পুরুষ বা মহিলা উভয়ের জন্যই, পরচর্চায় সুবিধা ও অসুবিধা দুটোই রয়েছে।
এটা তো বলাই যয় যে প্রাচীন অতীতে, মধ্যপ্রস্তর যুগের একদল মানুষ সদ্য হত্যা করা কোন জন্তুকে ঘিরে দাঁড়িয়ে ছিল, তারা এমন একজনের সম্পর্কে কথা বলছিল যে ঐ শিকারসংগহের জমায়েতে উপস্থিত ছিল না।
এগিয়ে আসুন আরও ১৫,০০০ বছর সামনে, আমরা এখনো সে রকমই। অফিসপাড়া গালগপ্নে মশগুল থাকে - যার যার দৃষ্টিভঙ্গি বিচারে - হয় স্বাভাবিক দৈনন্দিন কথাবার্তা অথবা এমন কোন আলোচনা যা মনোবল, উৎপাদন, এমনকি স্বাস্থ্যর উপর প্রভাব বিস্তারের অনুষঙ্গ হিসাবে থাকতে পারে। পরচর্চার অন্ধকার দিকটি হল, মেয়েদের ক্ষেত্রে পরচর্চা হতে পারে বিশেষ সমস্যা, এরা এর প্রধান চর্চাকারী এবং, সম্ভবত, যারা এর থেকে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
পরচর্চা বিষয়ে সাবধান হতে হবে এটা আমরা সবাই জানি, কিন্তু এই চক্রের মায়ার টান খুব প্রলুব্ধকর হয়ে থাকে। এর থেকে বেরিয়ে আসা খুব কষ্টের কারণ মানুষের মধ্যে যোগসূত্র তৈরীর ক্ষেত্রে পরচর্চা আদর্শ স্থানীয় প্রচার ব্যবস্থা। আমাস্টারডাম বিশ্ববিদ্যালয়ে একদল গবেষক দেখেছেন যে অফিসের আলোচনার ৯০ ভাগ হল পরচর্চা। জর্জিয়া ইন্সটিটিউট অব টেকনোলোজি এর এক গবেষণার উপসংহারে বলা হয়েছে যে অফিস ইমেইলের শতকরা ১৫ ভাগ হল পরচর্চা বা রটনা।
কেন আমরা এটা করি? আরো ভাল হয় যদি প্রশ্নটি এভাবে করি, কেন আমরা এটা করতে পছন্দ করি?
নৃবিজ্ঞনীরা বিশ্বাস করেন যে মানুষে মানুষে যোগসূত্র তৈরীর ক্ষেত্রে মানব ইতিহাসে পরচর্চা একটা মাধ্যম হিসাবে কাজ করেছে। কখনো কখনো তা, দলের পক্ষ হয়ে যারা কাজ করতে চায় না তাদের ঘায়েল করার অস্ত্র হিসাবে। মানুষের ভেতর অন্য মানুষকে জানার ব্যাপারে একধনে শক্তিশালী তাড়নার রয়েছে। এটা হল সেই মুদ্ধতা যাতে সাডেনফ্রয়েড (schadenfreude) -এর আস্বাদ পাওয়া যায়। বছরে এ থেকে তৈরি হয় বিভিন্ন সাময়িকী ও টেলিভিশন অনুষ্ঠানের সেলিব্রেটি গালগপ্প, ৩ বিলিয়নেরও বেশি ডলারের শিল্প এখানে রয়েছে।
অনেকে মনে করেন, অন্তত পক্ষে কর্মক্ষেত্রে, পরচর্চার একটা উপকরী দিক রয়েছে। নর্থইস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. জ্যাক লেভিন (author of Gossip: The Inside Scoop ) বলেন, এটা আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে ভাল হতে পারে। সার্বিকদৃষ্টিতে, তিনি বিশ্বাস করেন পরচর্চা এক রকম তাড়না যা সামাজিক ও ব্যবসায়িক যোগাযোগের মাধ্যমে বন্ধন তৈরি করে। অন্যরা এটাকে বিবেচনা করে থাকেন, মালিক পক্ষ্যের কোন সিদ্ধান্তের পেছনের কি কি কারণ থাকতে পারে তা আলোচনা করার উপায় হিসাবে।
গবেষক ও অভিজ্ঞরা যারা পরচর্চার শিকার হয়েছেন, উভয় পক্ষই মনে করেন যে সম্পর্কে ক্ষেত্রে পরচর্চা ক্ষত তৈরি করতে পারে। এবং এমন একটা পরিবেশ তৈরি হতে পারে যাতে ভয় ও প্রতিশোধ স্পৃহা জাগে। আর্দ্রতা যেভাবে ঝড় বয়ে আনে পরচর্চাও কর্মক্ষেত্রে উত্তেজনায় ইন্ধন যোগাতে পারে একইভাবে। কর্মক্ষেত্রে চাপ তৈরির ক্ষেত্রে অন্যান্য আরো গবেষণায় দেখা গেছে যে পরচর্চা যেসব সমস্যা তৈরি করে তাতে করে উৎপাদন কমে যাওয়া থেকে শুরু করে অসুস্থতা বা অনুপস্থিতির হার বাড়িয়ে দিতে পারে।
