স্বার্থান্বেষী চক্রের বিরুদ্ধে কম্বোডিয়ার ফুসে ওঠা জাগ্রত জনতার অভ্যুত্থানের বিজয় সূচিত হয়। কিন্তু এর পূর্ববর্তী ১৩ শত দিন রাত্রি দেশটি তার সমুদয় জনগণকে নিয়ে রক্তের নহরে ডুবে ছিল। সেই সময়টাতে প্রায় তিন মিলিয়ন কম্বোডিয়ান হত্যার শিকার হন। দেশটির অর্থনৈতিক এবং সামাজিক কাঠামো পুরোমাত্রায় ধ্বংস সাধন করা হয়। সাংস্কৃতিক কেন্দ্রগুলো চিরদিনের মতো বন্ধকরে দেয়া হয়।
অপরাধ সংগঠনের জন্য অপরাধী সংগ্রহ
পলপট-ইংসারে দল দেশটির ১৪ থেকে ১৭ বছরের অপরাধ প্রবণ ছেলে মেয়েদের নানান ধরনের প্রলোভন দেখিয়ে দলে ভেড়ায়। কম বয়েসের এইসব ছেলে মেয়েদের হত্যাকাণ্ডে প্ররোচিত করে; যারা তাদের এইসব প্ররোচনায় সাড়া দেয়নি তাদেরকেও নানা রকম ভীতি প্রদর্শন, হত্যার হুমকি দেয়া সহ দলের লোক দিয়ে অত্যাচার করা হতো। তাদের সংগঠিত করা তরুণ প্রজন্মের এই অংশটি ছিল অসম্ভব দুর্নীতি প্রবণ, খুন আর জখমের কাজে এরা খুবই পারঙ্গম আর অভিযোজিত ছিল। এদেরকে পামরসে গাজিয়ে ঘরোয়া মদ এমনকি মানুষের রক্তপানে অভ্যস্ত করে তোলা হয়। এবং তাদের মাঝে ধারনার জন্ম দেয়া হয়, মানুষের রক্ত পান করলে তারা ‘বিশিষ্ট জনে’ রূপান্তরিত হয়ে সবকিছু অর্জনে সক্ষম হবে। এভাবে তরুণ প্রজন্মের একটি অংশকে নিজেদের মন্ত্রপূত করে শাসক গোষ্ঠী বিশেষ চালাকির মাধ্যমে ধারাবাহিকভাবে তাদের ক্রমবর্ধমান নৃশংসতার দিকে ঠেলেদিতে থাকে, আর এভাবেই দেশটির তরুণ প্রজন্মে সঙ্গে পারষ্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে অপরাধী কর্মকাণ্ডের পাপচক্রে নিজেদেরকে পরস্পর বিজড়িত করে তোলে।
উচ্ছেদের পর শহর থেকে বিতাড়ন
ক্ষমতারোহনের প্রথম পর্যায়েই পলপটদল নিজেদের অবস্থান আরো পাকাপোক্ত করার জন্য বিভিন্ন ধরনের চাতুরীর আশ্রয় গ্রহণ করে এবং শহরের জনগণকে গ্রামাঞ্চল ও পার্বত্য এলাকার দিকে সরে যেতে বাধ্য করে। জনগণের ওপর বিশাল ধ্বংসযজ্ঞ চালাবার লক্ষনিয়ে কাজ শুরু করে।
এটি ছিল সুচতুর ভাবে তৈরি একটি নীতিপরিকল্পনা। ১৯৭৫ সালে এই পরিকল্পনাটি উচ্চ পর্যায়ের পলপট ক্যাডারদের আরো উচ্চতর প্রশিক্ষণের সারগ্রন্থ তথা ম্যানুয়াল হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে। এর মাধ্যমে, আপামর জনগণকে বাস্তুচ্যুত করে স্থানান্তরের নীতি যে ৭০ পরবর্তী কালে পলপট গংয়ের পরিকল্পিত ছিল সেই সত্যটিই সবার কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই সিদ্ধান্তের ফলে, পলপট বাহিনী ক্ষমতারোহনের পরপরই যত শীঘ্র সম্ভব শহরের কেন্দ্রস্থল থেকে জনসাধারণকে উচ্ছেদ করে অন্যত্র তাড়িয়ে দিতে থাকে।
রাজধানীতে বসবাসকারী লোকজন সম্বন্ধে দলিলটিতে বলা হয়, নমপেনের ৯৫ শতাংশের স্থানান্তর ইচ্ছাকৃত। বাস্তুচ্যুত এই লোকদের খালিহাতে “মুক্ত” অঞ্চলের দিকে পালাতে হয়, আর বাকিদের ব্যক্তিগত প্রভাব প্রতিপত্তি সর্ব নিম্নপর্যায়ে নামিয়ে আনা হয়।
নাগরিক উচ্ছেদের পলপট গংয়ের ব্যাখ্যা
দুর্ভিক্ষ এড়াবার কৌশল হিসেবে নমপেনের অতিরিক্ত লোক অন্যত্র সরিয়ে দেয়া হয়েছে, সর্বসাধারণের গণহারে বাস্তুচ্যুতিকে পলপটের সাঙ্গপাঙ্গরা এভাবেই ব্যাখ্যা দিতে থাকে। তারা সবাইকে বলতে থাকে এই বিশাল জনসংখ্যাকে খাওয়াপরা জোটাবার মতো খাদ্য সহ অন্যান্য রসদপাতির মজুদ ও সরবরাহ সরকারের নেই। এব্যাপারে অন্য আরো একটি কারণ দেখানো হয় আর তা হলো এর মাধ্যমে সরকার হটিয়ে দেবার ষড়যন্ত্র মূলক প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দেওয়া সম্ভব হয়েছে।
