১৯৪৭ সালের দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে বিভক্ত ভারতবর্ষের "পাক" অংশে ধর্মীয় আবেগ ও জাতিগত স্বাতন্ত্র্যের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আরবী হরফে বাংলা লেখার প্রস্তাব ও প্রয়াস যথেষ্ট প্রাচীন। ১৩২২ সালের অগ্রহায়ন সংখ্যা 'আল-এসলাম' পত্রিকায় 'বাঙ্গালীর মাতৃভাষা' শিরোনামে 'খাদেমোল এনসান' বলেনঃ
"উর্দ্দুর ন্যায় আমাদের ভাষা আরবী অক্ষরে কায়দামতে লেখা হইলে আরব ও পারস্যের লোক অতি সহজে আমাদের ভাষা পড়িতে ও শিখিতে পারিবে এবং আমরাও তাহাদের ভাষা পড়িতে ও শিখিতে পারিবো। আমাদের মাতৃভাষা আরবী অক্ষরে লিখিত হইলে নিশ্চয়ই টাহার প্রতি সাধারণের ভক্তি অতি বেশী হইবে,.... মুসলমানদের উচিত এই বিষয়ে যথাসাধ্য চেষ্টা করা" (ডঃ আহমদ শরীফের পত্রঃ আবুল আহসান চৌধুরীকে লিখিত- ১৬-৯-১৯৮৭)
চট্টগ্রামের জে এম সেন স্কুলের আরবী-ফারসীর শিক্ষক মাওলানা জুলফিকার আলী ভারতবর্ষ ভাগের পূর্ব থেকেই আরবী হরফে বাংলা লেখার উদ্যোগ গ্রহন করেন। এই প্রয়াসের অংশ হিসেবে তিনি কয়েকটি বই লেখা , 'হরূফুল কোরআন' নামে সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ ও 'হরূফুল কোরআন' সমিতি গঠন করেন। তারই উদ্যোগে ১৯৩৯ সালের ২৯-৩১ ডিসেম্বর কলকাতায় অনুষ্ঠিত 'All India Muslim Educational Conference' -এ আরবী হরফে বাংলা লেখার প্রস্তাব গৃহীত হয়। দেশ বিভাগের পর তিনি এই প্রয়াসে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন। ( বদরুদ্দীন উমরঃ 'ভাষা আন্দোলনের প্রসঙ্গঃ কতিপয় দলিল- ২য় খন্ড। ঢাকা, জুলাই ১৯৮৫; পৃষ্ঠা- ১০৬)
মূলতঃ এর সূত্রপাত কোন ধর্মীয় আবেগ থেকে নয়, মাদ্রাসায় বাংলা হরফ তৎকালীন সময়ে শেখানো হতো না বলে মোল্লাদের বাংলা পুঁথি পড়ার সাধ মেটানোর জন্য চট্টগ্রামে উনিশ শতকে মৌলবীদের আগ্রহে কয়েকখানা পুঁথি আরবী হরফে লেখা হয়। (বাঙ্গালী ও বাংলা সাহিত্যঃ আহমদ শরীফ রচিত গ্রন্থের পৃষ্ঠা ৬৪৩ দ্রষ্টব্য)
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তৎকালীন রাজনৈতিক ও ধর্মীয় পৃষ্ঠপোষকতার পরিমন্ডলের কারণে এবং সরকারী উৎসাহে উর্দ্দু বা আরবী হরফে বাংলা বর্ণমালা রুপান্তরের মদতদাতা মূলত বাংলাভাষা বিরোধী কিছু ব্যাক্তির আন্তরিক উদ্যোগ। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য পাকিস্তান আমলে আরবী হরফ প্রবর্তনের 'দার্শনিক' ও 'মূল প্রবক্তা ' কেন্দ্রীয় বাঙ্গালী মন্ত্রী ফজলুর রহমান। সাথে আরো কিছু নাম উল্লেখ করতে হয়, পূর্ব বঙ্গ শিক্ষা শিক্ষা দফতরের সচিব ফজলে আহমদ করিম ফজলী, অধ্যাপক ওসমান গনি, স্কুলের শিক্ষক উর্দ্দুভাষী বিহারী মওলানা আব্দুর রহমান বেখুদ প্রভৃতি। তবে অগ্রনী হিসেবে চট্টগ্রামের মওলানা জুলফিকার আলীর নাম সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য।
