ঢিমে তালে তিন জন মানুষকে কবর অথবা মাটি খুঁড়তে দেখা যায়। কবর? না কি কেবল মাটি খুঁড়ে গর্ত তৈরির নিরর্থক পরিশ্রম? — এই খনন কাজ সমাপ্তির পরে বিষয়টা পরিষ্কার হবে। এদেরকে ঘিরে — কাছে এবং দূরে কিছু ছড়ানো মানুষ। যাদের ভিতরে স্ব ভাবনায় এবং পোশাকে আশাকে বেশ বৈচিত্র্য দৃশ্যমান। তাদের সকলের উদ্দেশ্যই যে খনন কাজের সাথে সম্পর্কিত তা স্পষ্ট। কোদালের ভোঁতা শব্দের সবচেয়ে নিকটে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর ভিতর সবার প্রথমে নজর কাড়ে একজন মধ্যবয়স্ক মানুষ। লম্বা, শুকনো পাতলা গড়ন। মাথায় এলোমেলো মাঝারি মাপের চুল, মুখে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি, আধপাকা। পরণে বিশেষত্বহীন শার্ট প্যান্ট। হাতে হ্যান্ড কাফ — সামনের দিকে। মাঝে মাঝে লম্বা লম্বা শ্বাস নিয়ে বাতাসে কিছু শোঁকার চেষ্টা করছে। আবার সেটা বাদ দিয়ে ডানহাতের মধ্যমা এবং অনামিকার চিপাতে ধরে থাকা তামাক শলাকার পশ্চাদদেশ অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে টেনে উপরের দিকে মুখ করে ধোঁয়ার মেঘ তৈরি করছে। অস্থায়ী মেঘ ভেসে ভেসে সরে যেতে থাকে। আমরা এইমুহুর্তে ভাসমান মেঘের বদলে লোকটির চিন্তায় মনোযোগ দিতে পারি। লোকটি কিছু একটা ভাবছে।
"বহু বছর পর মাটি থেকে লাশ উঠালে কেমন গন্ধ পাওয়া যায়? বহু বছর বলতে এই ধরা যাক বারো বছর। না কি তার চেয়ে বেশি? না কি কম! সময়ের হিসাবটা আমার কাছে বরাবরই গোলমেলে ছিলো। আগের ঘটনা পরে চলে যায়। কখনো হয়তো উল্টোটাও ঘটে। অনেক কিছু ভাবতে গেলে খুঁজে পাই না। অনেক কিছু চাইলেও হারায় না। মনের ঘটনা ক্রমগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজেদের মাঝে বউচি খেলতে থাকে। অন্ধকারের মাঝে কেউ কেউ কখনো হুট করে হাজির হয়। এতটাই জীবন্ত — এই তো ছোঁয়া যাবে যেন! আবার ডুব দিয়ে হারিয়ে যায় কোন অধরায়। তাতে আমার অবশ্য তেমন আপত্তি নাই। বরং আমি চাই সবকিছু হারিয়ে যাক। আমার মন হবে সাদা ক্যানভাস। কিন্তু তা হয় না। নাছোড়বান্দার মতো ওরা এসে হাজির হবেই। ঘাড়ে হাত চেপে কিড়মিড় করে বলতে থাকে। আমাদের ভুলে যাবে এত সহজে! তা হবার নয়। সেগুলো দ্বিগুন সোল্লাসে ঝাপিয়ে পড়ে আমার উপর। তখন এক, দুই পুরিয়ায় কিছু হয় না। চতুর্দিকের আক্রমণে অতীত বর্তমান ভবিষ্যত সব মিলিমিশে এক হয়। এই মুহুর্তে সেটাই ঘটছে। অথচ আশেপাশের কারোর আমার দিকে লক্ষ নেই। বিশেষ কিছু একটার প্রতি শরীরের প্রতিটি কোষের হাহাকার অনুভব করছি। আপাতত নিকোটিন পেলেও চলে। হাতে হাতকড়া অবস্থায় কি ধূমপানের অনুমতি আছে? পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ভোদড় মার্কা চেহারার কনস্টেবলকে কি জিজ্ঞেস করে দেখবো! এই ব্যাটারা একসময় স্যার স্যার করতো। এখন সুযোগ বুঝে থাপড়াও দিয়ে বসতে পারে। ঠিক নেই। না জিজ্ঞেস করাই ভালো। এর চেয়ে মনের ভিতরে বউচি খেলার সুযোগ দেওয়া যেতে পারে। এটাও একরকম নেশা। শুরুতেই ঘুটঘুটে অন্ধকার। সিনেমা শুরু হওয়ার পূর্বের কালো পর্দা। সেই পর্দায় লাল রঙের এলোমেলো ফোঁটা গড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন পথে। তারপর আস্তে ধীরে একটি মুখ এবং পরবর্তীতে মুখ থেকে পরিপূর্ণ মানুষের শরীর স্পষ্ট হয়। মানুষটা মাটিতে পড়ে আছে। চিন্তার শিথিলতার সুযোগে স্মৃতিগুলো আরো জেঁকে বসে। পর্দার চিত্র পরিষ্কার হয়৷ মানুষটার হাত পিছমোড়া করে বাঁধা। ভেজা শার্ট প্যান্ট গায়ের সাথে লেপ্টে আছে। চিত্রের সাথে গন্ধ যুক্ত হয়। ঘাম,মূত্র এবং নেশার গন্ধ। এরপর কিছু অস্ফুট শব্দমালা। যন্ত্রণা কাতর আহত পশুর মতো গোঙানি। কেউ একজন মাটিতে চিৎ হয়ে পড়ে থাকা ছেলেটাকে উপুড় করে শুইয়ে দেয়৷ বুকখোলা শার্টের নীচে কালসিটে দাগ। লালে রঞ্জিত মুখ ফুলে এবড়ো থেবড়ো হয়ে থাকার কারণে তাঁর চেহারা বোঝা কঠিন। তবে আমি তাকে চিনি। খুব ভালো করেই চিনি।
