সিএনজি ছুটছে ধানমন্ডির দিকে, একটু একটু করে জ্যাম এড়িয়ে ।
স্নিগ্ধা চুপ করে বসে আছে , মাঝে মাঝে শুধু দু একটি কথা বলছে। আর মামুন কথা বলেই যাচ্ছে, বলেই যাচ্ছে। কথা বলা বললে অবশ্য ভুল হবে। যে সব কথা বলছে সেগুলো সব স্নিগ্ধা কে প্যারা দেওয়ার জন্য । অন্য সময় স্নিগ্ধা বক বক করে বেশী আর মামুন চুপ থাকে। কিন্তু আজ উল্টো হচ্ছে।
মামুন- ওখানে কিন্তু আমার ক্লাসে অনেক সুন্দর সুন্দর মেয়ে থাকবে । আমি কিন্তু সবার সাথেই ফ্রেন্ডশিপ করবো । দু একটা সুন্দরী ক্লাসমেট থাকলে মজা হবে খুব।
স্নিগ্ধা- ঈশ! আসছে। সুন্দরী মেয়ের সাথে ফ্রেন্ডশিপ করবে । কোন মেয়ে টেয়ের সাথে ফ্রেন্ডশিপ করা চলবেনা । শুধুমাত্র ছেলেদের সাথে মিশবে তুমি ।
মামুন- হাহা ! কি বল তুমি ? ওখানে তো ছেলে মেয়েরা সাবলেট এ বাসা ভাড়া নিয়ে একসাথে থাকে আর তুমি ফ্রেন্ডশিপ করতেই নিষেধ করছ ?
আচ্ছা, জব পেতে দেরি হলে যদি টাকা পয়সা শর্ট পরে, আলাদা বাসা নিতে না পারি তাহলে কিন্তু কোন মেয়ের সাথে সাবলেটে উঠে যাব ।
স্নিগ্ধা- জার্মানি কোথায় আমি কিন্তু চিনি । ওখানে গিয়ে যদি আমাকে ভুলে যাও তুমি, আমি কিন্তু ঠিক গিয়ে হাজির হবো । আর যদি একা যেতে নাও পারি, দরকার পরলে একটা জার্মানি প্রবাসী ছেলেকে বিয়ে করে যাবো আর নয়তো অন্য ছেলেকে বিয়ে করে হানিমুনে জার্মানি গিয়ে তারপর পালিয়ে যাবো তোমার কাছে। আমাকে ভুলে যাওয়া চলবেনা, কিছুতেই না।
মামুন মজা পাচ্ছে খুব ।
সে আবার বললো– ও আচ্ছা, আরেকটা কথা। আমি কিন্তু ডেইলি তোমাকে ফোন দিতে পারবোনা । পড়াশোনা, জব, বাসার কাজ সব মিলিয়ে অনেক বিজি থাকবো । ১৫ দিনে একবার ফোন দিব, ওকে ? মাসে একবার হলে অবশ্য আমার জন্য আরও ভালো হয় ।
এই বলে মুচকি হাসতে হাসতে স্নিগ্ধার দিকে তাকালো মামুন ।
মামুন দেখলো স্নিগ্ধা আর কিছু বলছেনা। একদম চুপ হয়ে গিয়েছে এখন । তার মানে সে মন খারাপ করেছে ও অভিমান করেছে ।
মামুন সবসময়ই এ ধরনের দুষ্টুমি করে স্নিগ্ধার সাথে আর স্নিগ্ধাও খুনসুটি করে, যদি মন ভালো থাকে । কিন্তু এখন আর তা করছেনা ।
মামুন চেয়েছিল একটু দুষ্টুমি করে স্নিগ্ধার মনটা ভালো করে দিতে। সে জার্মানি চলে যাচ্ছে বলে মেয়েটার খুব মন খারাপ ।
