যখন ওরা ব্রেভ্রুট ত্যাগ করে, ফিফ্থ এভেনিউ তখন রোদে ঝকঝক করছিল। এরপর ওয়াশিংটন স্কয়ারের দিকে হাঁটতে শুরু করে। যদিও এখন নভেম্বর মাস তারপরও উষ্ণ রোদ এবং সবকিছু দেখতে রবিবারে সকালের মতোই মনে হচ্ছিল-বাস, সুন্দর পোশাক পরিহিত হাঁটতে থাকা যুগল এবং বন্ধ জানালার দালানগুলো।
রোদ্রময় শহরের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে মাইকেল ফ্রান্সিসের বাহু শক্ত করে ধরল। প্রায় হাসি হাসি মুখে হালকা চালে হাঁটছে। কারণ ওরা ঘুমিয়ে ছিল অনেক বেলা করে, সকালের নাস্তাটা ছিল ভাল এবং এটা ছিল রবিবার। মাইকেল কোটের বোতাম খুলে দিলে মৃদু বাতাসে তা ঝাপটাতে থাকে। কম বয়সী ও সুখী-চেহারার লোকেদের ভিড়ে চুপচাপ ওরা হাঁটছে। অবশ্য যেমন করেই হোক না, কেন যেন এই কম বয়সী ও সুখ-চেহারার লোকেরাই নিউ ইয়র্ক শহরের এ অংশটার সিংহভাগ জনসংখ্যার দাবীদার।
’দেখে চল’ ফ্রান্সিস বলল, যখন ওরা এইট্থ স্ট্রিট পাড় হচ্ছিল। ‘তুমি তোমার ঘাড় ভেঙ্গে ফেলবে।’
‘মাইকেল হাসল এবং ফ্রান্সিসও হাসল তার সাথে।
‘সে অত সুন্দরী নয়’ ফ্রান্সিস বলল। ‘যা হোক, অত বেশি সুন্দরী না, যে তাকাতে তাকাতে ঘাড় ভাঙ্গতে হবে।’
মাইকেল আবার হাসল। এবার সে উচ্চস্বরে হাসল কিন্তু খুব জোড় দিয়ে নয়। ‘মেয়েটা দেখতে ভাল ছিল না, তবে ত্বকটা চমৎকার। গ্রাম্য মেয়েদের ত্বক। তুমি কীভাবে জানলে আমি ওর দিকে তাকিয়ে ছিলাম?’ কাৎ করে পড়া হ্যাটের নিচ থেকে ওর মাথাটা খাড়া ঘুড়িয়ে স্বামীর দিকে চেয়ে ফ্রান্সিস হাসল, ‘মাইক ডার্লিং...’ ও বলল।
মাইকেল হেসে উঠে, এবার একটু হাসল শুধু। ‘ঠিক আছে’ ও বলল ‘স্পষ্টত এখানে প্রমাণ আছে। আমাকে মাফ কর। ওর ত্বকের জন্যই আমি তাকিয়ে ছিলাম। ঐ রকম ত্বক নিউ ইয়র্কে তুমি খুব একটা দেখবে না।’
ফ্রান্সিস হালকাভাবে মাইকেলের বাহুতে চাপড় দিল। এবং আর একটু দ্রুত যাওয়ার জন্য ওয়াশিংটন স্কয়ারের দিকে টানতে থাকে। ‘চমৎকার সকাল আজ’ ফ্রান্সিস বলল। ‘অসম্ভব সুন্দর সকাল। আমি সকালের নাস্তা তোমার সাথে করলে, তা আমাকে সারা দিনের জন্য একটা ভাল লাগার অনুভূতি এনে দেয়।’
‘টনিক’ মাইকেল বলল। ‘সকালে ওঠ। মাইকের সাথে রোল ও কফি খাও। সারা দিন দারুন কাটাবে, নিশ্চিত।’
‘কথাটা তা-ই। অবশ্য, আমি পুরো রাত ঘুমিয়েছি, দড়ির মতো তোমার চারপাশে ঘুরেছি।’
‘শনিবারের রাত’ মাইকেল বলল। ‘আমি এই ধরনের স্বাধীনতা দিয়ে থাকি তখনই যখন সপ্তাহের কাজ শেষ হয়।’
