- আব্বা, আব্বা, হামাক আজকা কয়ডা বেলুন কিন্যা দিবা ?
ফুলজার হাসে। বলে-
- দিমু না কিসক্? গোটাল দুনিয়াডাই কিন্যা দিমু।
ছেলে হাসতে হাসতে মায়ের দিকে চায়, মা তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলে-
- আজকা বাড়ীত এনা তাড়াতাড়ি অ্যাসো। লিত্তিদিন-ই তো দেরী করো।
- আসমুনি। বাজার থ্যাক্যা কিছু লিয়্যা আসা লাগবি?
- না, ল্যাগবিনা।
- আচ্চা, যাই।
ফুলজার হাসে, মনে মনে। বাচ্চাটার যতো আবদার! তাড়াতাড়ি অফিসে যেতে হবে। এই কথা মনে আসতেই পা দ্রুত চালালো। আজমপুর মেম্বার মোড় থেকে হাউজবিল্ডিং বেশী দূর না। দেশী একটা বড় কোম্পানীতে এমডির ড্রাইভার সে। বেতন তেমন বেশী না। তাই দিয়ে আজমপুরে এক ঘরের একটা বাসায় থাকে। বাসা বললে ভুল হবে, বলা যায় ফ্যামিলি মেস। কম আয়ের মানুষগুলো যেনো মুরগির খোপের মত ঘরগুলোতে নিত্যদিন খাঁচায় পোরা পোষা জন্তু গুলোর মতো বাইরে যায় আর রাত হলে ঘরে ফিরে। সামনা সামনি ঘর গুলোর মাঝে এক গলি, সেই গলির শেষ মাথায় বারোটা ফ্যামিলির দুইটা বাথরুম। গলিটা প্রায়ই বাথরুমের পানিতে ভেসে যায়। তখন ঘরে থাকাই কষ্ট।
ভাবতে ভাবতে ফুলজার অফিসে ঢুকে। বস তাকে দেখে বলে
- তাড়াতাড়ি গাড়ি বের করো, মতিঝিল যাওয়া লাগবে।
- জ্বি স্যার।
বস খুব ভালো মানুষ। ফুলজারের খোঁজ খবর রাখেন। তবে ড্রাইভারের চাকরী আর কি! মদ খেয়ে মাতাল হলে তাকেই বসকে ঘাড়ে করে ঘরে পৌঁছিয়ে দিয়ে আসতে হয়। বসের অনেক টাকা। ফুলজার মাঝে মাঝে কল্পনা করতে চেষ্টা করে নিজেকে বসের স্থানে, পারেনা। তবুও চায়। বস এই ব্যাবসার পাশাপাশি শেয়ারের বিজনেস ও করেন। তার কাছ থেকেই ফুলজার বিভিন্ন টিপস শিখে রেখেছে। সে তেমন বুঝেনা। বাড়ী থেকে গেলো বছর ধান বেচে চল্লিশ হাজার টাকা এনেছিলো, বসের কথামতো খাটিয়ে সেই টাকা আজ প্রায় আড়াই লাখ হয়েছে। আর বেশী কিছু জমলেই সে বাড়ী ফিরে যাবে। পড়াশুনা বেশী করেনি, তাতে কি, একটা গরুর খামার দিয়ে বসবে। আহ! তখন সুখ আর সুখ। ছৈলডারে ভালো স্কুলে পড়াবে, তার মতো ভুল করতে দেয়া যাবে না।
- বুঝলে ফুলজার, শেয়ার বাজার হলো মানুষকে বোকা বানানোর জায়গা। বসের কথাতে তার সম্বিত ফিরে। গাড়ীকে ডাইনে টার্ন নেয়ায়। বস বলতে থাকেন
- যে কিনছে হয় সে বোকা, না হয় যে বেচছে সে বোকা। এটা হলো বোকাদের খেলা।
- জ্বি বস।
- আব্দুল কালাম কোম্পানীর শেয়ার দেখছো? কিনছিলাম ৬৭ টাকা ৫০ পয়সা করে দেড় লাখ টাকার। এখন তার দাম কতো জানো?
- কতো স্যার? বোকার মতো প্রশ্ন করে ফুলজার।
- দেড় লাখের পাশে দুইটা শুন্য বসাও। বস বিগলিত হাসে। ঢোক গেলে ফুলজার। মনে মনে বলে, দেড় কোটি টাকা!