মেয়েটি যে তাকে কেন এতো ভালোবাসে তা নিজেও জানেনা মামুন। পরিবারের সব বাধা বিপত্তি উপেক্ষা করে সবসময় মামুনকে সাপোর্ট দিয়ে আসছে, অপেক্ষা করছে মামুনের জন্য । বাসা থেকে আর না পেরে শেষ পর্যন্ত স্নিগ্ধার আগে তার ছোট বোনের বিয়ে দিতে হয়েছে। তবুও মেয়েটির মনে কোন ক্ষোভ বা আফসোস নেই। পাগলপনা ভালোবাসা অনেক দেখেছে মামুন। কিন্তু স্নিগ্ধার মত করে এত যত্ন আর আবেগ নিয়ে কেউ কাউকে ভালোবাসতে পারে বলে মনে হয়না মামুনের। মামুন বলতেই পাগল সে। আর এমন ভাবে সে ভালোবাসে মামুনকে, যে মামুনের মাঝে মাঝে স্নিগ্ধা কে প্রেমিকা মনে না হয়ে ওর বউ মনে হয় ।
একবার মামুন দুষ্টুমি করে স্নিগ্ধা কে জিজ্ঞেস করেছিল
আচ্ছা, ধর যদি কখনো তোমার আম্মু এবং আমি দুইজনেরই কিডনি নষ্ট হয়ে গেল এবং তোমার রক্তের গ্রুপের সাথে আমাদেরটা মিলে গেল। তখন তুমি কাকে কিডনি দিবে? আমি নাকি তোমার আম্মু ?
স্নিগ্ধা প্রথমে কোন উত্তর দেয়নি । হাসছিল। পরে বলল আমি আমার দুইটা কিডনি দুইজন কে দিয়ে দিব।
মামুন বলল, না ডাক্তার তো তা করবেনা। তুমি তোমার একটা কিডনিই দিতে পারবে এবং যে কোন একজনকেই ।
স্নিগ্ধা চুপ করে হাসছে ।
মামুন বলল, তুমি কিছু না বললেও আমি জানি তুমি কাকে দিবে, আমাকে ।
স্নিগ্ধা বলল, হা আমি জানি অবশ্যই আম্মুকে দেওয়া উচিত কিন্তু তোমার নামটাই কেন মনে আসছে। আমি তোমাকেই দিব। এই বলে হেসে দিল স্নিগ্ধা।
এই পাগলী মেয়েটিকে মামুন তার জীবনসঙ্গিনী হিসেবে স্বীকৃতি দিতে পারবে কিনা তা নিয়ে মামুন চিন্তিত। নিজেকে ওইরকম ভাবে প্রতিষ্ঠিত না করে ওর কথা যে বাসায় জানাতেও পারছেনা ।
সিএনজি তে স্নিগ্ধাকে চুপ থাকতে দেখে মামুন ভাবছে,
যাহ! দুষ্টুমিটা কি একটু বেশী হয়ে গেল? বেচারির মন ভালো করতে গিয়ে দেখি আরও খারাপ করে দিলাম ।
স্নিগ্ধার মনে তখন শুধু একটাই ভাবনা । সিএনজি যতই গন্তব্বের দিকে এগোচ্ছে ততই মনে হচ্ছে আর কিছুক্ষণ পরেইতো পৌঁছে যাবো আর তখন আমাকে নেমে যেতে হবে ।
তারপর আগামীকাল রাতে জার্মানির ফ্লাইট। কতদুরে চলে যাবে ও। ভাবতেই বুকের ভেতরটা কেমন করে উঠে । কবে দেশে ফিরবে, আবার কবে দেখা হবে কোন ঠিক নেই। যে মানুষটাকে একটা দিন না দেখে থাকতে পারিনা, সারাদিনে একটুখানি কথা না বললে ভালো লাগেনা, তাকে ছাড়া কিভাবে থাকবো । তার উপর, এখানেই একটু বেশী বিজি থাকলে মামুনকে পাওয়া যায়না, আর ওখানে অত ব্যস্ততার মাঝেতো আমাকে ভুলেই যাবে ও ।
বাসা থেকে বিয়ের জন্য সমানে প্রেশার দিচ্ছে । মামুনের বাসায়ও এখনও আমার কথা কিছু জানেনা । ও মাত্র যাচ্ছে, কতদিনে মোটামোটি একটু ইস্টাবলিশ হবে আর আমার কথা বাসায় বলবে ।
