কাতার প্রবাসীদের নিয়ে এক ভাইয়ের দোহা থেকে ঢাকা ফ্লাইটে লুঙ্গি পড়া কাহিনী বেশ কয়েকদিন ধরে অনলাইনে ভাইরাল। সত্য-মিথ্যা না বুঝেই আমরা কঠোর সমালোচনা করছি। লেখকের সঙ্গে কিছুটা মত পোষণ করলেও পরিপূর্ণভাবে একমত পোষণ করতে পারছি না। সংগত কারণেই আমার এই প্রতিবাদপত্র। আসুন দেখে নেই তার লেখায় কি কি সত্য হতে পারে, আর কি কি অতিরঞ্জিত। কিছু কিছু সত্য ,যেমন ল্যান্ড করার সাথে সাথে সবাই লাগেজ নামানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। টয়লেটে অনেক বড় লাইন হয় , কিছুটা জটলা তৈরী হয় এবং মাঝে মাঝে টয়লেট ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ে।
প্লেনে ২০ -৩০ জন জটলা করে গল্প করতে কখনো দেখিনি। এটা সম্ভবও নয়। আর ল্যান্ড করার ৪০ মিনিট আগে থেকে লাগেজ নামানো চিন্তাও করা যায় না। লেখাটা সচেতনতামুলক মনে হলেও লেখকের প্রবাসী শ্রমিক ভাইদের প্রতি নেগেটিভ মনোভাবই ফুটে উঠেছে। ইচ্ছা করে কেউ প্লেনে লুঙ্গি পড়ে উঠে না। কাতারে অবৈধ অভিবাসীদের পুলিশী অভিযানে হয়ত সে লুঙ্গী পড়া অবস্থায় ধরা পড়ছে এবং তাকে ঐভাবেই ডিপোর্ট করা হচ্ছে। বিয়ার খেয়ে মাতলামি , ফ্লাইটে ধূমপান করতে চাওয়া আমার কাছে সঠিক বলে মনে হয়নি। বিমানের ভিতরে খাবার নেওয়ার জন্য হুড়োহুড়ি করতে কখনো দেখিনি। বিষয়গুলো আরো সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করা যেত। আপনি আরো লিখেছেন কাতার থেকে যারা উঠেছে তারা প্রায় সবাই ওয়ার্কার বা অবৈধ ভিসাধারী। স্পঞ্জের স্যান্ডেল, লুংগি আর ঘামের গন্ধযুক্ত শার্ট পড়ে আপনার পাশে যিনি বসেছিলেন, একবার কি তার পরিস্থিতি জানার চেষ্টা করেছিলেন.... একবারও কি মায়াবী দৃষ্টি দিয়ে তার দিকে তাকিয়েছিলেন।... ওই শার্টে দুর্গন্ধ নয়, ওটা শরীরে রক্ত ভাঙা ঘাম ! এইসব ভাইদের ঘামে ঘোরে আমাদের দেশের চাকা। এদের রক্ত ঘামানো অর্থেই আমরা আজ শিক্ষিত।
পোর্টেবল স্পিকারে অনেক বিদেশী সহযাত্রীকে দেখেছি উচ্চস্বরে গান শুনতে শুনতে ছিটে শরীর দোলাতে। অনেক সময় সে বুঝতেও পারে না তার স্পিকার লাউডলি হয়ে গেছে। যেকোনো যাত্রীকে বিনীত ভাবে বললে সে অবশ্যই শুনবে। তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পাশের ছিটের যাত্রীর দিকে ঢোলে পড়া ,কেউ পা ছাড়িয়ে কেউ ভাঁজ করে বসা সাধারণ ব্যাপার। আপনার পাশের প্রবাসী ভাইটি জানালা দিয়ে আকাশ দেখতে চেয়েছিলো বলে বিরক্ত হয়েছিলেন, তাকে যদি মুক্ত আকাশটা দেখতে দিতেন এই প্রবাসী ভাইটা যে কি পরিমান খুশি হতেন সেটা যদি একবার দেখতেন !!