এখন প্রশ্ন হতে পারে নারীরা পুরুষের চেয়ে বেশি পরচর্চা করে কি না, এবং সেই অনুসারে সর্বাধিক ভুক্তভুগি কি না। এরপরে হোচট খেতে হয় দ্বিমুখী নীতির ধারনায়: মহিলারা যেটাকে গালগপ্প বা পরচর্চা বলে পুরুষেরা তাকে বলে অবসরের বকবকানি। পার্থক্যের আরও জায়গা রয়েছে, যে প্রক্রিয়ায় নারী ও পুরুষেরা যোগাযোগ করে তার উপর নির্ভর করে সেই যোগাযোগের ফলাফল। দেখা যায় নারী ও পুরুষের যোগাযোগের প্রভাব একই রকম নয়। গবেষণায় দেখা যায়, নারীরা পুরুষের চাইতে অনেক বেশি শব্দ ব্যবহার করেন। বিশেষত নারীতে নারীতে আলোচনায় এই শব্দগুলো হয় ব্যক্তি কেন্দ্রিক। আন্তরিক বিনিময় - আমি একটু কিছু জানাই তুমিও একটু আমাকে বল - নারীদের মধ্যে বন্ধুত্ব তৈরিতে এটাই আঠা বা গামের মতো কাজ করে। নারীরা যেখানে সম্পর্ক তৈরি করে অনুভুতির ভিত্তিতে, পুরুষেরা করে তাদের কর্মকান্ডের ভিত্তিতে, সাথে সীমিত অন্তরঙ্গতাও থাকে। এতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই যোগযোগরে ধরণের উপর ভিত্তি করে গালগপ্প বা পরচর্চার লিঙ্গীয় ভাষায় তৈরি হয়। নারীদের ক্ষেত্রে তা হয় ব্যক্তি কেন্দ্রিক : ‘ আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়, সে একটা সভার আলোচনায় যেভাবে লোকজনকে এভাবে বাঁধা দিতে পারে।’ পুরুষের আড্ডায় এমন আলাপ হতে পারে স্টাটাস নিয়ে : ‘তুমি কি শুনেছ টেড মার্সিডিজ বেঞ্চ কিনেছে?’
পরচর্চার সবচেয়ে খারাপ দিকটি ফুটে উঠে যখন এটা অস্ত্র হিসাবে ব্যবহৃত হয় - হোক সেটা, সমান ক্ষমতা সম্পন্ন পরষ্পর বিরোধী দুটি দলে মধ্যকার যুদ্ধের অস্ত্র বা উর্ধ্বতন কোন কর্মকর্তার নিজের জায়গা নিরাপদ করার কোন অস্ত্র। নিয়োগ দাতারা জানেন পরচর্চা কি রকম ক্ষতি করতে পারে কিন্তু তাদের এখানে উন্মুক্ত যোগাযোগের আহ্বান করা ছাড়া করার মতো আর কিছু নেই। ‘কোন পরচর্চা নয়’ এমন কোন নীতি বা জোন তৈরি করা হতে পারে কর্মক্ষেত্রে অধিকার বা বাক স্বাধীনতার সাথে সাংঘর্ষিক, কাকে কি বলা হয়েছিল এবং এতে কোন ক্ষতিকর কিছু ছিল কি-না তা নির্ধারন করার দুরুহ বিধায়।
জীবনের সত্য হল এটাই যে যেখান দল থাকবে সেখানেই পরচর্চা থাকবে। আমরা এক ধরনের সুতোয় গাঁথা। কিন্তু যা স্বাভাবিক কর্মক্ষেত্রে তাই ক্ষতিকর হতে পারে - মনোবলের দিক থেকে, উৎপাদনের দিক থেকে বা ক্যারিয়ারের দিক থেকে।
সবচেয়ে ভাল চর্চা হতে পারে নিজেকে Mirandize করা বা মনে করিয়ে দেয়া : শুধু এইটুকু ধরে নাও যে তুমি যাই বল না কেন তা এক সময় তোমার বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হতে পারে।
---
সাডেনফয়েড -(জার্মান ভাষা থেকে নেয়া)- হল এক ধরনের আনন্দ যা অপরের দুঃখ দুর্দশা থেকে আহরিত হয়। ‘আঘাত বা ক্ষতির আনন্দ’ বলতে যা বুঝায় তাই।
Dr. Peggy Drexler - ব্লগ থেকে নেয়া
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা ডিসেম্বর, ২০১৪ দুপুর ১২:৩৭