‘তুমি মোটা হয়ে যাচ্ছ।’ ফ্রান্সিস বলল।
‘সত্যি নাকি? ওহিওর হালকা পাতলা মানুষটি।’
‘আমার ভালই লাগে। আরো পাঁচ পাউন্ড বেশি স্বামী পাওয়া গেল।’
‘আমারও ভাল লাগে’ মাইকেল গম্ভির স্বরে বলল।
‘আমার মাথায় একটা চিন্তা আসছে’
‘আমার স্ত্রীর মাথায় একটা চিন্তা আসছে। ওগো সুন্দরী ললনা।’
‘চল, সারা দিন আর কারো দিকে না তাকাই।’ ফ্রান্সিস বলল। ‘চল শুধু দুজন দুজনায় হারিয়ে যাই। তুমি আর আমি। আমরা সব সময় লোকেদের ঘাড়ের উপর পড়ে আছি, তাদের স্কচ খাচ্ছি, অথবা তারা আমাদের স্কচ খাচ্ছে। আমরা একজন আরেকজনকে দেখি কেবল বিছানায়...।’
‘স্বাক্ষাতের সেরা জায়গা’ মাইকেল বলল। ‘অনেক সময় নিয়ে বিছানায় থাক এবং যতজনের সাথে এযাবৎ তোমার পরিচয় হয়েছে তারা তোমাকে দেখা দেবে সেখানে।’
‘কি বিজ্ঞ ব্যক্তি আমার’ ফ্রান্সিস বলল। ‘আমি সত্যি সত্যি বলছি।
‘ঠিক আছে। আমি সত্যি সত্যি শুনছি।’
‘আমি আমার স্বামীর সাথে সারা দিন ধরে বেড়াতে চাই। আমি চাই সে শুধু আমার সাথে কথা বলুক এবং শুধু আমার কথাই শুনুক।’
‘কে আমাদের বাঁধা দিচ্ছে?’ মাইকেল জিজ্ঞাসা করল। ‘আমার স্ত্রীর সাথে রবিবারের এই নিবিড় স্বাক্ষাতে কে আমাদের বাঁধা দিতে চায়? কারা?’
‘স্টিভেনসন। তারা একটার সময় আচমকা আমাদের নিয়ে যেতে আসবে এবং গ্রামে বেড়াতে নিয়ে যাবে।’
‘বড় লোকের বাচ্চা ইস্টিভেনসনের দল।’ মাইকেল বলল। ‘ব্যাপারটা পরিস্কার। তারা শা করে চলে গেলেই পারে। নিজেরাই তো গাড়ি নিয়ে গ্রাম থেকে ঘুরে আসতে পারে।’
‘এটা কি তবে ডেট?’
‘হ্যাঁ ডেট’
ফ্রান্সিস মাইকের উপর গড়িয়ে পড়ল এবং ওর কানের অগ্রভাগে চুমু খেল।
‘ডালিং’ মাইকেল বলল, ‘এটা ফিফ্থ এভেনিউ’
‘আমাকে তবে পরিকল্পনাটা করতে দাও।’ ফ্রান্সিস বলল, ‘এক পরিকল্পিত ররিবারে, এক জোড়া তরুণ-তরুণী এই নিউ ইয়র্ক শহরে-যাদের হাতে রয়েছে ওড়াবার মতো যথেষ্ঠ পরিমাণ টাকা।’
‘আস্তে আস্তে’
‘চল প্রথমে দেখব ফুটবল খেলা। পেশাদারি ফুটবল।’ বলল ফ্রান্সিস, কারণ ও জানতো মাইকেল ফুটবল ভালবাসে। ‘বড় দলগুলো খেলছে। আজ সারাদিন বাইরে থাকাটা খুব চমৎকার জমবে। খিদে পেলে পরে গিয়ে উপস্থিত হব ক্যানাভাগে এবং কামারের অ্যাপ্রোনের মতো বড়সর একটা স্টেক নেব, সাথে থাকবে এক বোতল ওয়াইন। তারপর যাব ফিল্মমার্টে, ওখানে একটা নতুন ফ্রেঞ্চ সিনেমা এসেছে। সবাই বলে... বলে। তুমি আমার কথা শুনছ?’
