মোবাইল কোর্টের মত একটি নিয়ম যদি আমাদের শিক্ষিত মধ্যবিত্তের বা উচ্চবিত্তের উপর আরোপ করা হত তাহলে আমরা আন্দোলনে নেমে যেতাম। একটি বাস্তব উদাহরণ দিয়েই ফেলি। কম্পিউটার ব্যবহারে সফটওয়ার পাইরেসী বা চুরি আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে একটি বড় অপরাধ। কিন্তু বাংলাদেশে বিচারক, শিক্ষক থেকে শুরু করে রাজনীতিবিদ, নীতি নির্ধারক, কয়জন বুকে হাত রেখে বলতে পারবে যে সে চুরি করা সফটওয়্যার ব্যবহার করছে না? আমরা নিশ্চয়ই নিজেরা নানা অজুহাত তৈরী করে নিচ্ছি, “পৃথিবীর বিশাল অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে এ অন্যায় থেকে দূরে থাকতে হলে আমরা তো কম্পিউটারই ব্যবহার করতে পারব না, আরও পিছিয়ে যাব, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়া শত শত বছর পিছিয়ে যাবে”। এখন আন্তর্জাতিক কোন সংস্থা থেকে আমাদের ঘরে- অফিসে যদি মোবাইল কোর্ট পাঠানো হয় যে চুরি করা সফটওয়্যার পেলে কম্পিউটার সহ সবকিছূ বাজেয়াপ্ত তো করবেই, সবাইকে ধরে ধরে জেলে নিয়ে পুরবে, তাহলে আমাদের কাছে কেমন লাগবে? এবার ভাবুন, যে ব্যবসায়ীদেরকে আমরা মোবাইল কোর্টে ফেলছি, তারও কি এ ধরণের কোন যৌক্তিক অজুহাত আছে কিনা, বা আমাদের, অর্থাৎ আমাদের মত শিক্ষিত নীতিনির্ধারকদের তৈরী কোন অন্যায্য নিয়ম কানুন তাকে এ ‘অন্যায়’ করতে বাধ্য করেছে কিনা? গত অনেক বছর ধরে ক্ষুদ্র শিল্পের জগতে বিচরণ করে আমি বুঝতে পেরেছি যে ঐতিহাসিক কারণে সৃষ্ট আমাদের কিছু মানসিকতা আর ইংরেজ ঔপনিবেশিক সরকারের উদ্দেশ্যমূলক শিল্প ধ্বংস করার প্রক্রিয়ার উত্তরসূরী আইন কানুন ও তার ফলে সৃষ্ট পরিবেশ এখনও দেশে ক্ষুদ্র শিল্প বিকাশের প্রধান বাধা। সুস্থভাবে বিকাশ লাভ করার সুযোগ ও পরিবেশ দেশের ক্ষুদ্র উৎপাদকেরা পাচ্ছে না। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ থাকলে আজকে এক অসুখ, কালকে অপর অসুখ হতেই থাকবে।
যে ব্যবসায়ী দেশী বা বিদেশী ব্র্যান্ডটির লেবেল তার পণ্যে লাগিয়ে বিক্রী করার চেষ্টা করছে, নিম্নমানের বা ভেজাল পণ্য উৎপাদন করছে, তার পিছনে সরকারের ভুল আইন কানুনের ফলে সৃষ্ট পরিবেশের প্রভাব কতটা তা না দেখে কেবল সে ব্যবসায়ীকে সম্পূর্ণ দায়ী করছি আমরা। তার সারা জীবনের সঞ্চয়, মেধা ও পরিশ্রম দিয়ে গড়ে তোলা একটি শিল্প মুহূর্তে ধ্বংস করে দিয়ে মোবাইল কোর্টের ম্যজিষ্ট্রেট আত্মতৃপ্তি পেতে পারেন, তার কর্মদক্ষতা দেখাবার সুযোগ পেতে পারেন, আমরাও পত্রিকায় তা পড়ে একটি স্যাডিষ্ট আনন্দ পেতে পারি, কিন্তু তা কতটা ন্যায্য, বা তা যে উদ্দেশ্যে করা, তা কতটুকু সফল হবে তা ভেবে দেখা দরকার। যুগ যুগ ধরে মোবাইল কোর্ট চলছে, কিন্তু আমরা স্থায়ী কোন সমাধান কি পেয়েছি? আমাদের ভাবতে হবে, আমরা কি কেবল কাউকে শাস্তি দিয়ে আত্মতৃপ্তি পেতে চাই, না সত্যিকারে সমস্যার প্রতিকার ও সমাধান চাই।