শহরের মানুষের দম যেতে বেশ একটা সময় লাগে না। জোয়ান মরদ। হয়তো দু’এক ছাওয়ালের বাপ। হঠাত করে হার্ট এটাক। খবর পেয়ে ডাক্তার, এম্বুলেন্স ছুটে আসতে না আসতেই পটল তুলে বসে। ঝামেলা চুকে যায়। কিন্তু, গ্রামের মানুষ এমন না। টানা-পোড়নের জীবনের মতো এদের প্রানটাও টানা-পোড়নে থাকে। সহজে ছিড়তে চায় না।
এইতো মনার দাদী। বয়সের ঠিক আন্দাজ নেই। তবে, আর্থিক দৈন্যতা যে শরিরটাকে স্বস্তি দেয় নি এ ঢের বোঝা যায়। ঐ দিন মাচায় বসে শরিরে হাওয়া লাগাচ্ছিলো, হঠাত ও বউ!ও বউ! বলে মনার মা’রে ডাক দিয়ে ফিট হল। দাত-মুখে খিট ধরে ঠোট কেটে ফেলছে। মনার মা হন্ত দন্ত হয়ে উঠোনের উপরেই শুইয়ে দিল। তার ঢাক-ঢোল শুনে আশ-পাশ ঘরের পুরুষ, ঝি-বৌরা দৌড়ে এসে কেউ মাথায় পানি ঢালতে লাগলো, কেউ তৈল মালিশ করলো, একজন ময়লা পা দু’টো তুলে হাত দিয়ে মুছতে মুছতে ফর্সা করে ফেলছে।আরেকজন মুখের ভেতর চামচ ঢুকিয়ে দাত খিটা খোলার চেষ্টা করল। আহ! মনার দাদী অমন যত্ন কখনো পায় নি।
মনার মা ইতোমধ্যে বিলাপ শুরু করে দিয়েছে। মানুষজনের ভীড় যতো বাড়ছে, তার বিলাপও ততো বাড়ছে। মনার চেহারা ভাবলেশহীন। বাড়ির এক কোনে মুখ ভার করে বসে আছে। তার মনটা ছট ফট করছে। বাপটা কখন আসবে?
বহু চেষ্টার পর মনার দাদীর খিট ধরা খুল্ল। এক পলক চোখ মেলতেই সবাই বল্ল- ‘সুবানাল্লাহ! সুবানাল্লাহ!’।
অমনি আবার ফিট হয়ে গেল। এবার আর ফিট হলো না। হাত-পা টান করে সব ছেড়ে দিল। জরিনার বাপের ইয়াসীন সূরা মুখস্ত ছিল। সে জোরে জোরে পাঠ করতে লাগলো।
কেউ কেউ বলে উঠলো গেছে! মরে গেছে! মনার মার বিলাপ আরো বাড়লো। সাথে নিকট গোছের ক’জন আত্মীয়ও জোগ দিলো। মরা বাড়ীর খবর চতুর্দিকে জানান দিতে হয়। এইজন্যে চিল্লা-ফাল্লা করে বিলাপের আয়োজন।
গেরামের মানুষজনতো আর শহরের মাইনষের মতো পাষুন্ড না যে, কেউ মরলে তার পাশের ঘরের মানুষই জানে না। গেরামে কেউ মরলে চিল্লায়ে দশ গেরামের মানুষ জড়ো করতে হয়। যতো বেশি মানুষ, ততো বেশি পূণ্যি।
ক’জন মহিলা আযূ গোসল ছাড়াই মনার দাদীর পাশে বসে তসবীহ জপা শুরু করেছে। আর কিছুক্ষন পর পর ফু দিচ্ছে। সে দলে রহিমের বউও আছে। সে মোটা-সোটা মহিলা। প্রচুর পান খায়। তার ফু দেয়ার সাথে সাথে পানের পিক এসে মনার দাদীর মুখে পড়ছে। তবু ফু দেয়া থামছে না। পুরুষদের মধ্যে একজন বল্ল-
‘এতিমখানায় খবর লও। পুলাপাইনডি আইসা কুরান খতম পড়ুক। মুদ্দা শান্তি পাইবো।
আরেকজন বল্ল- ‘এ জব্বর। মুদ্দা কও ক্যা? এহনো মরছে না মরে নাই, বুঝলা ক্যামনে?’
‘মরছে! মরছে! হাত-পা ছাইরা দিছে দেহ না? গোসলেরও ব্যবস্থা করা দরকার’।
জব্বার মিয়া ব্যস্ত হয়ে উঠলো। পাশেই দেখলো মনা দাঁড়িয়ে কাদছে। সে বল্ল-
‘থাক, কান্দিস না। তোর বাপ কই?’
‘গাঙ্গে গেছে’।
‘দুপুর আওনের কতা?’