বয়স্ক শিক্ষা কার্যক্রম এর নামে কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব বাংলার জন্য জন্য ১৯৪৯ সালে ৩৫,০০০, ১৯৫০ সালে ৬৭,৭৬৪ টাকা বরাদ্দের পুরোটাই খরচ করা হয় 'আরবী হরফে বাংলা প্রচলনের প্রচেষ্টায়'। যার পরিক্রমায় ১৯৪৯ সালে র ৯ ই মার্চ গঠিত 'পূর্ব বাংলা ভাষা কমিটি'র সাব কমিটি 'উর্দু ভাষা সাব কমিটি' গঠিত হয়, যারা বাঙলা ভাষাকে উর্দু ভাষায় লিখিত করার সুপারিশ করে। যার প্রধান উদ্দেশ্য ছিলো ধর্মীয় জুজুর ভয় দেখিয়ে ( বাংলাদেশের মানুষের ধর্মভীতির বিষয়টি উল্লেখ না করলেও চলে) বাঙলা ভাষাকে ধীরে ধীরে অবলোপন এবং ইসলামের নামে বাংলাদেশের সমাজ সংস্কৃতি ও কৃষ্টির উপর তথাকথিত ইসলামী (মূলতঃ পশ্চিম পাকিস্তানি) সংস্কৃতি চাপিয়ে দেয়া। তৎকালীন সময়ে পশ্চিম পাকিস্তানীরা মনে করতো বাঙ্গালী সংস্কৃতি হিন্দুয়ানী সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত ও বাঙালীরা অর্ধ মুসলিম। বাঙ্গালীকে 'মুসলিম' করতে তাদের প্রচেষ্টার কোন শেষ ছিলো না।
এ বিষয়ে আসলে এতদূর আলোচনা করা যায়, যা হয়তো একটি ব্লগে ধারণ করা সম্ভব হবে কিনা তা এ মুহূর্তে বোধগম্য হচ্ছে না। মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসি।
আদিবাসী নেতা স্বামী কালযুগানন্দ ৭-ই এপ্রিল ১৯৪৯ সালে করাচীতে বলেন-
"বাংলা বর্ণমালাকে আরবি বর্ণমালায় রূপান্তরিত করলে তার সম্পদ ও সৌষ্ঠব বৃদ্ধি পেয়ে তা পুনরুজ্জীবিত হবে এবং ইসলামী রেনেসাঁর সঙ্গে তার বলিষ্ঠ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হবে।" ( বশীর আলহেলালঃ 'ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস', বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৮৫। পৃষ্ঠাঃ ৬৩৬)
পূর্ব বাংলা ভাষা কমিটির প্রথম সম্পাদক কবি গোলাম মোস্তফা, সাহিত্যিক মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী, অধ্যক্ষ শাইখ শরফুদ্দীন, সাংবাদিক মুজিবুর রহমান খাঁ, অধ্যাপক সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন, অধ্যাপক খলিলুর রহমান, ডঃ সৈয়দা ফাতেমা সাদেক সহ বিশিষ্ট সাহিত্যিক-শিক্ষাবিদ সৈয়দ আলী আহসান ও উর্দু হরফের প্রবর্তনের সমর্থক ছিলেন বলে জানা যায়। (ভাষা আন্দোলন প্রসঙ্গঃ কতিপয় দলিল, ২য় খন্ড। পৃষ্ঠা- ১৭১)
এ প্রসঙ্গে আবদুল হক তাঁর 'ভাষা আন্দোলনের আদিপর্ব' গ্রন্থে বলেন-
" আসলে আরবী অক্ষরের প্রতি মুসলমানের দুর্বলতার সুযোগের খিড়কি পথে তাদের উর্দুতে দীক্ষিত করে নেয়াই এই প্রস্তাবের উদ্দেশ্য বলে মনে হয়।"
বুদ্ধিজীবিদের এহেন বেশ্যাবৃত্তিক মনোভাব দেখে সাধারন মানুষ ও কিছু বুদ্ধিজীবি ( ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ডঃ মুহম্মদ এনামুল হক, আবদুল হক, মোহাম্মদ ফেরদাউস খান ও আব্দুর গফুর) প্রতিবাদ জানালেও সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় উর্দ্দুর সম্প্রসারণের এহেন ঘৃণিত উদ্দ্যোগে আতংকিত হয়ে সর্বসাধারণের বিশেষ সতর্ক ভাব ও অসন্তোষ এবং এর ফলশ্রুতিতে বিক্ষোভের আশংকায় ১৯৪৯ সালের ১৪ই ডিসেম্বর সরকার এক প্রেস নোট জারী করে-
