বিজয় সরনীর বিমান ভাস্কর্যটা পেড়িয়ে রোকেয়া সরনীতে পড়েই বাসটা মেরে দিল একটা প্রাইভেট কারকে। বাসভর্তি মানুষ। গাদানো। টক্কর হতেই গাড়ীটা বাসের সামনে গিয়ে দাড়িয়ে পড়লো। পেছনের দরজার দিকটা চ্যাপ্টা হয়ে গেছে। বিশাল ঘটনা। মুহূর্তে ট্রাফিক সার্জেন্ট এলো। বাস ও কারের জায়গা হলো রাস্তার পাশে।
আমি যখন মহাখালী থেকে বাসটায় উঠি তখন প্যাসেঞ্জাররা ড্রাইভার ও হেলপারের চোদ্দগুষ্টি উদ্ধার করছিলো। কেউ বলছিলো, সালার ভাইগো কাছে আমাগো সময়ের কোন দাম নাই? রাস্তার মধ্যে দাড়া কইরা প্যাসেঞ্জার উঠাইস! বাঞ্চোত! আরেকজন আরেক কাঠি সরস। বললো, চুতিয়াদের পিটিয়ে পাছার চামড়া লাল কইরা দেওয়া উচিত, সারাদিন কাজ শেষ কইরা বাসায় একটু তাড়াতাড়ি ফিরুম তার কোন নিশ্চয়তা নাই!
শশব্যস্ত ঘর ফেরত যাত্রীরা বাসে উঠেও দৌড়ুতে থাকে। একটু আগে, যদি আরেকটু আগে যাওয়া যায়। কিন্তু প্রাইভেট কারকে ধাক্কা মেরে বাসটা এমন জায়গায় ফেসে গেছে যে অন্য কোন বাসে ওঠার জো নাই। চীন বাংলাদেশে মৈত্রী হলের কিছুটা আগে, চন্দ্রীমার পূর্ব দিকের ওয়ালের প্রায় শেষঅংশটায় কোন বাস দাড়াবে না। বিজয় সরনীর মোড় পর্যন্ত গেলেও কোন লাভ নাই। সব বাসে বাদুর ঝোলা মানুষ।
অগত্যা যাত্রীরা নেমে গেলো বাস রক্ষায়। সবাই ড্রাইভারের পক্ষে সাফাই দিলো। দোষ প্রাইভেট কারের ড্রাইভারের। তবে দুর্ভাগ্য যে, প্রাইভেট গাড়ীর মালিকরা সবসময় ট্রাফিক সার্জেন্টদের আনুকূল্য পেয়ে থাকে। তাদের বক্তব্য, যাত্রীরা বাসের ড্রাইভারকে সাপোর্ট দেবে - এ তো জানা কথাই, যাত্রীদের সাক্ষী কার্যকরী না।
বাস্তবতা হচ্ছে সংঘর্ষটা যেভাবে হয়েছে কোন যাত্রীর সেটা খেয়াল করার কথা নয়। আর পথচারীদের বোঝা তো আরো দুরূহ। কিন্তু উৎসাহী চার-পাচজন পথচারীও জুটে গেল। তারা আবার দুইভাগে বিভক্ত। কেউ বাসের পক্ষে, কেউ প্রাইভেট কারের পক্ষে।
ইতোমধ্যে কেটে গেছে আধঘন্টা। তড়িঘড়ি করে বাসায় ফিরতে উদগ্রীবরা তখনও বসে আছে বাসের অভ্যন্তরে। ওদিকে পুলিশ ঘটা করে বলে গেছে কয়েকবার, এই বাস যাবে না। কিন্তু বাসের একদম শেষ সাড়ির যাত্রীদের কোন খেয়ালই নেই। কেউ পা দিয়ে দুপদাপ শব্দ করছে, জানালা পেটাচ্ছে, ড্রাইভারকে গালাগাল করছে। আসল ঘটনা সম্বন্ধে তাদের ধারণাও বিভিন্নমুখী। গাড়ীকে ধাক্কা দিয়েছে এই সংবাদটা সামনে থেকে পেছনে আসতে আসতে নানা রঙ পেয়েছে। একজন বললো, প্রাইভেট কারগুলারে তো মারাই উচিত! আরেকজন বললো, না না, সামনে মনে হয় জ্যাম! একদম নিরীহ টাইপের একজন বললো, এতক্ষণ বইসা রইলাম ফাও ফাও!
বাসযাত্রীদের মধ্যে কয়েকজন নেতা বনে গেল। একজন পরামর্শ দিল সামনের সাড়ির কয়েকজন নারী-যাত্রীদের দিয়ে ট্রাফিক সার্জেন্টকে অনুরোধ করাতে। তাদের সাক্ষ্যে কাজ হতে পারে। একজন উৎসাহী নারী নেমেও এলো। সার্জেন্ট তাকে পাত্তাই দিলো না। ওদিকে যাত্রীদের মধ্যে কিছুটা দ্বিধাবিভক্ত উগ্রতা দেখা গেল। একজন ড্রাইভারকে বললো, আপনি চালাইয়া চইলা যান তো, দেখি হালারা কি করে! আরেকজন ভেতর থেকে পুলিশকে উদ্দেশ্য করে দুর্ধষ্য সব গালি ছুড়তে থাকলো। ক্ষেপাটে বাসযাত্রীরা সে গালি শুনে শিশ দিয়ে উঠলো। এমনকি নারী যাত্রীদেরও তাতে সায় থাকলো। একজন বললো, ঠিকই আছে, গালিরই যোগ্য!
যখন নিশ্চিত হওয়া গেল বাসটাকে পুলিশ যেতে দেব না তখন আমি অন্য উপায় খুঁজতে থাকলাম। কিন্তু প্রায় ৪৫ মিনিট হয়ে গেলেও সব যাত্রীরা বাসকে মুক্ত করার আন্দোলনে নিয়োজিত। তাড়াতাড়ি বাসায় ফেরার আর কোন তাড়া নেই। এই জায়গা থেকে মিরপুর ফেরার একমাত্র অবলম্বন এখন রিকশা। কমপক্ষে ভাড়া ত্রিশটাকা। যাত্রীদের বেশীরভাগের কাছে এই টাকা ভারী মনে হতে পারে। কেউ কেউ অন্য বাস থামাতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু এত যাত্রী দেখে বাসগুলোও স্পিড বাড়িয়ে দিল। একটা বাসে উঠতে গিয়েও হাতল ফসকে গেল। যাত্রীরা হৈহৈ করে ওঠে - নামেন নামেন!
দশমিনিট পরে একটা রিকশা পাওয়া গেল। আন্দোলন করে আর লাভ নাই দেখে রিকশায় উঠে পড়লাম। নির্বাচন কমিশন অফিস পেড়িয়ে সামনে এগুতেই দেখলাম একটা বাস দাড়িয়ে। সেই বাসটাই যেটাতে আমাকে উঠতে দিল না। সবযাত্রী বাসের পিছনে দাড়িয়ে বাস থামাবার চেষ্টা করছে।
মুখের কোনে হাসি খেলে গেল। পরম তৃপ্তিতে পায়ের উপরে পা তুলে আয়েশী ভংগীতে একটা সিগারেট ধরালাম। যাত্রীদের দিকে ধুয়োর কুন্ডলী ছেড়ে দিয়ে মনে মনে বললাম, যা বাবা! তোরাও আমার না, আমিও তোদের না, খাইট্টা খা!
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে নভেম্বর, ২০০৮ দুপুর ১২:০১