আল্লাহ না করুক যদি কোন কারনে মামুনকে হারাতে হয়। ভাবতেই দুনিয়া উলট পালট লাগে স্নিগ্ধার।
এসব কিছু চিন্তা করতে করতে সিএনজি কাছাকাছি চলে এলো । স্নিগ্ধার হার্টবিট বেড়ে গেল । আর মাত্র কিছুক্ষণ আছে ও আমার পাশে ।
মামুনের মাথা থেকেও ততক্ষণে দুষ্টুমির ভূত নেমে গিয়েছে ।
মামুন স্নিগ্ধার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে শুধু বলল “চিন্তা করোনা। আমি একটু গুছিয়ে নিয়েই বাসায় বলবো তোমার কথা” ।
স্নিগ্ধার ইচ্ছে করছে, মামুনকে জড়িয়ে ধরে ইচ্ছেমত কাঁদবে ।
কিন্তু কখনোই যে ও মামুনের সামনে কিছু বলতে পারেনা আর কাঁদতেও পারেনা । দেখা করা শেষ করে রিকশায় বাসায় ফেরার পথে কাঁদে আর যা বলার তা ম্যাসেজ দেয়।
সিএনজি গন্তব্বে চলে এসেছে। স্নিগ্ধা নেমে গেল । তেমন কিছু না বলে শুধু বলল “আসি তাহলে, পরে ফোন দিও” ।
মামুন বলল - ঠিক আছে
দুইজনেই এমন ভাব নিল যেন এ দেখা রেগুলার দেখার মত ।
সিএনজি থেকে নেমে স্নিগ্ধা আর কান্না চেপে রাখতে পারলোনা । রাস্তার একটা দোকানের এক কোনায় দাড়িয়ে কাঁদতে লাগলো ।
কিছুক্ষণ পরেই মামুনের ফোন এলো ।
সে জিগ্যেস করলো -তুমি কোথায় ?
স্নিগ্ধা বলল- এইতো বাসায় ঢুকবো
মামুন বলল-- না, তুমি তো বাসার দিকে যাওনি। তুমি রাস্তায় দাড়িয়ে কাঁদছ।
স্নিগ্ধা কান্না জড়িত কণ্ঠে বলল – আমি এখন বাসায় যাবো না । আমার কোন কিছু ভালো লাগছেনা । আমি কোথাও গিয়ে চুপচাপ বসে থাকবো আর কাঁদবো। পরে বাসায় যাবো ।
মামুন ওকে ধমক দিয়ে বলল – যা বলছি চুপচাপ শুনবে। একটা কথাও না । বাসায় যেতে বলেছি যাও।
স্নিগ্ধা কখনও মামুনের কথা না শুনে থাকতে পারেনা । আজও লক্ষ্মী মেয়ের মত ওর কথামত চোখ মুছে বাসায় চলে গেল ।
বাসায় যাওয়ার কিছুক্ষণ পর মামুন ফোন দিল – বাসায় গিয়েছ?
স্নিগ্ধা শুধু বলল – হা
মামুন বলল – ঠিক আছে। রাখলাম।
রাতে আর তেমন কথা হলনা দুজনের। গোছগাছ ও বাসার সবাইকে নিয়ে মামুন খুব বিজি ।
আজকে মামুনের ফ্লাইট। রাত এগারোটায় । দুপুরের দিকে স্নিগ্ধা একবার ফোন দিল - কোথায় তুমি?"
মামুন বলল – এইতো একটু ধানমন্ডি এসেছি
স্নিগ্ধার খুব মন চাইলো মামুনকে বলে, যে একটু দেখা করবো। কিন্তু সেই সাহস আর পেলোনা ।
সন্ধ্যা ৬ টায় স্নিগ্ধা ম্যাসেজ পাঠালো । "বের হয়েছ বাসা থেকে?"
