দরজায় শব্দ হল হঠাৎ, ঠক ঠক ঠক। নুরুল আফসার ঘড়ির দিকে তাকালেন, রাত বাজে সাড়ে ১০টা। এত রাতে কে এল?
দরজা খুলে অবাক নুরুল আফসার,”বারেক, এতো রাতে ? কি ব্যাপার?
কালো চাদরে ঢাকা সর্বাঙ্গ, হালকা চাপ দাড়ি মুখে, ছেলেটার চোখের দৃষ্টি মাছের মতো, নিস্পলক, ঘষা কাঁচ যেন। সালাম দিল, ঠাণ্ডা স্বরে বলল, “তেমন কিছু না স্যার, আপনাকে একটু আসতে হবে।“
-কোথায়?
–আমার সাথে, ক্যাপ্টেন সাহেবের জরুরি তলব।
–আমি তো খেতে বসেছি।
– ব্যাপারটা স্যার জরুরী। খুব বেশিক্ষন লাগবে না, বাইরে জীপ দাড়িয়ে আছে।
অধ্যাপক নুরুল আফসার হাত ধুয়ে শার্টটা গায়ে চড়াচ্ছেন, রেহানা এসে দাঁড়ালেন সামনে। “ আলবদরের লোকজন নাকি বাড়ি বাড়ি থেকে শিক্ষক, সাংবাদিকদের তুলে নিয়ে যাচ্ছে, আর ফিরে আসছে না ওরা। ছেলেটার ভাবভঙ্গি ভালো ঠেকল না, তুমি যেয়ো না প্লিজ।
একটু হাসলেন নুরুল, স্ত্রীকে আলিঙ্গনে জড়িয়ে কপালে একটা চুমু এঁকে বললেন, তুমি চিন্তা করো না, আমার কিছু হবে না। আমি যাব আর আসব…
অধ্যাপক নুরুল আফসার তার কথা রাখেননি। ফিরে আসেননি তিনি। পাঁচদিনের মাথায় ডিসেম্বরের ১৯ তারিখে রায়েরবাজার বিলে তাকে পাওয়া যায়, বেয়নেটের খোঁচায় খোঁচায় ছিন্নভিন্ন শরীর, মাথায় বুকে দুটো বড় বড় গর্ত, বুলেটের। পিছমোড়া করে বাঁধা হাত, চোখ। বিজয়ের ঠিক আগমুহূর্তে ঘষা কাঁচের মতো অস্বচ্ছ চোখের কিছু আলবদর সদস্য কালো চাদর গায়ে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল নুরুল আফসারদের, উদ্দেশ্য ছিল এই জাতির মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দেওয়া।
জামায়াতে ইসলামীর ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের কর্মীদের নিয়ে গঠিত হয়েছিল পোষা জল্লাদের দল আলবদর, ইসলামের দোহাই দিয়ে সভ্যতার নৃশংসতম গণহত্যা চালিয়েছিল ওরা, জাতির সূর্যসন্তানদের তিলে তিলে হত্যা করেছিল পবিত্র কাজ হিসেবে। নুরুল আফসাররা কথা রাখতে পারেননি, ফিরে আসেননি আর, একটা উদার অসাম্প্রদায়িক স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য তারা প্রাণ দিয়েছিলেন, কি অবলীলায় তাদের ভুলে গেছি আমরা...
ত্রিশ লক্ষ মানুষের মৃত্যুতে পার্থিব যে ক্ষতি হয়েছে, এই এক চৌদ্দই ডিসেম্বরে তার সমপরিমান কিংবা অধিক ক্ষতি হয়েছে দেশের সর্বকালের সেরা মেধাগুলোকে মেরে ফেলার ফলে।
ফরাসী বিপ্লবের ইতিহাস ঘাঁটুন- রুশো, ভলতেয়ারদের মত এক ঝাঁক বুদ্ধিজীবী ফরাসী জাতির জীবনে একই সময়ে এসেছিল একবারই, যার ফলাফল নতুন ফ্রান্স।
জহির রায়হান, শহিদুল্লাহ কায়সার, মুনীর চৌধুরী, আনোয়ার পাশা- এই যে এক ঝাঁক বিশ্বমানের বুদ্ধিজীবী, যাঁরা কিনা প্রত্যেকে নিজ নিজ ক্ষেত্রে কিংবদন্তীসম, এরকম একটা দল কোনো একটা জাতির জীবনে দুই চার কিংবা পাঁচশো বছরে একবার আসে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের শিক্ষক ছিলেন মজিবর রহমান। রাবিতে পাকসেনা ক্যাম্প বসানোর প্রতিবাদে তিনি ক্লাস বর্জন করেন, হিন্দু হত্যার প্রতিবাদে নিজের নাম পাল্টে রাখেন দেবদাস। পাকসেনারা তাকে ধরে নিয়ে প্রচন্ড নির্যাতন চালায়, ফলে তাঁর মানসিক বৈকল্য দেখা দেয়।
মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সেই ষাটের দশকে মাস্টার্স করে আসা শিক্ষক মজিবর রহমান দেবদাস তাঁর নীতির সাথে আপোষ করেননি। চরম মূল্য দিয়েছেন এজন্যে, তবুও এক চুল টলেননি।
আর আজকের তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা সুশীল সেজে ইনিয়ে বিনিয়ে রাজাকারের সাফাই গাওয়া রাস্তার সবচাইতে সস্তা ভিখিরীটার চাইতেও কম টাকায় বিক্রি করে নিজের কলম।
রাও ফরমান আলীর ব্লুপ্রিন্টে আর নিজামী-মুজাহিদের তত্ত্বাবধানে চৌধুরী মইনুদ্দিন আর আশরাফুজ্জামানের মত আলবদর নরপিশাচরা সেইদিন গুলোতে বাংলাপিডিয়ার হিসাব মতে ৯৯১জন শিক্ষাবীদ, ১৩ সাংবাদিক, ৪৯ চিকিৎসক, ৪২ আইনজীবী এবং ১৬ শিল্পী, সাহিত্যিক ও প্রকৌশলীকে হত্যা করেছিল! আমরা এই কুল জেনারেশন যেসব মুভি দেখি, সেখানকার মতো ০.৫০ ক্যালিবার এর পিস্তল দিয়ে মারা হয় নাই এই শ্রেষ্ঠ সন্তানদের, মারা হয়েছে উলঙ্গ করে, চোখ বেধে, খুচিয়ে , খুচিয়ে, মলদারে লাঠি ঢুকিয়ে, ।শহীদুল্লাহ্ কায়সার হতে পারত সাহিত্যে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম নোবেল বিজয়ী! জহির রায়হান হতে পারতেন চলচিত্রে অস্কারজয়ী প্রথম বাংলাদেশী পরিচালক!
১৯৫৫ সালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে এম.বি.বি.এস পাশ করবার পর ১৯৬১ সালে রয়্যাল কলেজ অফ ফিজিসিয়ান’স অফ লন্ডন এবং রয়্যাল কলেজ অফ সার্জন’স অফ ইংল্যান্ড থেকে ডি.ও শেষ করেছিলেন ডাঃ আবদুল আলীম চৌধুরী। আর ডাঃ মোহাম্মদ ফজলে রাব্বী ইংল্যান্ডের এডিনবার্গ থেকে কার্ডিওলজিতে এমআরসিপি ডিগ্রী অর্জন করেন ১৯৬২ সালে! ডঃ রাব্বী মেডিসিন এ নোবেল পেতেই পারতেন ! কি মনে হচ্ছে ? আবেগে একটু বেশি বলছি ? A case of congenital hyperbilirubinaemia (DUBIN-JOHNSON SYNDROME) in Pakistan এই title এ Journal o Tropical Med Hyg. নামক বিখ্যাত জার্নালে সেই ১৯৬৪ সালেই পাবলিশ করেছেন ডঃ রাব্বী ! Spirometry in tropical pulmonary eosinophilia নামে আরেকটা findings ছাপা হয়েছিল ব্রিটিশ জার্নাল অফ দা ডিসিস অফ চেস্ট এ ১৯৭০ সালে ! ভাবতে পারছেন ব্যাপারটা?
অথচ এই গর্বের জায়গাগুলো নিয়ে গর্বিত হওয়া, তাদের সৃষ্টি নিয়ে গল্প-উপন্যাস, শর্টফিল্ম, ডকুমেন্টরী, ফুলস্কেল ফিল্ম ইত্যাদি তৈরি করা কিংবা নতুন প্রজন্মের সামনে তাদের তুলে ধরার কোন চেষ্টা তো দূরে থাক, বছরের একটা দিন ছাড়া তাদের মনে করার সময়টাও হয় না আমাদের। তাই এবারের বুদ্ধিজীবী দিবসে আমি একটা উদ্যোগ নেবার চেষ্টা করছি। আগামী এক সপ্তাহ টানা সাতজন বুদ্ধিজীবীকে নিয়ে লিখবো আমি, তুলে ধরবো তাদের কীর্তিকে। আমি চাই আমার সাথে আরো ১০ জন লিখুন, অন্তত একজন বুদ্ধিজীবিকে নিয়ে হলেও! এই ১০ জন লিখবেন এবং আরো ১০জনকে মেনশন করবেন লেখার জন্য। এভাবে যেন অন্তত আগামী এক সপ্তাহ ফেসবুকের দেয়ালে দেয়ালে ছড়িয়ে পড়ে আমাদের সুর্যসন্তানদের কীর্তি!
egiye-cholo.com
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০১৭ দুপুর ১:১৪