সাধারণ জনগণ উচ্ছেদের সত্যিকার কারণ
নিরীহ জনসাধারণকে বাস্তুচ্যুত করে অসহায় অবস্থায় অন্যত্র সরিয়ে দেবার কারণ আসলে পুরোপুরি ভিন্নধর্মী কিছু। আর সেই কারণটি ট্রাইব্যুনালের সামনে উপস্থাপিত অসংখ্য দলিল দস্তাবেজ থেকে অনুমান করা সম্ভব ছিল। শহর জুড়ে শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তির ফুঁসে ওঠাই ছিল আসলে এর মূল কারণ। নমপেনের বিশাল জনতাকে তৃতীয় শ্রেণীভুক্ত করা আদতেই কোন আকস্মিক দুর্ঘটনা ছিলনা, আর এজন্যই এদের সমূলে ধ্বংস করে দেবার জন্য চিহ্নিত করা হচ্ছিল।
নিরঙ্কুশ ভাবে দেশের ক্ষমতা কুক্ষিগত করার পরপরই পলপট-ইংসারে গংয়েরা শাসক শ্রেণীর প্রতি তাদের স্ব স্ব আনুগত্য অনুসারে জনগণকে তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করে। প্রথম ভাগে ঠাই পায় কম্বোডিয়ার তথা সেখানকার প্রত্যন্ত পাহাড়ি অঞ্চলের লোকজন। এদের “ওল্ড পপুলেশন” নামে অভিহিত করা হয়। দ্বিতীয় ভাগে ঠাইপায় সেখানকার পূর্ববর্তী সরকারের অধিভুক্ত জেলা সমূহে বসবাসকারী লোকজন। এদের “নিউ পপুলেশন” বা নব্য জনতা নামে অভিহিত করা হয়। আর তৃতীয় শ্রেণীতে ফেলা হয় সাধারণ চাকুরে সহ প্রশাসন যন্ত্রের অফিসার ও তাদের পরিবার বর্গ এবং রাজধানী নমপেনের অধিবাসীদের। শেষোক্ত এই অংশের সবাইকে গণহারে হত্যাযজ্ঞের লক্ষবস্তু হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। আর “দ্বিতীয় শ্রেণীভুক্ত” জনগোষ্ঠী ছিল বিশোধনের বিষয়বস্তু। পলপট গোষ্ঠী এদের ব্যাপারে এমন সব কৌশল অবলম্বন করে যাতে জনতার এই অংশটিকেও ব্যবহারিক ভাবে ধ্বংস করে ফেলা সম্ভব হয়। “প্রথম শ্রেণীভুক্ত” জনগণ প্রথম প্রথম বেশ কিছু সুযোগ সুবিধা ভোগ করলেও এবং প্রচণ্ড নিরাপত্তার সঙ্গে জীবনযাপন করলেও, ৭৭’এর পর থেকে এদের সবাইকে অবাঞ্ছিত মুক্ত করণ নীতির মুখোমুখি হতে হয়। এবং এরই সূত্র ধরে এদের হাজার হাজার লোককে হত্যার শিকার হতে হয়।
উচ্ছেদ অতঃপর নির্বিচারে হত্যা
১৯৭৫, ১৭ই এপ্রিল নমপেনএ পলপট সৈন্যবাহিনী প্রবেশ করে। এর কিছু দিনের মধ্যে শহরের অন্তত দুই মিলিয়নেরও অধিক নাগরিককে উচ্ছেদ করা হয়। এদের সবাইকে শহরের বাইরে অন্য কোথাও চলে যেতে বাধ্য করা হয়। খাদ্যদ্রব্য বা কোন প্রকার অস্থাবর সম্পত্তি সঙ্গে বহন না করে সকল আবাসিক লোকেদের অতিসত্বর শহর ত্যাগ করার এক আদেশ জারি করা হয়।
যারাই এই আদেশ মানতে নুন্যতম অনীহা প্রকাশ করেছে বা স্ব স্ব স্থান ত্যাগে খানিক সময় ক্ষেপণ করেছে, তাদের সবাইকে অত্যন্ত নৃশংসভাবে বেত্রাঘাত বা গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। বৃদ্ধ, অথর্ব, সন্তান সম্ভাবা নারী এবং হাসপাতালের যে কোন রোগী; সবার সঙ্গে এই একই আচরণ করা হয়েছে। ঝড়, বৃষ্টি অথবা প্রখর রোদে তেতে ওঠা আবহাওয়ার তোয়াক্কা না করে সবাইকে মাইলের পর মাইল হাটতে হয়েছে। এসময় পথিমধ্যে প্রতিটি ঘাঁটিতে তাদেরকে উপর্যুপরি তল্লাসি করা হয়, যাতে গন্তব্যে পৌঁছার পর কারো সঙ্গে কোন কিছু অবশিষ্ট না থাকে। পথে বিতাড়িত এইসব অসহায় শহরবাসীকে সেসময় খাদ্য, পানীয় বা ওষুধ কোন কিছুই দেয়া হয়নি। এদের স্বাস্থ্য তাই ভয়াবহ পর্যায়ে উপনীত হয়। পোশাক পরিচ্ছেদ অথবা চাল, ডাল, মাছ অথবা লবণ জাতীয় যে কোন কিছু স্থানীয়দের সঙ্গে অদল বদলের যে কোন ধরনের প্রচেষ্টা ছিল খুবই দোষনীয়, ধরা পরলে এধরনের অপরাধের কারণে অপরাধীকে সরাসরি গুলি করা হত।