‘অবশ্যই’ ও বলল, কাল চুলের হ্যাটবিহীন মেয়েটার ওপর থেকে তার দৃষ্টি সরিয়ে নিল, ড্যান্সারদের মতো কারে চুল কাটা, মনে হচ্ছে যেন হেলমেট। মেয়েটা ওকে অতিক্রম করছিল আত্মসচেতন দৃঢ়তায়। মার্জিত, প্রশংসিত ড্যান্সারদের যেমন থাকে। হাঁটছিল কোট ছাড়া, দেখতে মনে হচ্ছিল নিরেট শক্তিশালী, ছেলেদের মতো সমতল পেট। পাছার নিচে ওর স্কার্ট জোড়েসোড়ে দুলছিল কারন মেয়েটা ড্যান্সার, আর একটা কারন হল ও জানত মাইকেল তার দিকে তাকিয়ে আছে। অতিক্রম করার সময় মেয়েটা নিজে নিজেই একটু হাসল এবং এ সব কিছুই মাইকেল খেয়াল করছিল তার স্ত্রীর দিকে ফিরে তাকানোর পূর্বে।’
‘অবশ্যই।’ ও বলল, ‘আমরা বড় দলগুলোর খেলা দেখতে যাব এবং আমরা স্টেক খেতে যাচ্ছি এবং ফ্রান্সের সিনেমা দেখব। পছন্দ হয়েছে তোমার?’
‘সেটাই।’ ফ্রান্সিস সরাসরি বলল। ‘এটাই আজকের কর্মসূচী। অথবা তুমি শুধু ফিফ্থ এভেনিউ দিয়ে যাওয়া-আসা করতে পার।’
‘না’ মাইকেল সর্তকভাবে বলল। ‘মোটেই না।’
‘তুমি সব সময় মেয়েদের দিকে তাকিয়ে থাক।' ফ্রান্সিস বলল। ‘এই নিউ ইয়র্ক শহরের প্রত্যেকটা মেয়েমানুষের দিকে।’
‘ওহ্ হয়েছে’ মাইকেল কৌতুক করার ভান করে বলল। ‘শুধুমাত্র সুন্দরীদের দিকে। সব মিলিয়ে কতজন সুন্দুরী আছে এই নিউ ইয়র্ক শহরে? সতের?’
‘আরও বেশি। অন্তত তোমার দিক থেকে তাই মনে হয়, তুমি যেখানেই যাও।’
‘সত্য হল না। হয়তো মাঝে মাঝে আমি তাকাই যখন ওরা পাশ কেটে যায়। রাস্তায়, আমি স্বীকার করছি, রাস্তায় আমি মেয়েদের দিকে একবারই তাকাই যখন...।’
‘সবখানে’ ফ্রান্সিস বলল। ‘সব জায়গায়, যত বস্তাপচা জায়গায় আমারা যাই না কেন। খাবরের দোকান, সাবওয়ে, প্রেক্ষাগৃহ, মিলনায়তন, কনসার্ট।’
‘এখন ডার্লিং’ মাইকেল বলল। ‘আমি সবকিছুর দিকে তাকাই। সৃষ্টিকর্তা আমাকে চোখ দিয়েছেন। আমি পুরুষের দিকে তাকাই, নারীর দিকে তাকাই। আমি সাবওয়ে খনন, চলমান দৃশ্যাবলী এবং মাঠের ক্ষুদ্র ফুলটিও দেখি। আমি নিয়মিত না হলেও, খাপছাড়াভাবে এই বিশ্ব ব্রহ্মমা- অবলোকন করি।’
‘তোমার উচিত তোমার চোখ দিয়ে তোমার নিজের চাহনিটা দেখা’ ফ্রান্সিস বলল। ‘যেভাবে তুমি বিশ্বব্রহ্মমা- অবলোকন কর ফিফ্থ এভেনিউতে।’
‘আমি বিবাহিত সুখী মানুষ বুঝেছ।’ মাইকেল আদর করে বুঝেশুনে কনুইয়ের গুতো দিল। ‘পুরো বিংশ শতকের জন্য একটাই উদাহারণ- মিস্টার এবং মিসেস মাইক লুমিজ।’
‘তুমি তাই মনে কর?’
‘ফ্রান্সিস, বেবি...’
‘তুমি কি সত্যি বিবাহিত সুখি মানুষ?’