‘জ্বে’।
‘তাইলেতো ভালোই। দাড়া, আমি খবর পাঠাইতাছি’।
জব্বার মিয়া শুধু গাঙ্গেই লোক পাঠালো না। গঞ্জে একজনকে পাঠালো কাফনের কাপড় আনতে। মহিলা মুদ্দা। পাচ কাপড়। ভূল যা’তে না করে। নিজে থেকে বাশ কাটলো। এখন বাশ চেলি করা হচ্ছে। কবর খোড়ার লোকও কিছুক্ষনের মধ্যেই চলে আসবে। তার আয়োজনে সবাই নিশ্চিত হল, মনার দাদী মরে গেছে।
খবর পেয়ে মনার বাপ কাদতে কাদতে ছুটে আসলো। গাঙ্গে আজ ভালো মাছ উঠছে, সে মাছ তার মা খেয়ে যেতে পারলো না, এ নিয়ে তার দূঃখের শেষ নাই। কবর খোড়ার লোকেরাও চলে এসেছে। একজন পাটখড়ি দিয়ে শরিরের মাফ নিতে এলো। শরিরের সাথে পাটখড়ি লাগাতেই মনার দাদী নড়ে উঠলো। সে চিল্লায়ে বল্ল-
‘মরে নাই! মরে নাই! বাইচা আছে!’
সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ল। নাকের কাছে নিঃশ্বাস নিয়ে দেখলো, সত্যি মরে নাই।
মনার বাপ দ্রুত ভ্যানে করে শহরে নায়ার ব্যবস্থা করল। রাস্তা-ঘাট সুবিদার না। গঞ্জ থেকে শহর পর্যন্ত পুরোটাই ইটের খনাখন্দে ভরা। মাঝে মাঝে বিশাল গর্ত। এই রাস্তায় সুস্থ মানুষও অসুস্থ হয়ে পড়ে। চার-পাচ মাসের অধিক পোয়াতি বউয়ের অধিক নড়াচড়ার ফলে বাচ্চা নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ভ্যানওয়ালা যথাসম্ভব সাবধানে ভ্যান নিয়ে এগিয়ে চল্ল। এ গ্রামে তার বেশ সুখ্যাতি আছে। এম্বুলেন্সের চেয়ে তার ভ্যানেই মানুষ বেশি নিরাপদ বোধ করে।
ঝাকুনি খেয়ে মনার দাদীর মুখ দিয়ে ফেনা বেরুচ্ছে। গত ক’দিন যাবত বেশ গরম পড়ছে। তালপাকা গরম যা’কে বলে। তবু মনার দাদীরে ভারী কাথা দিয়ে মুড়িয়ে রাখা হয়েছে। রোগী হলেই সবারে কাথার নিচে ঢুকাতে হয়।
হাসপাতালে তারা যেমন হম্বি তম্বি করে ঢুকল, হাসপাতালের লোকজন ব্যাপারটাকে সে রকম গুরুত্ব নিয়ে দেখল না। মনার বাপ বেশ করে বোঝাল-
‘স্যার দেখেন, রোগীর অবস্থা খারাপ’।
হাসপাতালের রিসিপসনিষ্ট গোফওয়ালা রাশভারী চেহারার লোকটা বল্ল-
‘ডাক্তার আসুক’
‘হাসপাতালে ভর্তি করামু না?’
‘সিট খালি নাই। দেখেন কোনখান দিয়া জায়গা টায়গা পাইলে শুয়ায়া দেন’।
‘কন কি স্যার। ডাক্তার আইবো কুনসুমে?’
‘সময় অইলে’
‘রোগীর যে অবস্থা খারাপ!’
‘বইসা দোয়া দরুদ পড়েন’
মনার দাদীরে হাসপাতাল বারান্দায় এক ধারে নিচেই কাথা পেতে শুইয়ে মনার বাপ, মনার মা আর মনা দোয়া দরুদ পড়া শুরু করলো। ডাক্তার আসলো সন্ধ্যারও বেশ পর। এর মাঝে দু’জন নার্স এসে রোগীর হাত-পা নেড়ে চেড়ে দেখলো। মনার বাপ তাদেরই ডাক্তার ঠাওরে জিজ্ঞেস করল-
‘ডাক্তার আফা রগীর অবস্থা কি?’
