আমরা কী রকমভাবে মরে যাচ্ছি, তুই এসে দেখে যা নিখিলেশ। এই কি মানবমৃত্যু? শোকগাঁথায় বিহ্বল নিখিলেশ জবাব দেওয়ার শক্তি সঞ্চয় করে উঠতে পারবে না জানি। একের পর এক মৃত্যুতে এমন অসাড়তা গ্রাস করেছিল আমাদেরও। মৃত্যু নিশ্চিত গন্তব্য। তবে এভাবে কি? আমরা যখন-তখন মারা যাচ্ছি। আমরা অকারণে মারা যাচ্ছি। সুস্থভাবে ফিরব বলে প্রিয়জনের কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের নিথর দায় নিয়ে লাশ হয়ে ফিরছি। প্রতিটা লাশের গায়ে লেবেল সাঁটানো হচ্ছে-সড়ক দুর্ঘটনা। দুর্ঘটনার সংজ্ঞা কী? দৈবাৎ ঘটে যাওয়া অঘটন। যার কোনো হেতু পাওয়া যায় না। ব্যাখ্যা দাঁড় করানো যায় না। তবে ক্রমাগত ঘটে চলা অঘটনকে দৈবাৎ বলার সুযোগ নেই। সুযোগ নেই হেতুহীন বলার। নিয়ম করে মৃত্যু ঘটছে সড়কে। লাশশুমারি জানতে চান? গড়ে প্রতিদিন ৫০, আর বছরে ৪,০০০-১২,০০০ প্রাণহানি ঘটে। গত ১৫ বছরে ২ লাখেরও বেশি মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে। নিখিলেশ, তুই একে কী বলবি? নিছক দুর্ঘটনা? না হত্যা? আমরা জানি ‘কারণ’ আছে। ভাঙা রাস্তা। জলাবদ্ধ রাস্তা। সরু রাস্তায় যেখানে ওয়ানওয়ে হওয়া নিরাপদ, সেখানে টু-ওয়েতে যানবাহন চলাচল। রোড ডিভাইডার না থাকা। সব রাস্তায় ট্রাফিক সিগন্যাল না থাকা। থাকলেও তা না মানা। ফিটনেসবিহীন গাড়ি। দূরপাল্লার গাড়িগুলোর তুফানি গতি। ছুটন্ত গাড়ির গতি প্রতিযোগিতা। টার্নিং পয়েন্টে গতিরোধক না থাকা। গতি নিয়ন্ত্রণ নির্দেশনা না থাকা। হেলপার কর্তৃক বাস চালনা। অদক্ষ চালকদের ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদান। এত অনিয়ম! কে নেবে এর দায়? কেবল শোকবাণী কি স্বজন হারানোর আহাজারি মেটায়? প্রশ্নেরা ভিড় করেছে অতঃপর। অশ্রু শুকিয়ে জমেছে ক্ষোভ। আমাদের দাবি, সড়ক-মৃত্যু বন্ধ হোক। সব অনুভূতি খুইয়ে আমাদের আর ‘সহানুভূতি’ জাগে না তাদের প্রতি, যারা জনসেবার প্রতিশ্রুতি ভুলে যান অবলীলায়। কেননা, সময় নেই আর সেসব মিথ্যে আশ্বাসে ভোলার। সড়ক নিরাপত্তার দাবিতে তাই সড়কেই জমায়েত হয়েছি আমরা। এ যূথবদ্ধতা বাঁচার জন্য। নিজেকে। প্রিয়জনকে।
সড়ক কার্পেটিং করার যে চিত্র টিভির খবরে দেখা গেছে, তাতে পথচারী, গাড়িচালকরাও অসন্তুষ্ট। একে পরিস্থিতি ঠাণ্ডা করার প্রচেষ্টায় আইওয়াশ মানছেন কেউ কেউ। পথচারীরা বিক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ায় বলছেন, বলাই হয়_ ২৩ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। আসলে ২৩ হাজারও খরচ হয় কি-না সন্দেহ! বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে গণহারে লাইসেন্স প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েও। টিভি সংবাদ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, চালকেরা নির্দেশনা বইতে থাকা চিহ্নের ইচ্ছেমতো অর্থ দাঁড় করাচ্ছেন। বিপরীতে জনসেবকরা লাশের ভার নিজ কাঁধে নিতে চান না। তাই এক মন্ত্রণালয় আরেক মন্ত্রণালয়কে দুষছে। দায় চাপাচ্ছে। জড়াচ্ছে বিতণ্ডায়। কিন্তু রাষ্ট্র তো একক কোনো মন্ত্রণালয়ের ওপর নির্ভরশীল নয়। সড়ক ব্যবস্থাপনায় যোগাযোগ মন্ত্রণালয় আছে প্রত্যক্ষ পরিচালনায়। তবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয় তো এ ব্যবস্থাপনার বাইরে নয়। বাদ যাবেন না নগরপিতার দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিও। এমনকি শিক্ষা মন্ত্রণালয়কেও বাদ রাখা যাবে না। আমরা জানতে চাই, শিক্ষার হার কত হলো? কেন গরু-ছাগল চেনাকে যোগ্যতা বিবেচনা করে ড্রাইভিং লাইসেন্স পাই আমরা? ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদানের জন্য শিক্ষাগত যোগ্যতা নূন্যতম এসএসসি করতে পারি না কেন এখনও?