নমপেনের উচ্ছেদের শিকার জনতা মেকং অববাহিকার যে দীর্ঘপথ হেটে দূরবর্তী জেলা গুলোয় পারি জমায়, দীর্ঘ সেই পথের মাঝেই অবর্ণনীয় ক্লেশ ভোগকরে মৃত্যু বরণ করে প্রায় পাঁচ লাখ লোক।
নমপেন শহরের মতই অন্যান্য শহর গুলোর জনগণকেও একই ধরনের দুঃখ দুর্দশা ভোগ করতে হয়।
সাধারণ জনগণকে উচ্ছেদের ফলাফল
সাধারণ জনগণকে উচ্ছেদ ও বিতাড়নের মতো কাজগুলো করা হয়েছিল বিদ্যমান সামাজিক বন্ধন সমূহ দুর্বল করে দেবার জন্য। যাতে পলপট-ইংসারে গোষ্ঠীর অবিরাম রক্তলোলুপ ঘাত-প্রত্যাঘাতের জবাবে সাধারণ জনতা কোন ভাবেই নিজেদের সংগঠিত করার সুযোগ না পায়। সেই প্রক্রিয়া যাতে পুরো মাত্রায় বন্ধকরে দেয়া যায়।
জনগণের এই উচ্ছেদের বিষয় ও তার ফলাফল উল্লেখ করে পলপট শাসক গোষ্ঠীর বিভিন্ন পর্যায়ে একটি দলিলের সারগর্ভ বিলি করা হয়: “যে সব লোক খালিহাতে বাড়িঘর ছেড়েছেন, এখন থেকে তারা কমিউনেই থাকবেন। এর মানে হলো আমরা পূর্ববর্তী রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করতে সক্ষম হয়েছি। এবং জনগণকে গ্রামে ফিরে যেতে বাধ্য করেছি। কালক্রমে এই পদ্ধতি তাদেরকে সম্পূর্ণ ধ্বংসের মুখোমুখি করবে।”
কমিউন গঠন করে দুঃশাসন প্রতিষ্ঠা
পলপটের তথাকথিত “কমিউন” গঠনের নীতি ছিল মাও জে দং কর্তৃক অনুমোদিত। ১৯৭৫ এর জুনে পলপটের সঙ্গে কথোপকথনের একপর্যায়ে মাও বলেছিলেন: “কেবল একটি ফুঁৎকারে আমরা শ্রেণী বৈষম্য দূর করার ক্ষেত্রে চমৎকার সাফল্য অর্জনে সক্ষম হয়েছি। গ্রামে দারিদ্র এবং নিম্নমধ্যবিত্ত বর্গাচাষী কমিউনে পরস্পর মিলেমিশে থাকবে। তারাই আমাদের ভবিষ্যত।”
তথা কথিত এই “কমিউনের” সরূপ আসলে কি ছিল ? স্থানীয় জনগণের প্রতি তাদের আচরণ ছিল সুনির্দিষ্টভাবে অসম্মান জনক। তাদের স্বাস্থ্য এবং বয়সের ব্যাপারে এরা ছিল একেবারেই উদাসীন। কমিউনের সেবা দেবার নাম করে এরা ছেলে বুড়ো সবাইকে দিনে ১২ থেকে ১৬ ঘণ্টা কাজ করতে বাধ্য করতো। দশ বছরের বেশী, বৃদ্ধ এবং অসুস্থ সবাইকেই পূর্ণবয়স্ক লোকের মত পরিশ্রম করতে হতো। ছয় বছরের বেশী বয়সের শিশুদের তাদের বাবা-মায়ের কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হতো।
কমিউনে কাজ করার একমাত্র পারিশ্রমিক ছিল যৎসামান্য রেশন। নিত্তনৈমেত্তিক কাজের পাশাপাশি, কমিউনের সদস্যদের তথাকথিত “সোশ্যালিস্ট” বা সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক হতে বাধ্যকরা হতো। প্রতিদিনের রুটিন কাজের অবসরে এতে অংশগ্রহণ করতে হয়। কমিউনের সদস্যরা সব সময় গোপন দালালের নজরদারির মধ্যে থাকত। এদের যারা স্বাধীন আচরণ করত, তাদের বিরুদ্ধে যে কোন ধরনের অভিযোগ বা তাদের প্রতিবাদের ফলাফল ছিল “সন্দেহ ভাজন ব্যাক্তি” এবং “বিরোধী পক্ষ” হিসেবে তালিকা ভুক্ত হওয়া এবং খতম হওয়ার জন্য চিহ্নিত হয়ে যাওয়া।
কমিউন জীবন এবং যুদ্ধরত জনতার ওপর তার প্রভাব
নির্মম পুলিশি নিয়ন্ত্রণ জনগণের মুক্ত চিন্তা চেতনায় প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করে। মুক্তভাবে ভাবার, হাসি, কান্না এমন কি আপন জনের জন্য শোক করার অধিকারও তাদের ছিলনা। যে কোন ধরনের হতাশা, করুণা বোধ, অনুরোধ; এসবের সব কিছুকেই অসন্তুষ্টি প্রকাশের চিহ্ন হিসেবে ধরে বিরোধী পক্ষ বলে গণ্য করা হতো। এমনকি সবার চেহারার ভাবভঙ্গী পর্যন্ত দালালেরা নথিভুক্ত করে রাখত। এবং যে কোন প্রকার দুঃখ, কাতরতা এবং অসহিষ্ণুতা সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তিকে মৃত্যুর দুয়ারে ঠেলে দেবার জন্য যথেষ্ট ছিল।
