বিডিআরের সদর দপ্তর পিলখানায় সংঘটিত ঘটনার পাঁচ দিনের মাথায় নিজেদের ঘোষিত অবস্থান পাল্টে ফেলেছে জামায়াতে ইসলামী। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি ঘটনার দিন জামায়াত বিদ্রোহীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধানের আহ্বান জানিয়েছিল। সরকারের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বিদ্রোহীরা আত্মসমর্পণ করলে স্বস্তি প্রকাশ করে বিবৃতিও দিয়েছিল জামায়াত। কিন্তু এখন দলটি প্রশ্ন তুলছে, পিলখানায় সেনাবাহিনীর অভিযান না চালিয়ে কেন সরকার বিদ্রোহীদের সঙ্গে আলোচনায় গেল?
গতকাল সোমবার জামায়াতের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে নিজামী প্রশ্ন রাখেন, ‘হত্যাকারীদের সঙ্গে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বৈঠক করলেন কীভাবে? ...সংকট নিরসনের জন্য বেসামরিক উদ্যোগ গ্রহণের যৌক্তিকতা কোথায়? সেনাবাহিনী প্রস্তুত থাকা সত্ত্বেও তাদের অ্যাকশনে যেতে দেওয়া হলো না কেন?’
জামায়াতের হঠাৎ অবস্থান পরিবর্তনের কারণ জানতে চাইলে দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য রফিকুল ইসলাম খান গত ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি এ ধরনের বিবৃতি দেওয়ার কথা অস্বীকার করেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘আমরা তো আলাপ-আলোচনা করেই বিবৃতি দিয়েছি। কাজেই বিবৃতিতে কী বলা হয়েছে, তা আমরা ভালো করেই জানি।’ দলের সাংসদ হামিদুর রহমান আযাদও একই ধরনের কথা বলেন।
নিজামীর প্রথম বিবৃতি: তবে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি জামায়াতের দাপ্তরিক প্যাডে দলের প্রচার বিভাগের সেক্রেটারি মো. তাসনীম আলম স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘বিডিআর সদর দপ্তরে গোলাগুলির ঘটনায় আমরা গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছি। এ ঘটনায় গোটা জাতি উদ্বিগ্ন। আমরা আশা করি, সরকার দ্রুততম সময়ের মধ্যে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করে জাতিকে উদ্বেগমুক্ত করবেন। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সকল মহল দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিবেন বলে দেশবাসী আশা করেন।’
দ্বিতীয় বিবৃতি: গত ২৬ ফেব্রুয়ারি বিডিআরের জওয়ানেরা অস্ত্র সমর্পণ করার পর জামায়াতের প্যাডে তাসনীম আলমের স্বাক্ষরে দলীয় প্রধান মতিউর রহমান নিজামীর আরেকটি বিবৃতি পাঠানো হয়। বিবৃতির শুরুটা হুবহু তুলে ধরা হলো: ‘বিডিআর জওয়ানদের বিদ্রোহের কারণে যে সংকট সৃষ্টি হয়েছিল, তা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান হওয়ায় স্বস্তি প্রকাশ করে এবং পরিস্িথতি মোকাবিলার জন্য সরকারকে যাবতীয় সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ও সাবেক মন্ত্রী মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী নিম্েনাক্ত বিবৃতি প্রদান করেন’।
জামায়াতপ্রধানের বিবৃতি ছিল এ রকম: ‘...২৫ তারিখ এক বিবৃতির মাধ্যমে আমি আশা করেছিলাম সরকার দ্রততম সময়ের মধ্যে এ সংকটের সুষ্ঠু সমাধান করে দেশবাসীকে উদ্বেগমুক্ত করবেন। আমাদের ও দেশবাসীর প্রত্যাশা অনুযায়ী সরকার ও সংশ্লিষ্ট মহল বিডিআর জওয়ানদের বিদ্রোহের কারণে সৃষ্ট সংকট আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সুষ্ঠুভাবে সমাধান করে দেশবাসীকে উদ্বেগ-উৎকন্ঠামুক্ত করেছেন। ফলে আমরা ও দেশবাসী সকলেই স্বস্তিবোধ করছি। এ ঘটনায় আবারও প্রমাণিত হলো জাতীয় ঐক্যই আমাদের মূল শক্তি। জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী যেকোনো পরিস্িথতি মোকাবিলায় আমরা সরকারকে সব ধরনের সহযোগিতা করতে প্রস্তুত।’