‘অবশ্যই’ মাইকেল বলল, মনে হচ্ছে পুরো রবিবারের সকালটা সিসার মতো গলেগলে নামছে তার ভেতর দিয়ে। ‘এইভাবে কথা বলে কোন চুলোর কথা তুমি বোঝাতে চাচ্ছ?’
‘জানতে পারলে খুশি হতাম।’ ফ্রান্সিস হাঁটার গতি বাড়িয়ে দেয় সোজা সামনের দিকে তাকিয়ে। যখন সে তর্কে জড়ায় বা খারাপ লাগে এমনটাই করে ও সাধারনত।
‘আমি দারুণভাবে সুখি এবং বিবাহিত একজন পুরুষ।’ মাইকেল ধের্য্যের সাথে বলল। ‘এই নিউ ইয়র্ক শহরের পনের ও ষাট বছর বয়সী সকল পুরুষের ঈর্ষার পাত্র আমি।’
‘ফাজলামো কর না’ ফ্রান্সিস বলল।
‘আমার একটা সুন্দর বাড়ি আছে।’ মাইকেল বলল। ‘চমৎকার বই, ছবিসংগ্রহ এবং চমৎকার কিছু বন্ধু আছে। এমন একটা শহরে আমি বাস করি যে আমার যা ইচ্ছা তাই পছন্দ করতে পারি এখানে, যে কাজটা করি আমি তা পছন্দ করি, যে নারীটিকে আমার পছন্দ তার সাথেই বাস করি। যখনই কোন ভাল কিছু ঘটে, আমি কি তোমর কাছে ছুটে যাই না? যখন খারাপ কিছু ঘটে, আমি কে তোমার কাঁধে মাথা রেখে কাঁদি না?’
‘হ্যাঁ’ ফ্রান্সিস বলল। ‘যতগুলি মেয়েমানুষ তোমাকে পাশ কেটে যায় তুমি সবার দিকে তাকাও।’
‘বাড়াবাড়ি করছ।’
‘প্রত্যেক মেয়ে’ ফ্রান্সিস মাইকেলের বাহু থেকে হাত ছাড়িয়ে নিল। ‘যদি সে সুন্দরী না হয় তুমি বেশ তাড়াতাড়ি চোখ নামিয়ে ফেল। যদি সে আধা সুন্দুরী হয় তুমি তাকে সাতটা পদক্ষেপ পর্যন্ত খেয়াল কর...।’
‘ওহ্ খোদা, ফ্রান্সিস!’
‘যদি সে সুন্দরী হয় সত্যিকার অর্থে তুমি ঘাড় ভেঙ্গে ফেল...’
‘হেই, চল একটু পান করি’ মাইকেল হাঁটা বন্ধ করে বলল।
‘মাত্র আমরা সকালের নাস্তা করেছি।’
‘এখন শোন ডার্লিং’ মাইক বলল, সর্তকভাবে শব্দ নির্বাচন করতে করতে। ‘সুন্দর একটা দিন আজ, আমাদের দু’জনেরই ভাল লাগছে। কোন কারন নেই মুহুর্তগুলো নষ্ট করার। চল চমৎকার একটি রবিবার কাটাই আজ।’
‘আমি সুন্দর রবিবার কাটাতে পারব যদি ওভাবে মেয়েদের দিকে না তাকাও। তোমার প্রতিটা চাহনিতে মনে হয় ফিফ্থ এভেনিউয়ের প্রতিটা স্কার্টের পেছনে যদি ছুটতে না পার তাহলে তুমি মারা যাবে।’
‘চল একটা পানীয় নিই।’ মাইকেল বলল।
‘আমার তৃষ্ণা নেই।’
‘তুমি কি চাও, মারপিট?’