কমিউনের অভ্যন্তরে সুনিয়ন্ত্রিত উপায়ে সামাজিক বন্ধন গুলোকে ধ্বংস করে দেয়া হতে থাকে। বিবাহিত দম্পতিকে পরস্পর থেকে আলাদা করে দেয়া হয়, শিশুদের তাদের বাবামা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়, প্রতিবেশীদের মাঝে যে কোন ধরনের যোগাযোগ ও আদান প্রদান নিষিদ্ধ করা হয়। মানুষের মাঝে সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে এমন সব মাধ্যম গুলো যেমন: বাজার, টেলিফোন, পোস্ট অফিস এর মত সবধরনের যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ করে দেয়া হয়।
পরিবার এবং পরিবারের মাঝে সুন্দর সম্পর্ক পলপট খুনিচক্র অত্যন্ত সুপরিকল্পিত ভাবে বিভিন্ন উপায়ে ধ্বংস করে দেয়। ক্ষমতাসীন দল বিবাহিত দম্পতিদের মাঝে, পিতামাতা এবং সন্তানের মাঝে বিরূপ সম্পর্ক সৃষ্টিতে তাদের কার্যক্রম নির্দেশিত করে। স্বামী স্ত্রীকে জোর করে পৃথক থাকতে বাধ্য করা হয় এবং জনগণকে একে অন্যের থেকে আলাদা রাখার জন্য দূরে কাজে পাঠান হয়। এসময় তাদেরকে পরস্পরের মুখ পর্যন্ত দেখতে দেয়া হতো না। বিপদে সাহায্যে এগিয়ে আসতে দেয়া হতো না। সমবেদনা জানাতে কিংবা মৃতের জন্য কোন প্রকার শোক করতে পর্যন্ত দেয়া হতো না।
লোকজন অন্যের সাহায্যে এগিয়ে আসতে ভীত হয়ে পড়ত, নিজের জীবন রক্ষায় কমবেশি সবাই ছিল ব্যতিব্যস্ত। যাদের পিতামাতাকে ইতোমধ্যে হত্যা করা হয়েছিল সেই সব অসহায় সন্তান সন্ততিদের সাহায্য সহযোগিতায়ও সবাই ছিল ভীত। ভয়, পাছে না আবার এতে শত্রুর প্রতি সহানুভূতি দেখাবার অভিযোগ আনা হয়। একারণে অনেক এতিমকে কমিউনেই অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এদের সবাই তাই ছিন্নমূল জীবন বেছে নিতে বাধ্য হয়। এধরনের শিশুরা ভিক্ষাবৃত্তির অভিযোগে পাকরাও হলে প্রচণ্ড মারধরের পর প্রায়ই মেরে ফেলা হতো।
১৪ হতে পনর বছর বয়সের বালক বালিকাদের তথাকথিত “ভ্রাম্যমাণ উৎপাদন ব্রিগেড” অথবা সৈন্য দলে প্রবেশন ঘটান হতো। পলপট গোষ্ঠী বিশ্বাস করতো অন্ধের মতো যে কোন আদেশ নির্দেশ পালনের উপযোগী সৈনিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য এটিই সর্বোত্তম বয়স।
চিকিৎসা সেবার ওপর হামলা
হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম আর অপুষ্টির সমন্বয়ে নানান রোগের বিস্তার ঘটতে থাকে। কিন্তু সেসবের মোকাবেলায় নূন্যতম চিকিৎসা সেবাও পরিলক্ষিত হয়নি। অশুভ তৎপরতার মাধ্যমে দেশটির চিকিৎসা ব্যবস্থা পুরোপুরি ধ্বংস করে দেয়া হয়। যুদ্ধ শেষে সেখানকার ৬৮৩ জন চিকিৎসক এবং ফার্মাসিস্টের মধ্যে মাত্র ৬৯ জন বেঁচে ছিলেন। সেই সময় কেবল ম্যালেরিয়া এবং মূর্ছা যাওয়াকে অসুস্থতা হিসেবে গণ্যকরা হতো। অন্যান্য অসুস্থদের অলস বা বিদ্রোহী বলে দোষারোপ করা হতো। এবং এই কারণে প্রায়শই নির্যাতনের মাধ্যমে নিহত হবার বিষয়টিকে বুঝে ওঠা সম্ভব ছিলোনা। গর্ভাবস্থাকে কাজ থেকে নিষ্কৃতি পাবার অজুহাত হিসেবে মনে করা হতো এবং অন্তঃসত্ত্বা মহিলাদের কম পরিমাণে খাবার দেয়া হতো।
প্রসব পূর্ববর্তী বা পরবর্তী ছুটি বলে কোন কিছুই ছিলোনা। সন্তান জন্মদানের কয়েক মাসের মাথায় মায়েদের কাজে যোগদানে বাধ্যকরা হতো। যথাসময়ে কর্মস্থলে রিপোর্ট করতে ব্যর্থ হলে অন্তর্ঘাতী হিসেবে চিহ্নিত করা হতো।
পলপট শাসকের এমন সব ডাক্তার ছিল যাদের আদৌ চিকিৎসা সম্বন্ধীয় কোন প্রশিক্ষণ ছিল না। এদের অনেকেই আবার ছিল পুরোপুরি অশিক্ষিত। এইসব ডাক্তারদের মূল ওষুধ ছিল নারিকেলের নির্যাস, গাছের ছাল এবং বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকারক রসায়নের দ্রবণ। এধরনের ডাক্তার এবং ওষুধ দিয়ে কেমন তরো চিকিৎসা সম্ভব তা যে কারো পক্ষেই অনুমান করা সম্ভব।