"বাংলা ভাষা বর্তমান চালু হরফে লিখিত হইবে, কি আরবী হরফে লিখিত হইবে প্রদেশবাসীর স্বাধীন মতামতের দ্বারাই তা নির্ধারিত হইবে"
বেনামে লেখা হয়েছিলো একটি বই। যার নাম ছিলো ' হরফ সমস্যা'। লেখক ছিলেন 'দূরদর্শী'। ছদ্মনামের আড়ালের মানুষটি দাবি করেন নিরপেক্ষ দৃষ্টিভংগী থেকে তিনি বইটি লিখেছেন। অথচ বইটিতে জাতিগত ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য এবং জাতীয় ঐক্যের নামে কখনো ভাষাতাত্ত্বিক যুক্তি, কখনো ধর্মীয় আবেগ আবার কখনো বা রাষ্ট্রীয় সংহতির দোহাই দিয়ে আরবি হরফ এর পক্ষেই বারংবার বলা হয়। অনুমান করা হয় তৎকালীন কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমানের অনুদানে ও সরাসরি তত্বাবধানে বইটি প্রকাশিত হয়, যার সহায়তায় সরকারী প্রস্তাবে প্রতিফলন ঘটে বই এ দেখানো যুক্তি ও তার পথ সমূহ।
বইটিতে মাওলানা জুলফিকার আলীর উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়-
"স্বপ্নে আমাকে হযরত মোহাম্মদ সাঃ দর্শন দান করিয়া এ কাজে অগ্রনী ভুমিকা পালনের জন্য ভার প্রদান করেন"
আমাদের কাঠমোল্লাদের কথা মনে পড়ছে কি? এহেন ঘৃণিত ও মিথ্যার পথ ধরে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের বিভ্রান্ত ও প্রতারিত করার দ্বারা তৈরি করা হয় একটি রাষ্ট্রীয় অপরাধ।
লেখক আরো বলেন-
"যদি বলা যায় যে কোন বিদেশী ইহার অনুপ্রেরণা যোগাইয়াছিলো, তবে সে আর কেউ নন, স্বয়ং মানব-শ্রেষ্ঠ রসূলে করিম (দ। এই পথ ধরেই , অর্থাৎ আরবী হরফ গ্রহনের মাধ্যমেই বাঙ্গালী মুসলমানের ইহকাল ও পরকালের মুক্তি মিলবে এবং আরবী হরফ প্রবর্তিত হলে মনে করা হবে রসূলে কারীমের ইচ্ছা পুর্ণ হইলো!" (ভাষা আন্দোলনের দলিলঃ আবুল আহসান চৌধুরী। পৃষ্ঠা- ৯-১০)
বর্তমানের আওয়ামীলীগের অসংখ্য বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের মতোই ছিলো এ স্বপ্ন, যা মিথ্যাচারে ভরা ও ধর্মজুজুর পথ কে আঁকড়ে ধরে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের পথ কে প্রসারিত করে দেয়ার অবলম্বন।
পাকিস্তানের তৎকালীন মন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কিত বক্তব্য যা জানুয়ারীর ২৭ তারিখে, ১৯৫২, পল্টনের জনসভায় প্রদান করেন, তার ফলশ্রুতিতে ছাত্র জনতা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। যার পথ ধরে ফেব্রুয়ারীর ২১ ও ২২ তারিখে ঢাকায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গে ছাত্র জনতার বিক্ষোভ মিছিলে গুলি করে মেরে ফেলা হয় সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার ও গ্রেফতার করা হয় অসংখ্য ছাত্র-শিক্ষক-রাজনিতীবিদ ও বুদ্ধিজীবি কে। প্রাদেশিক মুসলিম লীগ সরকার একে আখ্যায়িত করে নাশকতা মূলক ও রাষ্ট্রদ্রোহিতা হিসেবে। ঐদিন বিকেলেই পূর্ববঙ্গ ব্যাবস্থা পরিষদে হয় তুমুল বাকবিতন্ডা ও তর্ক-বিতর্ক। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নুরুল আমিন প্রথমে মিছিলে গুলিবর্ষনের বিষয়টি অস্বীকার করেন, অস্বীকার করেন মৃত্যুর ঘটনা, অস্বীকার করেন পুলিশ দ্বারা লাশ গুমের অভিযোগ। তার পরবর্তীতে গন অসন্তোষ থামাতে দুইবার বেতারে ভাষন দেন, যেখানে কোন দায় স্বীকারের কথা উল্লেখ ছিলো না, বরং আন্দোলনের মর্যাদা ও রূপকে বিনষ্ট ও বিকৃত করাই ছিলো মূল উদ্দেশ্য। বলা হয় বিদেশী সহায়তায় কতিপয় কম্যুনিষ্ট এ 'গোলযোগ' ও 'ষড়যন্ত্র' করে।
তারপরের ঘটনা হলো এক ইতিহাস, তা আপনারা সবাই জানেন।
বরাবর অয়োময়ঃ
আপনার পোস্টের কয়েকটি লাইনের সূত্র ধরে আমার এ পোস্টের অবতারনা। আপনার পোস্টের সবগুলো প্রশ্ন বা মন্তব্যের প্রতিউত্তর আমি দিতে যাচ্ছি না, সেটা সমিচীন ও হবে না। সেগুলোর উত্তর হয়তো মনজু ভাই-ই দিবেন। শুধুমাত্র এ কটি লাইনের উত্তর দেবার মানসে আমার কী-বোর্ড হাতে নেয়া-
মূলতঃ মনজু ভাইয়ের পোস্ট থেকে কিছু উদ্ধৃতি তুলে ধরেছেন আপনি। উদ্ধৃত অংশটুকু এরূপ-
আজ এই দুহাজার এগার সালে যদি কোনো কারণে সরকার ঘোষণা করে- ‘এখন থেকে রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের মত দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা আরবী হবে’! তাহলে কি বাঙালি তার বিরুদ্ধে আন্দোলন করবে? সরকারের বিরুদ্ধে সর্বগ্রাসী আন্দোলন করে অকাতরে রক্ত দেবে? মনে হয় না। কারণ সেটি হলে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করার সময় বা এখন পুনরায় বাহাত্তরের ধর্ম নিরপেক্ষ সংবিধান পূর্ণমুদ্রণের পরও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম থাকতে পারত না। তুলনাটি এজন্য আসছে যে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে বাঙালির বিদ্রোহ বা উপনিবেশের বিরুদ্ধে স্বাধীকারের লড়াই-ই একুশের মূলমন্ত্র। ভাষা সেখানে উপলক্ষ মাত্র। এতো গেল গোড়ার দিককার কথা।
তারপরেই আপনার মন্তব্য-
এই অংশটি পড়ে সেই 'খাঁজ কাটা, খাঁজ কাটা....' কুমির রচনার কথা মনে পড়ে গেল। গুটিকয়েক লোকের যেকোন বিষয়ের লেখায় ইসলাম ধর্মকে টেনে না আনলে পেটের ভাত হজম হয় না।
প্রাসংগিক আলোচ্য বিষয় "ইসলাম"। লেখকের প্রাসংঙ্গিকতার উপর আলোকপাত করে আপনি যেটা বলার চেষ্টা করেছেন সেটা হলো, এই ভাষার জন্য আন্দোলন কিংবা তার পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে সংক্ষুব্ধ বাঙ্গালীর যে মুক্তির আয়োজন, সেখানে 'ইসলাম' এর প্রসঙ্গ বা উল্লেখ কতটুকু গ্রহনযোগ্য। তার উত্তর দিতে গিয়েই এ মন্তব্যের অবতারণা, আকারে বড় হয়ে যাওয়ায় পোস্ট আকারেই দিয়ে দিলাম।
কতগুলি বইয়ের কাছে আমি কৃতজ্ঞ এ পোস্ট লেখার জন্য।
১। ডঃ আহমদ শরীফের পত্রঃ আবুল আহসান চৌধুরীকে লিখিত- ১৬-৯-১৯৮৭
২। ভাষা আন্দোলন প্রসঙ্গঃ কতিপয় দলিল, ২য় খন্ড।
৩। ভাষা আন্দোলনের দলিলঃ আবুল আহসান চৌধুরী।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে আগস্ট, ২০১৫ রাত ১:৪১