‘না’ অনেক কষ্ট নিয়ে ফ্রান্সিস বলল। মাইকেল ভয়ানক কষ্ট বোধ করল ওর জন্য। ‘আমি মারপিট করতে চাই না। জানি না কেন এটা শুরু করেছিলাম। ঠিক আছে, বাদ দাও। চল সময়টা ভালভাবে কাটাই।’
ওরা সচেতনভাবে হাতে হাত রাখল। গ্রাষ্মের পোশাক পরা ইটালিয়ান, শিশুদের বহনকারী দু’চাকার গাড়ি এ সবের মাঝ দিয়ে হাঁটতে থাকে কোন কথা না বলে।
‘মনে হচ্ছে আজকের খেলা জমবে।’ কিছুক্ষণ পর ফ্রান্সিস বলল। সকালের নাস্তার সময় এবং হাঁটা শুরুর মুহুর্তে যে ভঙ্গিমায় কথা বলেছিল তার বর্তমান কন্ঠস্বরে তারই একটা সুন্দর নকল যেন। ‘আমি পেশাদার ফুটবল খেলা পছন্দ করি। খেলোয়াড়রা একজন আরেকজনকে এমনভাবে মারে যেন একেক জন কংক্রিটের দেয়াল। মাইকেলকে হাসানোর চেষ্টায় ও বলল।
‘তোমাকে কিছু কথা বলতে চাই’ মাইকেল গম্ভীরভাবে বলল। ‘আমি অন্য কোন মেয়েমানুষকে স্পর্শ করি নি। গত পাঁচ বছরে, একবারও না।’
‘আচ্ছা, ঠিক আছে’ ফ্রান্সিস বলল।
‘তুমি বিশ্বাস কর, কর না?’
‘ঠিক আছে, ঠিক আছে’
পার্কে ছোট ছোট গাছ আর ঝোপের নিচ দিয়ে, জনাকীর্ণ বেঞ্চের মাঝ দিয়ে ওরা হাঁটছে।
‘আমার আর যাচাই করে কাজ নেই।’ ফ্রান্সিস এমনভাবে বলল যেন ও নিজের সাথে কথা বলছে। ‘আমি নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করছি যে এ সব কথার কোন অর্থ নেই। কিছু পুরুষ এমনই, আমি নিজেকে বোঝাই, যা তাদের নাগালের বাইরে তাও তাদের চেখে দেখা চাই।’
‘কিছু মেয়ে মানুষও ঐ রকম’ মাইকেল বলল। ‘আমার জীবনে অমন কয়েক জনকে দেখেছি।’
‘কোন পুরুষের দিকে আমি তাকাই না।’ ফ্রান্সিস সোজা হাঁটতে হাঁটতে বলল। ‘তোমার সাথে দ্বিতীয়বার যেদিন বের হই ঐ দিন থেকে।’
‘এ রকম কোন আইন নেই।’ মাইকেল বলল।
‘আমার মনে হয়ে আমার ভেতরটা পচে গলে যায়, যখন দেখি কোন মেয়ে মানুষ আমাদের পাশ কাটাচ্ছে আর তুমি তার দিকে তাকিয়ে আছে। তোমার তাকানোতে আমি সেই চাহনিটা খুঁজে পাই যা দিয়ে তুমি প্রথমবার আমার দিকে তাকিয়েছিলে, ম্যাক্সওয়েলের বাড়িতে। অনেক লোকজন, একটি সবুজ হ্যাট মাথায় দিয়ে তুমি দাঁড়িয়েছিলে শোবার ঘরে রেডিওটির পাশে।’
‘হ্যাটের কথা মনে আছে’ মাইকেল বলল।
‘একই চাহনি,’ ফ্রান্সিস বলল, ‘আমার খুব ভয় লাগে। দেখে শংকিত হই।’
‘শশশ, প্লিজ ডার্লিং শশশ....’