যেহেতু যথাযথ নীতিনির্ধারকরা সমাধান দিতে পারছেন না তাই মতবিনিময় জরুরি। ইতিমধ্যে নাগরিক সমাজ থেকে বিকল্প প্রস্তাব উঠেছে, রেলপথ ও নৌপথকে কার্যকর করতে হবে। চালকদের বিশেষ প্রশিক্ষণের প্রতি জোর দিয়েছেন অনেকে। রাষ্ট্রীয় উন্নয়নমূলক কাজে রক্ষণাবেক্ষণের অভাব বরাবর পরিলক্ষিত হয়। দেখা যায়, রাস্তার উন্নয়ন হয় না। আর উন্নয়নের নামে একবার খোঁড়া শুরু হলে তা শেষ হয় না। ফলে বাড়ে কেবল জনদুর্ভোগ। ডিজিটাল বাংলাদেশে অব্যবস্থাপনা নিয়ে দ্রুত অভিযোগ ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে জনগণ ও প্রশাসনের মধ্যে ডিজিটাল যোগাযোগ পদ্ধতির প্রচলন জরুরি।
উন্নত প্রযুক্তির ছোঁয়া সড়ক ব্যবস্থাপনাতেও চাই। আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে বিশেষ পরিস্থিতিতে সিসি ক্যামেরা বসানোর উদ্যোগ নিতে দেখা গেছে। যেসব রাস্তায় দুর্ঘটনার প্রকোপ বেশি, সেসব পয়েন্ট চিহ্নিত করে সিসি ক্যামেরা বসানো হোক। অনেকটা ট্রাফিক সিগন্যাল পোলের মতো ‘স্পিড ক্যামেরা’ পোল দেখা যায় বিদেশে। বিদেশে ট্রাফিক পুলিশের কাছে থাকে যানবাহনের গতিমাপক যন্ত্র। এতে শনাক্ত করা যায় বেঁধে দেওয়া গতির বাইরে কোনো গাড়ি পার হয়ে গেল কি-না। আমরা কেন সড়ক খাতকে এমন আধুনিকীকরণ করছি না? আর কতগুলো মানুষ মরলে কিছুটা দায়িত্বশীল আচরণ দেখাবেন দায়িত্বপ্রাপ্তরা?
দ্য পেশেন্ট হ্যাড ডায়েড বিফোর দ্য ডক্টর কেম! জনগণ সব হারানোর মাতমকালে দায়িত্বশীলদের নড়াচড়া দেখতে চায় না। প্রিকশন ইজ বেটার দ্যান কিওর। প্রিয় মুখ হারিয়ে প্রেস ক্লাবে কালো ব্যানার হাতে কতবার দাঁড়াব? শহীদ মিনারের পাদদেশে বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে আর কতবার দেব স্লোগান? কতগুলো মানববন্ধনে নিশ্চিত হবে নিরাপদ জীবন? নিখিলেশ, আমরা এ রকমভাবে মরে যাচ্ছি! তাই এই শেষবার একটা আন্দোলন হয়ে যাক বাঁচার জন্য। আমাদের প্রত্যাশা তো বেশি কিছু নয় রে নিখিলেশ! আমরা সন্তাপ বন্ধক দিয়ে একটা দাবিই তুলেছি-সড়ক নিরাপত্তা, যেন অক্লেশে জীবনকে জীবন বলে ভাবতে পারি।
***
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিল: ২৮ আগস্ট ২০১১, দৈনিক সমকাল