এখন জামায়াতের অনেক প্রশ্ন: গতকাল সংবাদ সম্মেলনে দলের আমির বলেন, বিডিআর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে। সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সংশ্লিষ্টদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে তদন্ত কমিটির বদলে বিচার বিভাগ, প্রতিরক্ষা বাহিনী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং সংসদে সব দলের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে তদন্ত কমিটি গঠনের দাবি জানান।
সংবাদ সম্মেলনে নিজামীর তোলা প্রথম প্রশ্নটি ছিল, ‘হত্যাকারীদের সঙ্গে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বৈঠক করলেন কীভাবে?’ একই সঙ্গে অস্ত্র সমর্পণের সময়সীমা কেন দীর্ঘ করা হলো, পিলখানার অভ্যন্তরে বিদ্যুৎ কেন বন্ধ হলো, স্থানীয় সাংসদের পক্ষে পিলখানা থেকে তিন কিলোমিটার পরিধির মধ্যে লোকদের কেন সরে যেতে বলা হলো, হাজার হাজার বিডিআর জওয়ান কীভাবে পালাল, সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার মধ্যে ধানমন্ডিতে ও বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে ‘বিডিআর-জনতা ভাই ভাই’ স্েলাগান দিয়ে কারা মিছিল করেছে−এসব প্রশ্ন তোলেন নিজামী।
জামায়াত নেতা বলেন, ‘বিডিআরের ডিজি মেজর জেনারেল শাকিল নিরাপত্তার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সহযোগিতা চেয়েছিলেন। গত রাতে সংসদে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তৃতায় এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। এর পরও ঘাতকদের সঙ্গে আলোচনা করে তিনি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলেন কোন যুক্তিতে? কারণ জনগণ মনে করে এ সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার সুযোগ নিয়েই ঘাতকেরা নারী নির্যাতন, লুটপাট ও গণকবর দেওয়ার মতো ঘৃণ্য কাজগুলো করার সুযোগ পেয়েছে।’
নিজামী বলেন, হত্যার খবর জানার পরও প্রতিমন্ত্রী পর্যায়ের দলীয় লোকদের দিয়ে সংকট নিরসনের উদ্যোগ নেওয়া হলো কোন যুক্তিতে? তাঁরা স্বল্পতম সময়ের মধ্যে ঘাতকদের ১৪ জন প্রতিনিধির সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করলেন কীভাবে, সে নিয়েও প্রশ্ন তোলেন জামায়াতের প্রধান।
জামায়াতের আমির বলেন, ‘প্রশ্ন উঠেছে, বিদ্রোহী নেতা তৌহিদের নেতৃত্বে যারা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলাপে এল, কারা তাদের ঠিক করলেন এবং সরকারের সর্বোচ্চ ব্যক্তির সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ এরা কীভাবে পেল? তৌহিদই বা কে?’
নিজামী বলেন, বাংলাদেশের সীমান্ত প্রতিরক্ষা ধ্বংস করতে এবং সশস্ত্র বাহিনীকে দুর্বল করার জন্যই বিডিআর বিদ্রোহের নারকীয় ঘটনা ঘটানো হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, প্রথম দিন বিডিআরের বিদ্রোহী জওয়ানদের যেসব কথাবার্তা টিভি চ্যানেলে প্রচারিত হয়েছিল, তা ছিল অসংলগ্ন, দায়িত্বজ্ঞানহীন এবং চরিত্র হননকারী। বিডিআরকে সেনাবাহিনীমুক্ত করার দাবি কিংবা বিডিআরকে সশস্ত্র বাহিনীর মর্যাদা দান ইত্যাদি দাবি ছিল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।