কমিউন বিরোধীদের শাস্তির ধরন
“জনতার কমিউন”এর অসংখ্য নিয়ম কানুনের যে কোন প্রকার বরখেলাপে ভয়ানক শাস্তি মাথাপেতে নিতে হতো। এক্ষেত্রে কেবল দুই ধরনের শাস্তির বিধানই লক্ষ্য করা যায়: রেশন কমিয়ে দেবার সঙ্গে প্রত্যহিক কাজের পরিমাণ দ্বিগুণ বা তিনগুণ বাড়িয়ে দেয়া। এবং একই সঙ্গে উপর্যুপরি প্রহার। অথবা বিকল্প হিসেবে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা।
ধর্ম সংস্কৃতি এবং সামাজিক ঐতিহ্যে ওপরে হামলা
কম্বোডিয়ার জনগণের নব্বই শতাংশই ছিল বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত। সাধারণের মাঝে বৌদ্ধধর্মের এই ব্যাপক গ্রহণ যোগ্যতার কারণে, বিশেষ করে গ্রাম্য জনপদ গুলোতে বুদ্ধত্ব কেবল মানুষের কাছে ধর্মই নয় বরং এটি তাদের সংস্কৃতিতে নিবিড় ভাবে মিশে ছিল। ফলে এই বৌদ্ধধর্মটিকে ধ্বংস করার চেষ্টার মাঝে শাসক গোষ্ঠী বিশেষ মানে খুঁজে পায়। এবং এরই মাধ্যমে জনগণের বহুদিনের লালিত সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়া হয়।
পলপট-ইংসারে গোষ্ঠীর লেলিয়ে দেয়া নির্মম প্রচারণায় কম্বোডিয়ার ২৮০০টি প্যাগোডার সব গুলিই ধ্বংস প্রাপ্ত হয়। অনেক প্যাগোডাকে গম এবং সারের ভাণ্ডর সহ কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প এবং বন্দীশালায় রূপান্তর করা হয়। এই তাণ্ডবের কারণে ৮২ হাজার বুদ্ধ ভিক্ষুর মধ্যহতে ক্ষুদ্র একটি অংশ প্রাণ রক্ষাকরতে সক্ষম হয়। সেসময় ভিক্ষুদের স্বাভাবিক ধর্মীয় পোশাক পরার অনুমতি ছিলনা। এদের সবাইকে জোর পূর্বক কমিউনে গায়ে গতরে খাটানো হয়। এসময় বুদ্ধের স্মরণে মুরগি জবাই এবং মাংস খাওয়াকে নৈতিক অপরাধ হিসেবে গণ্যকরা হয়। এই মর্মে আইনি আদেশও জারি করা হয়। পলপট খুনি চক্রের এই আদেশ অমান্য করার একটাই শাস্তি; আর তা হলো মৃত্যুদণ্ড।
বৌদ্ধধর্মের সকল বই পুস্তক ধ্বংস করে ফেলা হয়। একই সঙ্গে সাধারণ ধর্মপ্রাণ জনগণকে আশ্রমের যে কোন আদেশ নিষেধ আর রীতিনীতি পালন করতে নিষেধ করা হয়।
সংখ্যালঘু মুসলমানদের উপর নির্যাতনের চিত্র
কম্বোডিয়ার একটি জাতীয় সংখ্যালঘু গোষ্ঠী চ্যাম। এরা মূলত শান্তির ধর্ম ইসলামে দীক্ষিত; তাদের এই শান্তির ধর্মও বিলোপ সাধনে সব ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। দেশের ১১৪টি মসজিদের মধ্যে সবগুলোকেই অধঃপতিত অথবা ভেঙ্গে দেয়া হয়। এগুলোর কোন কোনটিকে শূকর খানায় রূপান্তরিত করা হয়। আর বাকি গুলোকে বোমা মেরে উড়িয়ে নতুবা বুলডোজারের সাহায্যে গুড়িয়ে মাটিতে মিশিয়ে দেয়া হয়।
চ্যাম গোষ্ঠীকে সমূলে বিলুপ্ত করা হয়। দেশটির মুসলিম অধ্যুষিত কম্পোং চ্যাম প্রদেশে কম্পোং জিম জেলার মোট পাঁচটি গ্রামের সর্বমোট মুসলমান ছিল বিশ হাজারেরও কিছু বেশী। কিন্তু এদের একজনও গণহত্যার পর বেঁচে ছিলনা। অন্যদিকে দেশটির কুং নিয়াস জেলার মোট সাতটি গ্রামে প্রায় বিশ হাজারে জনের মধ্যে প্রাণে রক্ষাপায় মাত্র চারজন।
দেশটির অন্যান্য সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতনের চিত্র
দেশটির অন্যান্য সংখ্যালঘুদের জন্য এই একই ধরনের ভাগ্য নির্ধারিত করা হয়েছিল। কম্বোডিয়ার মোট ১৩টি সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীকে তাদের আদিম পরিচয় চিরদিনের জন্য মুছে ফেলে মূলজাতি সত্তার সঙ্গে আত্তীকৃত হতে বাধ্য করা হয়।
জাতীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সংগঠিত অপরাধের তদন্তে গঠিত কমিশন যে প্রতিবেদন পেষ করে তাতে পলপটের কর্মকাণ্ডের বিস্তারিত উদ্ধৃত করা হয়:
“লোকেদের খেমার জাতির সঙ্গে মিলরেখে নতুন নাম গ্রহণ করতে এবং পুরাতন সব নাম বদলে ফেলতে বাধ্য করা হয় ... নীতিচেতনা, ভাষা, জাতিগত বিশেষত্ব, পোশাক পরিচ্ছেদ, আচার আচরণ, ধর্ম সহ প্রাক্তন সব জাতিয়তাবাদের চিহ্ণ কঠোরভাবে বিলোপ সাধন করা হয়।”
এধরনের যে কোন প্রকার আদেশ মানতে অসমর্থ হলে নির্মম শাস্তি পেতে হতো। উত্তরপূর্বাঞ্চলের বিশ সহস্রাধিক লোককে স্ট্রং ট্রেং শহরের অদূরে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এদের মাঝে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে অংশ নেয়া লেও জাতিগোষ্ঠীর সামরিক, গেরিলা দলের সদস্য সহ বেসামরিক ব্যাক্তিবর্গও রয়েছে।
বুদ্ধিজীবী হত্যা এবং পশ্চিমা বিদ্বেষ
দেশটির বুদ্ধিজীবীদের সমূলে হত্যা করা হয়: ডাক্তার, চিকিৎসক, শিক্ষক, প্রকৌশলী, শিল্পী, শিক্ষাবিদ, এবং পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত ছাত্রদের দেশটির শাসন ব্যবস্থার স্থায়ী শত্রু হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়। ১৯৭৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর দেশটির পূর্বাঞ্চল জুড়ে পলপট গোষ্ঠীর এমনই এক সিদ্ধান্তের ব্যাপারে নিদর্শনা প্রচার করে। এতে জানানো হয়-নেতৃবৃন্দের কাছে স্পষ্ট হয়েছে যে পূর্বেকার রাষ্ট্রের কার্যক্রমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক, প্রকৌশলী, শিল্পী, শিক্ষাবিদ, চিকিৎসক এদের সবার প্রতি বৈপ্লবিক নজরদারি বর্ধিত করা প্রয়োজন, কেননা দল এদের বর্তমান প্রশাসনিক কাজে ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। এসময় বিশ্বাস করা হতো যে এদের জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতা যদি প্রযুক্তির উন্নয়নের কাজে ব্যবহার করা হয় তাহলে রাষ্ট্র যন্ত্রের মাঝে শত্রু পক্ষের প্রবেশের সুযোগ তৈরি হবে; এতেকরে এরা কর্তৃপক্ষের জন্য ভয়াবহ ঝুঁকি বয়ে আনতে পারে।
শহুরে জনগণকে উচ্ছেদ কালে পলপট গোষ্ঠী এদের পুনঃশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ না দেবার অজুহাতে বুদ্ধিজীবীদের গ্রামে বসতি স্থাপনে বাধ্য করে। অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার স্বার্থে বুদ্ধিজীবীরা তাদের পরিচয় ও শিক্ষাগত যোগ্যতা গোপন করতে বাধ্য হয়।
চশমা পরিহিত, পড়ুয়া, বিদেশি ভাষাজ্ঞান সমৃদ্ধ, ভদ্র সাজ পোশাক বিশেষ করে ইউরোপীয় ফ্যাশনের যে কাউকে বুদ্ধিজীবী হিসেবে নিরূপণ করা হতো।
এই নীতির কারণে ৭২৫ জন অধ্যাপক এবং সহকারী অধ্যাপকের মধ্যে বেঁচে থাকা মাত্র ৫০ জনের মাধ্যমে দেশটির উচ্চশিক্ষা পুনঃস্থাপিত হয়। এগার হাজার ছাত্রের মধ্যে মাত্র ৪৫০ জন প্রাণে রক্ষা পায়। ২৩০০ জন মাধ্যমিক শিক্ষকের মধ্যে মাত্র ২০৭ জন অবশিষ্ট থাকে। ১০৬,০০০ জন মাধ্যমিক ছাত্রের মধ্যে মাত্র ৫৩০০ জন প্রাণে রক্ষায় সক্ষম হয়। ২১,৩১১ জন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকের মধ্যে ২৭৯৩ জন পানে বাঁচতে সক্ষম হন। প্রাথমিক স্কুল গুলোর মোট ছাত্র সংখ্যা ছিল ৯৯১,০০০ জন। যাদের মধ্য থেকে মাত্র ৩২২,৩৭৯ টি শিশু বেঁচে থাকে।
উচ্চাঙ্গ ও ব্যালের ১৯৫ জন নৃত্য শিল্পীর মধ্যে ১৪৭ জন প্রাণে বাঁচে। দেশটির ১,৩৪১ জন শিল্প কর্মীদের মাত্র ১২১ জন মানে দশভাগেরও কম সংখ্যক টিকে থাকে।
