অস্কার জেতা 'Slumdog Millionaire' মুভির একটি দৃশ্য। সামান্য কল সেন্টারের একজন চা সার্ভ করা ছেলে কীভাবে সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে কোটি টাকা জেতার দাঁড়প্রান্তে আসলো, সেটা নিয়ে দেখা দিয়েছে সন্দেহ। সবাই ধারণা করছে সে চিটিং করেছে। কারণ এমন একটি ছেলের পক্ষে এই ধরণের প্রশ্নের উত্তর জানাটা সন্দেহজনক। পুলিশের হেফাজতে নেয়া হল জামালকে। টিভিতে তার প্রতিটা প্রশ্নের উত্তর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে তাকে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে সে কীভাবে উত্তরটা জানতো।
সেখানে এমন একটা সহজ প্রশ্ন করা হলো যার উত্তর ভারতের মানুষ প্রায় সবাই জানে। কিন্তু এই সামান্য প্রশ্নের উত্তরটাই দিতে পারলো না জামাল। এর জন্য হেল্প নিতে হল সামনে বসা দর্শকদের। পুলিশ জামালকে বললো তার ৫ বছরের মেয়েও এই উত্তরটা জানে। জামাল কেন পারলো না? জামাল পুলিশকে জিজ্ঞেস করলো,
- দারিশা স্টোরে এক প্লেট পানিপুরি কত করে?
- ১০ রুপি?
- ভুল হয়েছে, গত দিয়ালি থেকে এটা ১৫ রুপি হয়ে গেছে।
জামাল আবার জিজ্ঞেস করলো,
- পুলিশ কন্টেবল ভার্মির বাই-সাইকেল গত বৃহস্পতিবার সান্তা কৃুজ স্ট্যাশন থেকে কে চুরি করেছে?
- তুমি জানো কে করেছে?
- জুহু এলাকার সবাই জানে এটা! এমনকি সব পাঁচ বছরের বাচ্চারাও!
জামালের কথার মূলভাবটি ছিল, সে হয়ত অনেক কিছু জানে না, কিন্তু তাকে যে প্রশ্নগুলো করা হয়েছিল সেগুলোর প্রায় প্রতিটা ঘটনার সাথেই তার জীবনের কোন না কোন ট্রাজেডি জড়িয়ে আছে। এই কারণেই সে উত্তরগুলো তার জানা ছিল। যারা মুভিটা দেখেছেন, তাদের আর নতুন করে বলার কিছু নেই। না দেখলে দেখে নিয়েন।
মাছরাঙ্গা টিভির একটি রিপোর্টকে কেন্দ্র করে বর্তমান ইন্টারনেট চাঙ্গা হয়ে আছে। আমরা অনেক রসিক একটা জাতি। অন্যের দুর্বলতা নিয়ে হাসাহাসি করাকে আমরা শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছি। আমরা অনন্ত জলিলের ইংরেজী নিয়ে হাসাহাসি করি, আমাদের ইংরেজির উচ্চারণ শুনে ইংলিশ মিডিয়ামের ছাত্ররা হাসে! আবার ইংলিশ মিডিয়াম ছাত্রদের আমেরিকান বা ব্রিটিশ একসেন্ট কপি করার ব্যার্থ প্রচেষ্টা দেখে আমেরিকান ও ব্রিটিশরা হাসাহাসি করে। শিক্ষককে কানে ধরে উঠবস করালে আমাদের ইগোতে লাগে, কিন্তু আমাদের বলা বেশিরভাগ কৌতুকে ছাত্রকে জিনিয়াস হিসেবে দেখিয়ে শিক্ষককে উপস্থাপন করা হচ্ছে গাধা হিসেবে, তাকে নিয়ে করা হচ্ছে মজা। শিক্ষক-ছাত্রদের নিয়ে সর্বশেষ কোন কৌতুকটা শুনেছেন যেখানে শিক্ষককে বড় করে ছাত্রকে ছোট করা হয়েছে? এতে শিক্ষকদের অপমান হয় না।
আমিও একটা বলি, একবার এক ছাত্রকে পড়া জিজ্ঞেস করা হলে সে পারলো না। শিক্ষক বললেন. ''গাধা, তোদের বয়সে আমরা এগুলো সব পারতাম!'' ছাত্র উত্তর করলো, ''পারবেনই তো, আপনাদের তো ভালো ভালো শিক্ষকরা পড়াত!''