‘মনে হচ্ছে তেষ্টা পেয়েছে এখন’ ফ্রান্সিস বলল।
ওরা এইটথ্ স্ট্রিটের একটা বারে গেল কোন কথা না বলে...।
বোতাম লাগাতে লাগাতে মাইকেল হেঁটে এল, বারের দিকে পা ফেলে ওর চকচকে পরিপাটি জুতো জোড়ার দিকে তাকায়। একটা জানলার পাশে বসল, সূর্যের আলো ঢুকছে এদিকটায়। আনন্দদায়ক উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়ছে ফায়ার প্লেসের আগুন থেকে। ছোটখাট জাপানি ওয়েটার এগিয়ে এল এবং কিছু প্রিটজেল বিস্কুট নামিয়ে রেখে হাসিমুখে চেয়ে রইল ওদের দিকে।
‘সকালের নাস্তার পর তুমি কি খেতে চাও?’ মাইকেল বলল।
‘ব্রান্ডি নাও’ ফ্রান্সিস বলল।
‘কোরভোইজার’ মাইকেল ওয়েটারকে বলল্ ‘দুইটা কোরভোইজার।’
ওয়েটার গ্লাস নিয়ে এলে, সূর্যের আলোয় বসে ওরা ব্রান্ডি পান করল। অর্ধেকটা পান করার পর মাইকেল একটু পানি খেয়ে নিল।
‘আমি মেয়েদের দিকে তাকাই।’ সে বলল, ‘ঠিক আছে। আমি বলব না কথাটা ভুল বা সঠিক। যদি আমি চলার পথে ওদের পাশ কাটাই, আমি তাকাই না, আমি তোমাকে বোকা বানাচ্ছি, নিজেও বোকা বনছি।’
‘তুমি ওদের দিকে এমন করে তাকাও যেন তুমি ওদের চাও’ ফ্রান্সিস ওর ব্রান্ডির গ্লাস খেলাচ্ছলে নাড়তে নাড়তে বলল। ‘প্রতিটা মেয়ের দিকে।’
‘একভাবে’ নরম কন্ঠে মাইকেল বলল, ‘এক দিক থেকে তা সত্য। আমি নিজে থেকে কিছু করি না, কিন্তু কথাটা সত্য।’
‘আমি জানি তা। সে জন্যই আমার কাছে খারাপ লাগে।’
‘আরেকটা ব্রান্ডি’ মাইকেল ডাকল। ‘ওয়েটার, আর দু’টি ব্রান্ডি।’
‘তুমি আমাকে কেন কষ্ট দাও?’ ফ্রান্সিস জিজ্ঞাসা করল।
‘তুমি কি করছ?’
মাইকেল চোখ বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল, আঙ্গুলের ডগা দিয়ে চোখ দু’টিকে আলতো করে ঘষা দিল। ‘মেয়েরা যেভাবে তাকায় আমার দেখতে ভাল লাগে। নিউ ইর্য়ক শহরের সেরা জিনিসগুলোর যেটা আমি সবচেয়ে পছন্দ করি তা হল এর সারি সারি নারীর মিছিল। ওহিও থেকে প্রথম যখন আমি নিউ ইয়র্কে আসি এটাই আমি সর্বপ্রথম লক্ষ্য করিছিলাম, শহর জুড়ে শত সহস্র ভয়াবহ সব সুন্দরী নারী। রুদ্ধশ্বাসে কেবল চেয়ে থেকে আমি শহরে ঘুরে বেড়াতাম।’
‘আহা একেবারে খোকা,’ ফ্রান্সিস বলল. ‘বাচ্চাদের মতো কথা বল না।’
‘ভেবে দেখ,’ মাইকেল বলল। ‘ভেবে দেখ আবার। আমার বয়স বাড়ছে, প্রায় মধ্য বয়সের কাছাকাছি আমি এখন, শরীরে মেদ বাড়ছে। আমি এখনও তিনটার সময় ফিফ্থ এভেনিউতে পূর্ব দিকের সড়ক ধরে ফিফ্থ ও ফিফটি সেভেন সড়রেক মাঝ দিয়ে হাঁটতে ভালবাসি। তারা সবাই তখন বাইরে বের হয়, পরনে তাদের ফার আর মাথায় হ্যাট, দেখে মনে হবে সবাই কেনাকাটা করতে বেড়িয়েছে। পৃথিবীর সমস্ত জায়গা থেকে সবকিছু এসে জমা হয়েছে এইট ব্লকে, উৎকৃষ্ট ফার, সুন্দর জামা, সবচেয়ে চটপটে মেয়ে। যদি পছন্দের হয় খরচ করতে কোন দ্বিধা নেই তাদের মধ্যে। ওদের পাশ কেটে যাবার সময় এমন ঠান্ডা চোখে তোমার দিকে চাইবে যে তুমি ভেবে নেবে যে ওরা তোমার দিকে তাকিয়ে নেই।'
জাপানি ওয়েটার হাসি মুখে পানীয়র গ্লাস দু’টি নামিয়ে রাখল।
‘সবকিছু ঠিক আছে?’ সে বলল।
‘চমৎকার!’ মাইকেল বলল।
‘শুধুমাত্র পঁয়তাল্লিশ ডলারের হ্যাট আর কয়েকটা ফার কোটের জন্যই যদি...’ ফ্রান্সিস বলল।