তিনশত জন সাংবাদিক এবং ছাপাখানা কর্মীর পাঁচজন মাত্র রেহাই পায়।
প্রবাসী নির্যাতন
বিদেশের মাটিতে অবস্থান করা দেশপ্রেমী বুদ্ধিজীবী কম্বোডিয়াদের অনুভূতি নিয়েও পলপট গোষ্ঠী সুচতুর খেলায় মাতে। দেশের পুনর্বাসনের কাজে অংশ গ্রহণের জন্য তাদের সবাইকে দেশে ফেরার আমন্ত্রণ জানানো হয়। প্রায় একহাজার প্রবাসী জনতা সরকারের এই আহবানে সাড়া দিয়ে দেশে ফিরে আসে। তাদের সবাইকে বিভিন্ন অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করে কঠোর পরিশ্রমের শাস্তি দেয়া হয়। এবং এক পর্যায়ে এদের সবাইকেই হত্যা করা হয়।
জাতীয় সংস্কৃতির ধ্বংস সাধন
কম্বোডিয়ার জাতীয় সংস্কৃতির বস্তুগত ভিতের পুরোটাই খুনি চক্রের হাতে ধ্বংস হয়। নমপেন থিয়েটার প্রাদেশিক কেন্দ্র গুলোর থিয়েটার, যাদুঘর, সিনেমা হলের মতো শিল্প, সাংস্কৃতিক কেন্দ্র সমূহ গুড়িয়ে দেয়া হয়। টেলিভিশন আর খেলার মাঠের চিহ্ন মুছে ফেলা হয়। একইভাবে চারুকলা বিশ্ববিদ্যালয়, নাটক ও সঙ্গীত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, লাইব্রেরি সমূহের অস্তিত্বও বিলোপ সাধন করা হয়। বাদ্যযন্ত্র, ঐতিহ্যবাহী মঞ্চের পোশাক এবং শিল্প বিষয়ক যে কোন প্রকার প্রকাশনা নিষিদ্ধ করা হয়। স্কুল ঘরগুলোকে গুড়িয়ে দেয়া হয় নতুবা কারাগার, পীড়ন কেন্দ্র অথবা গম আর সারের গুদামে রূপান্তরিত করা হয়। লাইব্রেরি, শিক্ষা ও গবেষণা কেন্দ্র হতে পাওয়া সকল বই এবং যাদুঘরে প্রাপ্ত প্রদর্শনীয় সকল বস্তু আর সংগ্রহ ধ্বংস করে ফেলা হয়। এবং প্রাচীন অমূল্য সব শিল্প সংগ্রহ এই সময় চুরি হয়ে যায়।
১,২২৫টি স্থাপত্য নিদর্শন সহ দেশের অর্ধেকের বেশী ঐতিহাসিক স্মৃতি স্তম্ভ ধ্বংস করে ফেলা হয়। বিশ্ব বিখ্যাত স্থাপত্য নিদর্শন এঙ্কর ওয়াট এবং এঙ্কর থম গুড়িয়ে দেয়া হয়।
বন্দী হত্যাযজ্ঞ
কম্বোডিয়ার কারাগার গুলোকে মৃত্যুপুরীতে রূপান্তরিত করা হয়। এগুলোর মধ্যে নমপেনের কুখ্যাত টউল স্লেং কারাগার সবচাইতে জঘন্য নজির স্থাপন করে। সেখানে প্রায় দশহাজারেরও অধিক কয়েদিকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। পলপট বাহিনী রাজধানী হতে পশ্চাদপসরণের আগে জেলখানায় বন্দী অবশিষ্ট কয়েদিদের হত্যা করে। সেখানকার মাত্র আটজন প্রাণে বাঁচে যার চারটিই আবার শিশু।
গণহত্যার ধরন
উপরে তুলে ধরা এই বিশদ বর্ণনায় যে সমস্ত হৃদয় বিদারক তথ্য উঠে এসেছে, সেসবের পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে পলপট খুনিচক্র বিভিন্ন আদলে দেশটিতে নির্বিচারে গণহত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। এই হত্যাকাণ্ড অত্যন্ত জঘন্য উপায়ে সংগঠিত হয়েছে। পরবর্তীতে যুদ্ধাপরাধের শাস্তি নিশ্চিত করতে গঠিত ট্রাইব্যুনালের বিভিন্ন সাক্ষীর জবানবন্দী এবং জেরায় সেটাই উঠে এসেছে। সেখানে আগ্নেয় অস্র, নিড়ানি, ধাতব দণ্ড দিয়ে, জীবন্ত মাটিতে পুঁতে ফেলে, আগুনে দগ্ধকরে, কুমিরের খাদ্য হিসেবে ব্যাবহার করে ইত্যাদি বহুবিধ উপায়ে নিরীহ জনগণকে হত্যার মাধ্যমে: সেখানে শারীরিক গণহত্যা চালানো হয়, বিবাহ নিষিদ্ধ করে, বিবাহিত দম্পতিদের পৃথক করে, অবিবাহিতদের একত্র বাসে বাধ্য করার মধ্যদিয়ে: সেখানে জীবতাত্বিক গণহত্যা চালানো হয়। জাতীয় সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, শিক্ষা ব্যবস্থা, চিকিৎসা সেবা এবং জাতীয় অর্থনীতির ভীত ধ্বংস করে দিয়ে এবং একই সঙ্গে সংখ্যা গরিষ্ঠের ভাষা ব্যবহার নিষিদ্ধ করার মাধ্যমে সেখানে জাতীয় সাংস্কৃতিক গণহত্যা পরিচালনা করা হয়।
যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনাল গঠন এবং ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধের বিচার
৫১ই জুলাই ১৯৭৯, কম্বোডিয়ার পিপলস রেভ্যুলেশনারি কাউন্সিল কর্তৃক জারি করা এক আদেশ বলে পিপলসরেভ্যুলেশনারি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। উক্ত ট্রাইব্যুনালের তদন্তকৃত দলিলাদি হতে নমপেনের জনগণের বিরুদ্ধে শাসক গোষ্ঠীর প্রতিহিংসার মাত্রা অনুমান করা যেতে পারে।
বিচার এবং অবশেষে অপরাধের শাস্তি
বিজয়ী জনতা অব্যহতভাবে গণহত্যার জন্য দায়ী ব্যাক্তিবর্গের কৃতকর্মের উপযুক্ত শাস্তি দাবি করতে থাকে। পলপট এবং ইংসারের বিরুদ্ধে কম্বোডিয়া রাষ্ট্রের ক্ষমতা জবরদখল এবং দেশটিতে তাদের সন্ত্রাসী কার্যকলাপের যন্ত্রে পরিণত করার অভিযোগ আনা হয় (পরবর্তীতে তাদের অনুপস্থিতিতেই মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়)। নিজেদের অশুভ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য কম্বোডিয়ার এই বিশ্বাস ঘাতকের দল দেশে গণহত্যা পরিচালনার উদ্দেশ্যে অবৈধ সন্ত্রাসী আদেশ বাস্তবায়নে দলটিকে নির্মম কসাইতে রূপান্তরের প্রশিক্ষণ প্রদান করে। ক্ষমতা কালীন পলপট-ইংসারে দল কম্বোডিয়ায় নজিরবিহীন অপরাধ সংগঠনের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে।
নমপেনএ বিপ্লবী জনতার ট্রাইব্যুনাল পরিচালিত সাক্ষীদের সাক্ষ্য প্রমাণ ও সত্যাসত্য বিশ্লেষণে পলপট-ইংসারে দলের গণহত্যযজ্ঞ সংশ্লিষ্টতা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়।
১৯ আগস্ট ১৯৭৯ এ বিপ্লবী জনতার আদালত (People’s Revolutionary Tribunal) দোষীদের বিচারের রায় ঘোষণা করে। কম্বোডিয়ার পিপল’স রেভ্যুলেশনারি ট্রাইব্যুনাল অপরাধীদের দোষী সাব্যস্ত ও একই সঙ্গে বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি ঘোষণা করে। ইতিহাস নিজেও এইসব জঘন্য অপরাধী তথা পলপট-ইংসারে খুনি গোষ্ঠীর প্রতি বিশ্বব্যাপী অবিরাম ধিক্কার উচ্চারণের সুযোগটি জিইয়ের রেখে কলঙ্কিত এই খুনি শাসক গোষ্ঠীর শাস্তি নিশ্চিত করেছে।
আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের চাটুকার সাম্রাজ্যবাদী অংশ থেকে রক্ত লোলুপ এই ক্ষমতাসীন চক্রটিকে রক্ষায় প্রচণ্ড চাপ এবং চেষ্টা অব্যাহত রাখা হয়। তারা থাইল্যান্ডে অবস্থিত পলপট খুনিচক্রকে অস্র, সামরিক প্রশিক্ষণ এবং খাদ্য সরবরাহ করে। এরপর এদের পুনরায় দেশটির জনতার ক্ষমতারোহনের বিরুদ্ধে সশস্র যুদ্ধে লড়ার জন্য লেলিয়ে দিতে কম্বোডিয়ার মূল ভূখণ্ডে প্রেরণ করতে থাকে।
গণকম্বোডিয়ার বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদীরা নতুন করে ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে, এবং সাম্রাজ্যবাদী সমর্থন পুষ্ট খেমারদের বিরুদ্ধে শুভইচ্ছা সমৃদ্ধ জনতার সীমাহীন ঘৃণা এবং অসহিষ্ণুতা ক্রমেই বাড়তে থাকে।
তথ্যসূত্র
*গণপ্রজাতন্ত্রী কম্বোডিয়া পিপলস রেভ্যুলেশনারি ট্রাইব্যুনাল পলপট-ইংসারে গোষ্ঠীর গণহত্যার বিচার বসে নমপেন শহরে ১৯৭৯ এর আগস্টে, সেই বিচারের দলিল নম্বর ২৫, ২৬ পৃষ্ঠা-২)
*People’s Republic of Kampuchea, Judgment of the Revolutionary People’s Tribunal Held in Phonm Penh from 15 to 19 August 1979, s.d.,p.13.
*People’s Republic of Kampuchea. People’s Revolutionary Tribunal ..., Doc. no. 2402, p.4.