আজকে যে তথাকথিত এ+ পাওয়া ছাত্রদের নিয়ে আমরা হাসাহাসি করছি, তাদের এই অবস্থার কারণে দায়ী কে?
একবার একটা কুইজ প্রোগ্রাম চালিয়ে এসে একজন আমাকে বললো, আজকালকার ছেলে মেয়েরা কিছুই জানে না। বাংলাদেশের শহীদ দিবস করে সেটাও বলতে পারলো না। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা তুমি বল, বাংলাদেশের জাতীয় দিবস কবে? সে ঝটপট উত্তর করলো, ১৬ ডিসেম্বর। আমি বললাম, ভুল হয়েছে, ২৬ মার্চ হবে। এই সামান্য বিষয়টা তুমি জানো না, তাদের দোষ দিয়ে কী লাভ!
আর যারা I am GPA 5 নিয়ে হাসাহাসি করছেন তাদের বলি, আপনি কি ১০০% সঠিক ইংরেজি বলেন? এমনকি সেই সাংবাদিকের ইংরেজি কি নির্ভুল? সে কি হলফ করে বলতে পারবে, তার ইংরেজিতে কোন ভুল হয় না? আমাদের দেশে টিভি প্রোগ্রামে যেখানে অনন্ত জলিলের ইংরেজি প্রচার করা হয় যে কিনা তথাকথিত মেনসিস্টার থেকে বিবিএ করা, সেখানে ঐ ছেলের ইংরেজি তো অনেক ভালো। আরেকটা কথা, আমি বরাবরই গণিতে দূর্বল ছিলাম, পিথাগোরাস লোকটা সম্পর্কে আমি নিজেও ভালো জানি না।
নেপালের রাজধানী কোথায় সেটা কি সবাই জানে? জানলে শুধু নেপালের রাজধানী নিয়ে কেন ভাব নিবেন? সব দেশের মুখস্থ করে দেখান। রাজধানী বাদ দিলাম, আপনি কি সব দেশের নাম জানেন? আচ্ছা দেশ বাদ দিলাম, আপনি কি বাংলাদেশের সব জেলার নাম বলতে পারবেন? আর অপারেশন সার্চলাইট সম্পর্কে আগে আপনারা কয়জন জানতেন? আপনাদের জিজ্ঞেস করলে অনেকে ঐ মেযের মত উত্তরই দিতেন আমি জানি। আমরা কেউই সবজান্তা সমশের না। এমনকি গুগল মামাও সব জানে না।
আমি ব্যক্তিগত ভাবে বিশ্বাস করি, না জানার মধ্যে কোন অপমান নেই, অপমান আছে না জেনেও জানার ভান করার মধ্যে। সব কৌতুক তাদের দিকে ছুড়ে দিলাম, যারা না জেনেও আজ জানার ভান করছেন।
যারা প্রশ্ন করছেন, এই ছা্ত্ররা এ+ পেল কীভাবে, তাদের জন্য একটি গল্প,
এক বোকা লোক কুইজ প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হল, তাকে জিজ্ঞেস করা হল, প্রশ্নটা কী ছিল। যে বললো, প্রশ্ন ছিল গরুর পা কয়টি, আর সে উত্তর করেছিল ৫ টি। বাকি প্রতিযোগীরা কেউ উত্তর দিয়েছিল ৬ টি, কেউ ৭ টি, তার টা কাছাকাছি হওয়াতে তাকেই চ্যাম্পিয়ন করা হল।
যেমন আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা, এর থেকে আর ভালো আর কী আশা করেন আপনি?
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে মে, ২০১৬ বিকাল ৪:২০