মামুন রিপ্লাই দিল – হা, মাত্র বের হলাম
স্নিগ্ধা ম্যাসেজ ব্যাক করলো – ইমিগ্রেশন এ ঢুকে ফোন দিও কিন্তু
মামুন রিপ্লাই দিল - ঠিক আছে
রাত ৮ টায় মামুন ফোন দিল – হেই, কি অবস্থা। মাত্র ইমিগ্রেশন ক্রস করলাম ।
স্নিগ্ধা বলল – সব ঠিকঠাক আছেতো ? মামুন বলল হা সব ঠিক আছে । আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু একটা ব্যাড নিউজ আছে ।
স্নিগ্ধা উদগ্রীব হয়ে বলল – কি হয়েছে ?
মামুন বলল- বাসা থেকে বের হবার সময় শুনলাম নানু মারা গিয়েছে । বুঝতেই পারছ আম্মার কি অবস্থা। এমনিতেই আমি চলে যাচ্ছি বলে মন খারাপ তার উপর নানুও চলে গেল । সারা রাস্তা আম্মা কাঁদতে কাঁদতে এসেছে । এয়ারপোর্টে বেশীক্ষণ থাকতে পারেনি আমার কাছে । তাড়াতাড়ি চলে গেল নানুর ওখানে যাবে বলে। আমারও খুব মন খারাপ লাগছে ।
স্নিগ্ধা বলল- মন খারাপ করোনা । আল্লাহ ভরসা ।
মামুন বলল- এই আমি রাখছি। আমাকে ডাকছে , যাচ্ছি। পরে ফোন দিচ্ছি।
স্নিগ্ধা বলল- ঠিক আছে ।
৯ টা বেজে গেল। স্নিগ্ধা মামুনের ফোনের জন্য অপেক্ষা করছে । কিন্তু কোন ফোন আর এলোনা ।
স্নিগ্ধাও আর ফোন দিল না যদি বিজি থাকে এই ভেবে । শুধু মামুনের ফোনের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো ।
রাত এগারোটা বাজে। মামুন আর ফোন দিল না বলে স্নিগ্ধা অভিমান নিয়ে শুতে চলে গেল।
ও ভাবছে এখন নিশ্চয় মামুন প্লেনে । সে মনে মনে বলল, "তুমি একটা পচা। তখন তড়িঘড়ি করে ফোনটা রেখে দিলে, বললে পরে ফোন দিবে আর দিলেনা । আমি যে অপেক্ষায় ছিলাম তুমি জানো না ? "
রাত ১ টা বাজে। স্নিগ্ধার ঘুম আসছেনা । মোবাইল এ একটা ম্যাসেজ এলো । মিস কল এর ম্যাসেজ।
মামুন ১০.৩০ এ কল করে মোবাইল অফ পেয়েছে । ম্যাসেজ টা পড়েই স্নিগ্ধার বুকের ভেতরটা কেমন করে উঠলো। ও প্লেনে উঠে আমাকে ফোন করেছিল কিন্তু নেটওয়ার্ক না থাকায় মোবাইল অফ পেয়েছে। ভাবতেই কষ্টে বুক ফেটে যায় এমন অবস্থা স্নিগ্ধার।
বেচারা আমাকে ফোন করে পায়নি আহারে, আর আমি ফোন করেনি বলে অভিমান নিয়ে বসে আছি।
এখন আর নং খোলা পাওয়া যাবেনা জেনেও স্নিগ্ধা সাথে সাথেই মামুনের ফোন নং টা ডায়াল করলো । ওপাশ থেকে দুঃখিত বলল ।
স্নিগ্ধার হার্টবিট বেড়ে গেল, নিঃশ্বাস বন্ধ বন্ধ লাগছে , মনে হচ্ছে একটা বিশালাকার ওজনের কোন পাথর ওর বুকের উপরে চেপে আছে।
ওপাশে শুয়ে থাকা ছোটবোন যেন কিছু বুঝতে না পারে তাই খুব সাবধানে চুপচাপ শুয়ে কাঁদতে লাগলো স্নিগ্ধা। আর মনে মনে বলল - "কেন মানুষগুলোকে এত দূরে চলে যেতে হয়? কেন মানুষগুলো সবসময় কাছে থাকেনা ?
মামুন, তুমি ফিরবেতো আমার কাছে ?"
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জানুয়ারি, ২০১৯ দুপুর ২:৪৫