‘রোগী দূর্বল। খাওয়া-দাওয়া ঠিকমত হয় নাই’।
মনার মা কাচুমাচু করে বল্ল- ‘খাইতে চায় না’।
‘আচ্ছা স্যার আসলে দেখবে’ বলে প্রথম নার্স চলে গেল। দ্বিতীয়জন নতুন নার্স। বয়সে বেশ তরুনী। তারে মনার বাপ ডাক্তার বলায় সে মহা খুশি। কিছুক্ষন পর পরই এসে বেশ ভাব নিয়ে মনার দাদীরে দেখলো, শান্তনাও দিল-
‘গাবড়ানোর কিছু নাই। রোগী সুস্থ হয়ে যাবে’।
ডাক্তার এসে এক নজর দেখেই কাগজে হাবিজাবি লিখে চলে গেল। মনারা সব অবাক হল। মনার বাপের সামান্য অক্ষর জ্ঞানে সে সব লেখার মানে বুঝলো না।বড় ডাক্তার বড়ই ভালো মানুষ। এই বারান্দায় এসেও সে রোগীদের দেখে। মনার বাপের ইচ্ছে হল, ডাক্তারের পা ধরে সালাম করে।
ইতোমধ্যে মনার দাদীর পাশেই আরেকটা পুচকে ছেলে এসে উঠেছে। বান্দর ছেলে। ভিমরুলের বাসা ভাঙ্গতে গিয়ে কামড় খেয়ে সারা শরির ট্যামা বানিয়ে ফেলেছে। প্রথমে আসার পর মুখ দিয়ে ফেনা বের করে আছড়া-আছড়ি করলেও ডাক্তারের ইঞ্জেকশানের পর থেকে স্বাভাবিক আছে। কিন্তু, বাদরামি কমে নাই। ইতোমধ্যে হাসপাতালের বিভিন্ন রোগীর শরিরে দেয়া স্যালাইনের বোতল আর ইঞ্জেকশানের সিরিঞ্জ খুজে খুজে জড়ো করেছে বাড়ি নেবে বলে। কেউ সেগুলোতে হাত দিলেই লাফালাফি করে, ফলে সবাই চুপ।
ঐ বাদরটার সাথে ওর মা আর বোন এসেছে। মনার বাপের বাদরের খোজ-খবর নেয়ার সুবাদে তাদের সাথে ভালো সখ্যতাও হয়েছে। কিছুক্ষন পর পরই পান,চুন, কটা বাজে, ডাক্তার কখন আসবে, এসব জানার জন্যে মনার বাপ বাদরের আশপাশে ঘরপাক করে। এ নিয়ে মনার বাপ তা’কে বেশ ক’বার চোখ রাঙ্গানি দিয়েছে। মনার বাপ বেশ বুঝতে পারছে, বাড়ী ফিরলে তাকে একটা বড় সড় হাংগামার সম্মূখীন হতে হবে।
মনার দাদীর জ্ঞান ফিরেছে। চোখ মেলে বল্ল- ‘আমারে একটু বসাও’। মনার মা বসাল। মনাও দাদীর পাশে এসে বসল। মনার বাপ বল্ল-
‘মা বালা লাগচাছে?’
‘হ বাজান। ভালোই লাগতাছ। পান খাইবার মন চায়’।
‘খারাও মা, আনতাছি।
মনার বাপ দ্রুত বানরের বোনের কাছে গিয়ে বল্ল-
‘আফা, একটা পান অইবো? মায় খাইবার চায়’।
‘অইবো। আমনের কাছে কিন্তু আগের ছয়ডা পান পাই, হি! হি!’।
‘হ আফা।এক সাথে সব শোধ করুম’।
‘এক সাথে? হি! হি! নেন পান। একসাথেই শোধ কইরেন’।
বাদরের মা চোখ বড় বড় করে তাকালে বাদরের বোন মাথায় ঘোমটা টেনে অন্য দিকে ফিরে যায়। মনার বাপ পান নিয়ে মায়ের কাছে এসে বলে-
‘নেও মা। পান খাও’।
পান মুখের কোনে দিয়ে বলে- ‘বাজান শহরে আইছি বুঝি?’
‘হ মা। শহরের হাসপাতাল’।
‘ও……। ডাক্তার সাব কই? আমগো লগে দেহা দেয়?’
‘হ মা দেয়। তোমারেওতো দেখল’।
‘হাছানি? বাজান, আবার কহন আইবো?’
‘আরো পরে। আমগোরেতো আইজ ছাইরা দিব। বাড়ী যামু গা’।
‘ও বউ’
‘জ্বে আম্মা’
‘চুপ কইরা আছ ক্যা? কিরে মনা, তুইও দেহি চুপ?’
‘আম্মা আফনে চিন্তা কইরেন্না। সুস্থ অইছেন। আমরা বাড়ী যামুগা’।
‘হ যামু যামু’!
মনার বাপ হাসপাতালের নিচে। তাকে রিলিজ লেটার দিয়েছে। ভ্যানও চলে এসেছে। বাড়ী চলে যাবে। তার ইচ্ছে করছে বাদরের বোনটাকে বলতে, তাদের বাড়ী আসতে। কিন্তু, সে জানে, সে বলতে পারবে না। সে দশতা পানের খিলি কিনেছে। যাওয়ার বেলা বাদর আর তার মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাদরের বোনের হাতে পানের খিলিগুলো দিয়ে বল্ল-
‘নেন! আপনের পান’।
‘পান? হি! হি!’
‘আইচ্ছা যাই’
‘আইচ্ছা যান’
‘দাড়ান! দাড়ান! পানতো মনে হয় বেশি দিছেন’
‘বাকীগুলান পরে শুধরাইয়েন’
‘পরে শোধ করুম? হি! হি!’
মনার বাপ কিছু না বলেই চলে আসল। তার আরো হাসপাতালে থাকতে ইচ্ছে করছে। ভালোইতো ছিল হাসপাতালের বারান্দাটা।
ইস! হাসপাতালের বারান্দা!
২৮।১০।১৫
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ দুপুর ২:১০