উদ্দেশ্য ছিল বৃষ্টির শব্দ মিলিয়ে যাবার আগেই লেখাটা শেষ করব। কিন্তু শুরুতেই শুধু নামকরন নিয়েই যে বেশ একটা গন্ডগোল লেগে গেলো, তা দেখে মনে হচ্ছেনা যে এত তাড়াতাড়ি শেষ হবে। নামকরন এর গন্ডগোলটা হল, বৃষ্টিস্নাত ঋতুটির নাম আমার মুখে শুনলেই, আমার অতীব শুভাকাঙ্খী কিছু মানুষের বেশ একটা ঘোরতর আপত্তিযুক্ত চেহারা দেখা যায়। তাই, ইচ্ছে না থাকলেও শুধু বৃষ্টিই দিলাম, যেন অন্ততঃ নামকরনের স্বার্থকতাটা বজায় থাকে। তো যা বলছিলাম, বৃষ্টির শব্দ।
আসলে বৃষ্টিকে অনেকভাবেই দেখা যায়, আজকে বৃষ্টিকে আমার শুধুই শুনতে ইচ্ছে করছে, দেখতে না। তবে, একটু পটভূমি দিলে ব্যাপারটা আরেকটু পরিষ্কার হবে। একবার কথায় কথায় সামাজিকভাবে বেশ সৌখিন একজনকে বলছিলাম যে, বৃষ্টি কি মেঘের কান্না? বেশ একটা গুরুগম্ভীর চিন্তার ঝড় শেষ করে উনি বললেন যে, না, বৃষ্টি হল মেঘের নূপুররের শব্দ, আমরা শুধু তখনই শুনি, যখন মেঘ নাচে। বেশ চিন্তাক্লিষ্ট কথা, একেবারে অস্বীকারও করা যায় না।
সেদিন এক ইয়া উঁচু অট্টালিকার নিস্তব্ধ জানালায় দাঁড়িয়ে দেখছিলাম ধেয়ে আসছে এক মরণসম কাল বৈশাখী। অবাক হয়ে উপরের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলাম একপ্রস্থ কালো জমাট মেঘ কিভাবে ধাই ধাই করে প্রসারিত হচ্ছে। হঠাৎই মনে হল, হায় হায় বৃষ্টির যে শাব্দিক রুপ আছে, তা তো বুঝতে পারছি না এই শব্দপ্রহরী কাঁচের কারনে! তখনই মাথায় ঢুকলো আরেক চিন্তা, বৃষ্টির শব্দে তো কখনো বৃষ্টিকে দেখিনি। মাঝে মাঝে বইয়ে পড়েছি যে টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ শুনতেই নাকি অন্যরকম লাগে। কথাটাকে যদি বাস্তবে মিলাই, এমনটা মাঝে মাঝে হয় যে, হয়তো কোনো আলস্য ভরা দুপুরে শুয়ে আছি হঠাৎ শুনলাম পিট পিট পিট পিট… সড় সড় সড় সড়… তারপর, ঝুম করে বৃষ্টি নেমে গেল। সবাই-ই হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে গেল বৃষ্টিকে বাইরে বাইরেই রাখতে, যেন কোনোভাবেই ভেতরে আসতে না পারে। না বাবা, জানি তুমি অনেক ভাল, সুন্দরী, অপরুপা, কিন্তু বাবু তুমি বাইরেই থাকো; বা, দেখো বাবা কোনো ভাবেই যেন আমাকে আবার স্পর্শ করে ফেলোনা। কারন মাঝে মাঝে তো তুমি অচ্ছুৎ!
বৃষ্টির সেই পিট পিট সড় সড় শব্দ শুনে শুরু হয়ে যায় আমাদের শব্দের খেলা। ঘড় ঘড়-ঢুশ্ করে বন্ধ হয় বাসার জানালা, সাঁই সাঁই-ঠুক করে উঠে যায় গাড়িগুলোর জানালা, ফট ফট-ফটাশ করে রিক্সার বিশাল জানালা ঢেকে যায় নীল রঙয়ের দেশী আবরণে, মৃদূমন্দ কথা কাটাকাটি এবং টানাটানির শব্দ শুরু হয় পাবলিক বাসের কোনো দুর্ভাগাদের একটা মাত্র জানালার কাঁচ নিয়ে। তারপর শুরু হয় অপেক্ষার পালা। বিরস মুখে বৃষ্টি দেখা ও শুনা। হঠাৎই সবাই স্থির হয়ে যায় যার যার জায়গায়। সবাই শুনতে থাকে বৃষ্টির থামা থামা গর্জণ ও ঝুম ঝুম শব্দ। কেউ কেউ হয়তো উদাস হয়, কেউবা আবার বেশ টইটুম্বুর গালমন্দ করে।
মোটামুটি যখন বৃষ্টির নুপুরের শব্দের সাথে পাল্লা দিয়ে সবাই-ই বেশ একটা কোনো না কোনোও শব্দের খেলা শুরু করে, মাঝে মাঝেই বৃষ্টি কিছুক্ষণ পরেই তার আনমনা নাচ থামিয়ে দেয়। কিন্তু বৃষ্টির অস্তিত্ব কি মুছে যায়? আবার সবাই সাঁই সাঁই, ঘড় ঘড়, ফট ফট শব্দ করে আমাদের আগের যায়গায় ফিরে যাই, ভাবি, বৃষ্টিতো শেষ। আমাদের পাল্লা দিয়ে শব্দ করার প্রয়োজনও শেষ।
কিছু শব্দ কিন্তু থাকে, থেকে যায়... রাস্তায় জমে থাকা পানিতে যখন কোনো বেসুরো গাড়ী চলে, প্রায় ভিজে যাওয়া সেলফোন নিয়ে যখন অভিযোগ করি, ভেজা চুলের পানি যখন হাত দিয়ে শুকাই, মনের আর্দ্রতা যখন অশ্রুর সাথে বের হয়ে যায়, বা পাশের বাসার ছাদে জমে থাকা পানি যখন একমনে চড় চড় করে পড়তে থাকে... শব্দ কিন্তু থাকে, থেকে যায়... বৃষ্টিও কিন্তু থাকে, থেকে যায়।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে মে, ২০১১ সন্ধ্যা ৬:২০