‘শুধুমাত্র ফার কোট বা হ্যাটের জন্য না, কোন নারীর প্রতি বিশেষ দেখার ভঙ্গি, বুঝেছ’ সে বলল।‘তোমার তা না শুনলেও চলবে।’
‘আমি শুনতে চাই।’
‘অফিসের মেয়েদের আমি পছন্দ করি। চশমা চোখে, পরিপাটি, চটপটে, কর্তব্যের বিষয়ে পরিষ্কার ধারনা, সব সময় নিজেকে সযত্নে রাখে ওরা।’ তার চোখ জালার বাইরে ধীরে চলমান লোকজনের উপর। ‘লাঞ্চের সময় ফরটি-ফোর্থ স্ট্রিটের মেয়েদের আমার খুব ভাল লাগে। অভিনেত্রী। চমৎকার পোশাক পরে সুদর্শন ছেলেদের সাথে কথা বলছে, সার্দির বাইরে প্রাণোচ্ছল আর তারুণ্যের সাজে অপেক্ষারত যাতে করে প্রযোজকদের নজর কারতে পারে। ম্যাসির মেয়ে বিক্রয়কর্মীদের আমার ভাল লাগে, মহিলা খদ্দেরদের অপেক্ষায় রেখে প্রথমত তারা তোমার উপর মনোযোগ দেবে কারন তুমি পুরুষ; মোজা, বই আর ফনোগ্রাফের সূচ বিক্রির সময় তোমার সাথে ফষ্টিনষ্টি করবে। এসব বিষয় আমার মধ্যে জমে আছে কারণ আমি ওদের নিয়ে বিগত দশ বছর ধরে ভাবছি। আর তুমি এ ব্যাপারে জানতে চাইছ যখন, তবে এই সেই বিষয়।’
‘বলে যাও’ ফ্রান্সিস বলল।
‘যখন আমি নিউ ইর্য়ক শহর নিয়ে ভাবি, আমার মাথায় থাকে এইসব মেয়েরা; ইহুদি, ইটালিয়ান, আইরিশ, পোলিশ, চাইনিজ, জার্মান, নিগ্রো, স্পেনিশ, রাশান মেয়েরা, সবাই এই মিছিলের অন্তর্ভুক্ত। আমি জানি না এটা নিজের কোন বিশেষ দোষ বা গুণ কি-না, নাকি আমার পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া এই শহরের সকল পুরুষই একই অনুভূতি বহন করছে, কিন্তু আমার মনে হয় এই শহরে আমি যেন একটা পিকনিকের মধ্যে আছি। আমার ভাল লাগে থিয়েটারে মহিলাদের পাশের আসনে বসতে, বিখ্যাত সব সুন্দরীরা যারা ছয় ঘন্টা সময় নেয় সাজগোজ করতে, এবং ফুটবল খেলায় লাল গালের যুবতী মেয়েদের, আর যখন গরমের দিন আসে, গ্রীষ্মের পোশাক পরিহিত মেয়েদের...।’ সে তার ব্রান্ডি শেষ করেছে। ‘এটাই সেই গল্প। তুমি যেটা জানতে চেয়েছিলে। আমি তাদের দিকে না তাকিয়ে পারি না। আমি তাদের কামনা না করে থাকতে পারি না।’
‘তুমি তাদের কামনা কর’ কোন রকম ভাব পরিবর্তন না করে ফ্রান্সিস বলল। ‘তুমি তাই বললে।’
‘হ্যাঁ তাই,’ মাইকেল বলল, ক্ষুব্ধ হয়ে এবং কোন কিছুর তোয়াক্কা না করে, কারণ ফ্রান্সিসই তাকে এখানে টেনে এনেছে। ‘তুমি বিষয়টা আলোচনা জন্য বের করে এনেছ, আমরা এটা পুরোপুরি আলোচনা না করে ছাড়ছি না।’
ফ্রান্সিস তার পানীয় শেষ করে আরও দু-তিন ঢোক নিল। ‘তুমি বল তুমি আমায় ভালবাস।’
‘আমি তোমাকে ভালবাসি, কিন্তু আমি ওদেরও কামনা করি, বুঝেছ।’
‘আমিও সুন্দরী’ ফ্রান্সিস বলল। ‘ওদের যে কারও মতোই।’
‘তুমিও সুন্দরী’ মাইকেল মন থেকে বলল।
‘আমি তোমার জন্য ভাল,’ ফ্রান্সিস যু্িক্ত দেখিয়ে বলল। ‘আমি ভাল গৃহিনী, ভাল গৃহকর্মী, ভাল বন্ধু। আমি যে কোন কিছু তোমার জন্য করতে পারি।’
‘আমি জানি,’ মাইকেল বলল। সে তার হাত বের করে ওর হাত নিজের মুঠোয় পুরল।
‘তুমি কি মুক্তি পেলে খুশি হবে...’ ফ্রান্সিস বলল।
‘শশশ’
‘সত্য কথা বল।’ ও তার হাত ছাড়িয়ে নিল।
মাইকেল আঙ্গুল দিয়ে তার গ্লাসের মাথায় টোকা দিতে লাগল। ‘হ্যাঁ’ সে নরম স্বরে বলল। ‘মাঝে মাঝে আমার মনে হয়ে আমি বুঝি মুক্তি চাই।’
‘ভাল,’ ফ্রান্সিস টেবিলে তাল ঠুকতে ঠুকতে বলল, একটু স্পর্ধার সাথে। ‘যে কোন সময় তুমি বলবে...’