- তা এখন যারা এইগুলা কিনছে, তারা বোকা না বলো? বস প্রশ্ন করে।
- জ্বি স্যার! ঘন ঘন মাথা ঝাকায় ফুলজার।
- না, বোকা না। আজ আমরা মিটিং করবো। আগামী দশ তারিখে আরো শেয়ার কেনা হবে বাজার থেকে, এর দাম আগামী মাসের মাঝে দ্বিগুন হয়ে যাবে। বস আগের চেয়ে আরো বড়ো একটা হাসি দেন। ফুলজারের বোকা মাথায় আগুন জ্বলে! বস এইমাত্র তাকে যে কথাটা বললেন, তার দাম কোটি টাকা।
- স্যার, আগামীকাল থেকে দিন তিনেক একটু ছুটি দেন, বাড়ী যামু। অনুনয়ের সুরে বলে ফুলজার।
- আচ্ছা, সে হবে ক্ষন। ঐ সামনের বিল্ডিংয়ের পার্কিংয়ে ঢুকাও।
লাখ টাকা!
কোটি টাকা!
ফুলজারে চোখে স্বপ্ন ওড়ে। আগামী মাসেই সে খামারটা দিতে পারে, ছেলেকে ভর্তি করাবে জেলা স্কুলে, রাতে বুকের মাঝে বৌটা আরামে মোচড় খেতে খেতে আর বলবে না সকালে খাওয়ার কিছু নেই!
ফুলজার বাড়ী ছোটে। সাত ভাই তার। বাবা বেঁচে। সম্পত্তি এখনো ভাগাভাগি হয়নি। সে তার ভাগের অংশ চায়। বাবা যান খেপে। কতটুকুই বা জমি! সেটুকু বিক্রি করে মাত্র দেড় লাখ টাকার মতো হয়। মাথা খারাপ হয়ে যায় ফুলজারের। বাবা বলে দিয়েছেন ভাগের অংশ নিয়ে গেলে আর বাড়ীতে পা না রাখতে। সে ধার করে। মাসে বিশ পারসেন্ট সুদে দুই মাসের জন্য পাঁচ লাখ টাকা ধার করে। এতো অল্প সময়ে এতো টাকা জোগাড় করতে গিয়েই সুদের অংক টা চড়া হয়ে যায়। ব্যাপারনা! এক মাসের মাঝেই তো এই টাকা বিশ লাখ হয়ে ফেরত আসবে! ফুলজার ঢাকা ছোটে। সবগুলো টাকা দিয়ে কিনে ফেলে আব্দুল কালাম কোম্পানীর শেয়ার।
প্রথম দশ দিনেই তার টাকা হয়ে যায় দ্বিগুন! ফুলজার ঝড়ের গতিতে গাড়ী চালায়। পেছন ফিরে বসকে শুধু মুচকি মুচকি হাসতে দেখে। সেও হাসে, চালাকের হাসি। এই মার্কেটে সেই চালাক। আর সব শালা বোকা! আরও বাড়বে দাম, এই আশায় ফুলজার ধরে রাখে শেয়ার গুলো।
পনেরো দিন পর প্রতিদিনের মতো ফুলজার বাড়ী থেকে বের হয়। বস আজকেও মতিঝিল যাবেন।
- বুঝলে ফুলজার, শেয়ার গুলো গতকাল বেচে দিলাম। নতুন ফ্যাক্টরী দিবো, নীটের।
- জ্বি বস। ফুলজার বসের মুখের দিকে তাকায়। বসের মুখে সেই তেলতেলে হাসি।
মতিঝিলে প্রচন্ড গন্ডগোল! গাড়ি যাবেনা। বস গালি দিতে দিতে গাড়ী থেকে নামেন।
- শুওরের বাচ্চাগুলো গ্রাম থেকে উঠে এসে শহরটাকে ময়লা করে দিচ্ছে! ফুলজার নিজের জামার দিকে তাকায়, নাহ! সেখানে তো কোন ময়লা নেই। কিন্তু গ্যান্জাম কিসের? ফুলজার বস কে নামিয়ে দিয়ে গাড়ী পাশে রেখে এক বেলুন ওয়ালার কাছ থেকে ছেলের জন্য বেলুন কেনে। দৌড়াচ্ছে মানুষ, দৌড়াচ্ছে পুলিশ। ফুলজার পাশের মানুষটিকে জিজ্ঞাসা করে।
- জানেন না, শেয়ার বাজারে ৬০০ পয়েন্ট ধস নেমেছে?
- মানে?
- ও, আপনি বুঝবেন না।
ফুলজার বোঝে না। সে টাকা বোঝে। সে দৌড়ায় তার সিকিউরিটি এক্সচেন্জ অফিসে।
বিকেলের নরম রোদে এই নোংরা শহরের ততধিক নোংরা লেকে ভাসে একটি যুবক। যুবকের হাতে ধরা কয়েকটি বেলুন। তখনো উড়ছে। উড়ছে খামার, উড়ছে স্কুল, উড়ছে স্বপ্ন...
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে আগস্ট, ২০১৫ রাত ১:৫৩