যদি একটু গভীরভাবে চিন্তা করা যায় তবে দেখা যাবে পাশ্চাত্যের যেসব ধারণা সামগ্রিক প্রসার পেয়েছে, তার মূলে আছে ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষার উদ্দেশ্য। তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা একসূত্রে গাঁথা, কিছু মানুষেকে অতীব ক্ষমতাধর করে তোলা আর বৈষম্য বাড়িয়ে বাকীদেরকে এই ক্ষমতাধর ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর সেবাদাসে পরিণত করা। আজকের বিশ্বায়নের ধারণার পিছনেও এই একই চিন্তা কাজ করছে, আর আমরা সেটি না বুঝেই পাশ্চাত্যের দেয়া ছন্দে গাইতে- নাচতে শুরু করে দিয়েছি।
কোন একটি গোষ্ঠীকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ক্ষমতাধর করে তুলবে এ সব রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। যেমন আমেরিকার কিছু ধনী ব্যবসায়ী গোষ্ঠী আজ প্রবল ক্ষমতাধর, তারাই দেশের সবকিছু ঠিক করে দেয় পিছন থেকে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচিত সরকার কেবল একটি মুখোশ মাত্র। সেখানেও যে জীবনবোধ সম্পন্ন মানুষ নেই তা নয়, সেখানেও অন্য চিন্তা করার মানুষ যে নেই তা নয়, কিন্তু ক্ষুদ্র গোষ্ঠীকে ক্ষমতাধর করার হাতিয়ার গণতন্ত্রকে এমনভাবে প্রচার করা হয়েছে যে তার বলয় ভেঙ্গে বাইরে আসা তাদের সাধ্যের বাইরে। ইউরোপে বেশীরভাগ দেশে রাজতন্ত্র আর দলভিত্তিক গণতন্ত্র এতদিন হাতে হাত রেখে চলেছে, কিন্তু ইদানীং ধনী ব্যবসায়ী গোষ্ঠীও সেখানে সক্রিয় হয়েছে, তাদের চেষ্টায় তৈরী হয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এখন সেখানকার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরাও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে এ একত্রীকরণের তোড়ে।
আজকের বাংলাদেশের দিকে তাকালে দেখব আমরাও যেন ধীরে ধীরে পাশ্চাত্যের মত ব্যবসায়ীদের ক্ষমতাধর করার পথে এগিয়ে যাচ্ছি, যারা নির্বাচিত সরকারের ঘাড়ে বন্দুক রেখে ক্ষমতা প্রয়োগ করবে। কেবল এই নির্বাচিত সরকারের ক্ষমতা ঠিক রাখার জন্য যাদের যাদেরকে হাতে রাখা দরকার, তাদের কিছু স্বার্থ দেখা হবে, হতে পারে তারা সরকারী আমলা, হতে পারে তারা মিলিটারী, হতে পারে তারা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও ছাত্র, হতে পারে তারা অন্য কেউ। তবে এটি নিশ্চিত যে সেখানে জনসাধারণের, বিশেষ করে গ্রামের মানুষের স্বার্থ উপেক্ষিতই থেকে যাবে। আমি অবশ্য এ জন্য ব্যবসায়ী বা রাজনীতিক কাউকেই দোষারোপ করছি না, যে পদ্ধতি চলছে তারা তার খেলার পুতুল। স্বয়ংক্রিয়ভাবেই তাদের এ চরিত্র তৈরী হবে ও তার বিকাশ হবে। এটি হচ্ছে দেশের চলার জন্য পদ্ধতি বাছাইয়ের সমস্যা। বর্তমান গণতান্ত্রিক পদ্ধতি আমাদেরকে এ অবস্থা থেকে কোনদিনও ওঠাতে পারবে না।
আর পদ্ধতি নিয়ে নতুন চিন্তাভাবনা করার ক্ষমতা আছে কার? এ দেশের জনগণ অনেক ত্যাগ স্বীকার করে যাদেরকে উচ্চ শিক্ষার ব্যবস্থা করে দিয়েছে, দেশ বিদেশের উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা লাভের সুযোগ করে দিয়েছে, একমাত্র তারাই পারে নতুন পদ্ধতি নিয়ে চিন্তা করতে, এবং দায়িত্বটা মূলত: তাদেরই। তাই যদি দোষারোপ কাউকে করতে হয়, সেটি করতে হবে আমাদেরকেই, অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদেরকেই। আমাদের পক্ষেই সম্ভব নতুন পথ খুঁজে বের করা, অথচ আমরা তা না করে আমাদের থেকে যারা কম শিক্ষার সুযোগ পেয়েছে তাদের ধারণার নীচে নতজানু হয়ে বিভিন্ন ধারায় বিভক্ত হয়ে যাচ্ছি, কিছু ছোটখাট স্বার্থের জন্য। তাই আমাদেরকেই এগিয়ে আসতে হবে নিজেদের এসব ছোটখাট স্বার্থের কথা ভুলে খোলা মন নিয়ে, নতুন পদ্ধতি খুঁজতে হবে আমাদের মতন করে, যেখানে বঞ্চিত ও গ্রামের জনগণের স্বার্থ আসবে সবার আগে।