‘বোকামি কর না।’ মাইকেল তার চেয়ার টেনে নিয়ে গেল ওর পাশে এবং ওর উরুতে চাপড় দিল।
‘ফ্রান্সিস নিরবে কাঁদতে শুরু করল, সামান্য ঝুঁকে ওর রুমালে চোখের পানি মুছে যাতে করে বারের অন্য কেউ বুঝতে না পারে।’ ‘একদিন,’ ও কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘তুমি সত্যি সত্যি ছেড়ে যাবে...’
মাইকেল কোন কিছু বলল না। সে বসে বারটেন্ডারের লেবুর খোসা ছাড়ানো দেখছিল।
‘তাই না?’ ফ্রান্সিস ক্রুদ্ধভাবে বলল। ‘কথা বল। আমাকে বল সত্যি কি-না?’
‘হয়তো,’ মাইকেল বলল। সে তার চেয়ারটি আগের জায়গায় নিয়ে গেল। ‘আমি তা কি করে জানব?’
‘তুমি জান,’ ফ্রান্সিস জোর দিয়ে বলল। ‘জান না?’
‘হ্যাঁ,’ মাইকেল কিছুক্ষণ পর বলল। ‘আমি জানি।’
ফ্রান্সিসের কান্না থামল তখন। দু-তিন বার রুমালে নাক ঝেড়ে সে রুমালটি ফেলে দিল। ওর চেহারায় কোন কিছু প্রকাশ পেল না। ‘আমাকে অন্তত একটা উপকার কর,’ ও বলল।
‘অবশ্যই।’
‘ঐ মেয়েটা কত সুন্দর বা ওটা দেখতে কত চটপটে এসব বলা বন্ধ কর। চমৎকার চোখ, চমৎকার স্তন, সুন্দর গঠন, ভাল কন্ঠ,’ ও মাইকেলের কন্ঠ অনুকরন করল। ‘এটা তোমার নিজের মধ্যে রাখ। এতে আমার আগ্রহ নেই।’
মাইকেল ওয়েটারের দিকে হাত ইশারা করল। ‘আমি তা নিজের মধ্যে রাখব।’
ফ্রান্সিস তার চোখের কোনায় ঝাঁকুনি দিল। ‘আরেকটি ব্রান্ডি,’ ও ওয়েটারকে বলল।
‘দুইটা,’ মাইকেল বলল।
‘ইয়েস, ম্যাম, ইয়েস, স্যার,’ ওয়েটার আরেক দিকে ঘুরে যেতে যেতে বলল।
ফ্রান্সিস টেবিলের উপর দিয়ে তার দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। ‘তুমি কি চাও আমি স্টিভেনসনদের আসতে বলি?’ ও জানতে চাইল। ‘আমার মনে হয় গ্রামে যাওয়াটা চমৎকার হবে।’
‘অবশ্যই,’ মাইকেল বলল। ‘তাদের আসতে বল।’
ও টেবিল থেকে উঠে গেল এবং রুমের টেলিফোনের দিকে এগিয়ে গেল। মাইকেল ওর হাঁটা লক্ষ্য করল, ভাবছে, কি সুন্দর একটি মেয়ে, কি চমৎকার পা।’
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই নভেম্বর, ২০১৪ রাত ৯:২০