রুটি-রুজি আর আর্থিক সচ্ছলতার জন্য একজন মানুষ যখন প্রবাসে পা বাড়ায়,প্রথমত একটি নতুন পরিবেশ , ভাষাগত সমস্যা, সাংস্কৃতিক সমস্যা এবং প্রিয় মানুষদের সান্নিধ্য বঞ্চিত এক কঠিন পৃথিবীর সম্মুখিন হতে হয়। এদের শ্রম-ঘামে অর্জিত অর্থ নিজের পরিবারের আয়-উন্নতির পাশাপাশি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশাল অবাদান রাখছে। তাদের ত্যাগে উন্নয়ণের ছোঁয়া আজ গ্রাম অবধি পৌঁছিয়েছে। যদি দেশে থাকত তাহলেও হয়তো একই কাজ করতে হত,কিন্তু বিনিময়ে সে প্রিয় মানুষদের সংস্পর্শ পেত।হাজারো শ্রমিক ভাইয়ের লুকিয়ে ফেলা চোখের পানিতে ভেজা এই প্রবাসের মাটি। চোখের জল চোখেই শুকায়, আদর করে মুছে দেয়ার কেউ থাকে না। এদের কারোর পিত-মাতার শোক সংবাদেও দেশে যেয়ে শেষবারের মত দেখাটা হয়ে ওঠে না। তবুও এরা বেচেঁ থাকে, দেশকে ভালোবেসে, পরিবারকে ভালোবেসে। এদের কখনো আফসোস করতে দেখবেন না! মুখে হাসি লেগে থাকে অবিরাম! কে জানে... হয়তো ঐ এক চিলতে হাসির আড়াঁলে লুকিয়ে থাকে পাহাড় সম দুঃখ-ব্যাথা !
তাদেরকে নিয়ে একটু মানবিকভাবে ভাবুন। তাদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করুন ! তারা পাক তাদের প্রাপ্য সম্মান। আরব আমিরাতে প্রায় ৭০ ভাগ বাংলাদেশী-ব্যবসায়ী এদেশে এসেছিলেন শ্রমিক হয়ে। তাদের পরিশ্রম মেধা দিয়ে বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। হাজার হাজার বাংলাদেশীকে তাদের প্রতিষ্ঠানে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন। আজকে যাদের লুঙ্গি পড়া দেখছেন একটু সুযোগ পেলে হয়তো এদের মধ্য থেকেই অনেকে বড় ব্যবসায়ী হবে। আমার কাছে এরাই আসল নায়ক! এরাই বাজিগর ! এরাই প্রকৃত হিরো! স্যালুট এবং ভালোবাসা সকল প্রবাসী শ্রমিক ভাইদের !!
ঢাকায় ফ্লাইট ল্যান্ড করার সাথে সাথে সবাই নামার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে, কেউ কেউ মোবাইলে কথা বলা শুরু করে ,কেউ মায়ের সাথে, কেউবা তার আদরের সন্তানের সাথে। ফ্লাইটের মধ্যে অনেকেই খুশিতে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে আত্মহারা হয়ে ওঠে। তাদের চোখেমুখে থাকে অন্যরকম আনন্দ-উচ্ছ্বাস, চোখ গুলো করে টলমল। যাদের অনেকেই ২ থেকে ১০ বছর পর দেশে ফিরছেন। পরিবারের সুখ, সমৃদ্ধি, সচ্ছলতার কথা চিন্তা করে দেশে ফিরতে পারেননি অথচ মন যে পড়ে থাকে তাদের প্রিয়জনদের কাছেই। কতদিন সোহাগমাখা মায়ের ডাক শুনেনি, কতদিন তার আদরের বাচ্চাকে দেখেনি, কতদিন ছোট ভাইবোনদের দেখা পায়নি , কতদিন জন্মভূমির মাটি স্পর্শ করেনি! দীর্ঘদিনের জমানো দুঃখ-ব্যাথার সঙ্গে পরিবারের সব সদস্যদের মহামিলনে আনন্দ অশ্রু বয়ে যাবে ! কতদিন-কতবছর পর আজ বাবা-মায়ের মুখের হাসি দেখবে, বউয়ের মুখে মিষ্টি কথা শুনবে, ছেলে মেয়েদের মিষ্টি কণ্ঠের বাবা ডাক শুনবে !! প্রতিবার যখন দেশে যাই, ল্যান্ড করার সময় এই দৃশ্য গুলো দেখে 'আমার চোখ ভিজে ওঠে’.... দু’চোখ কেবলই ভিজে ওঠে নোনা জলে ...