এই চেহারা যে কতবার কতভাবে ভেসে উঠেছে। কত বছর আগে এই জায়গা ছেড়েছি। এরপর যেখানেই গেছি। আছরকৃত ভূতের মতো পৌছে গেছে। রইছ একদিন ধমকে বলেছিলো, "এতদিন হয়ে গেলো। এখনো ভুলতে পারতেছিস না। আর কারো তো সমস্যা হচ্ছে না। এসব খবর সারা জীবনে কাক পক্ষীও টের পাবে না। নিজেরে শক্ত কর ব্যাটা। আমারে দেইখা শেখ।"
সাইকেলের লকের প্রতি রইছের একরকম ফেটিশ কাজ করতো। ওর খাটের নীচে অনেকগুলো জমা ছিলো। মতিন ব্যাটাকে ধরে আনার পর মাটিতে ফেলে পা দিয়ে চেপে ধরেছিলো আশরাফ। আশরাফের গলায় পা দিয়ে দাঁড়ানোর ভঙ্গি ছিলো অনেকটা ওয়েস্টার্ন সুপার ভিলেইনের মতো। পুরা ব্যাপারটা বোধহয় ওর কাছে এবং আমাদের কাছে সিনেম্যাটিক কিছু একটা মনে হয়েছিলো। উত্তেজনাকর সিনেমা। অদৃশ্যমান ক্যামেরায় দৃশ্যায়ন ঘটছে শিকারকে পাকড়ে ধরে শিকারীর রীতিগত উল্লাসিক নিষ্ঠুরতা। উৎসব সূচনা করে ছিলো মতি ও কয়েকটি ক্রিকেট স্ট্যাম্প। একে একে প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয় শুভ্র, আতিক, সায়েম। শুরুর ব্যাপারটা ছিলো এলোপাথারি। কার আগে কে? কোথায় কতখানি? তার হিসাব ছিলো না। আধাঘন্টা পর প্রক্রিয়ায় একটি ঐক্যতান তৈরি হয়। অন্তত আমার চোখে তাই মনে হয়েছে। নরম মাংশ থেতলানোর শব্দেও একটা ছন্দ এসেছিলো। কেবল মাত্র বেসুরো গোঙ্গানি বারবার মনোযোগ নষ্ট করছিলো। তাই একটা রুমাল দলা পাকিয়ে আমিই ওর মুখে ঢুকিয়ে দেই। দ্বিতীয় অথবা তৃতীয় দফার শেষে যখন রইছকে সাইকেলের লক হাতে একশনে নামতে দেখি তখন আনমনেই শিষ দিয়ে উঠেছিলাম। মানুষকে যন্ত্রণা দেওয়ার একটা ন্যাচারাল প্রতিভা আছে ওর। বিদেশ হলে হয়তো ওর আলাদা ডিমান্ড থাকতো। ভাড়া করে নিয়ে যেত বিশেষ বিশেষ কাজে। আপাতত রইছের হাতে দলিত হতে থাকে ভিরমি খেয়ে পড়ে থাকা মানুষটি।
"ওই নাটক করতেছে।" আতিকের লাথিতে অজ্ঞান শরীরটা নড়ে ওঠে। তবে কোন আওয়াজ পাচ্ছিলাম না। মরে গেছে! মরে গেলো এত দ্রুত! একটু যে আফসোস হচ্ছিলো না তা নয়। ভেবেছিলাম আরো কিছুক্ষণ টিকে থাকবে। অবশেষে মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর সায়েম আতিকের সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রক্রিয়ায় আমিও নিষ্ক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলাম। শিকারকে কি পুড়িয়ে ফেলা হবে না কি ভাসিয়ে দেওয়া হবে? না কি ইট বেঁধে ডুবিয়ে দেওয়া হবে? আর যাই হোক প্রতিপক্ষের হাতে কিছুতেই পড়তে দেওয়া যাবে না৷ এই লাশ কাঁধে নিয়ে মিটিং হবে, মিছিল হবে...বিচার চাই...বিচার চাই। আমি বলতে চেয়েছিলাম স্টাফড করে রেখে দেই, চল। ক্যাম্পাসের বড় মাঠের গোলপোস্টে ঝুলিয়ে রাখি। ওদের একটা উচিত শিক্ষা হোক৷ শেষ পর্যন্ত শিকারকে মাটি চাপা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হলো। ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার পর মাটি ফেলতে ফেলতে গর্তের অন্ধকারে ওর মুখটা কেন জানি মাথায় গেঁথে গেল। এই নাছোড়বান্দা স্মৃতিগুলোর শেষ পেরেক। কিছুতেই ছুটলো না আর। রইছকে প্রায়ই বলতাম৷ ও বলতো "ভুলে যা", "ঔষধ খা", "আমাকে দেখ"। হেহ! যতটা ও ভেবেছিলো আসলে ততটা ভুলো মনা ও নয় তা আমি ধরে ফেলেছিলাম।
একদিন ভিনদেশের এক ট্রেনে সামনেই পত্রিকায় ডুবে থাকা এক লোককে দেখে রইছের চেহারার পরিবর্তন দেখেছিলাম। সামনের লোকটার চেহারার সাথে বিশেষ একজনের মিল আছে। সেই যে শেষ পেরেক! সেদিন বুঝেছিলাম একই রোগের বীজ রইছের ভিতরেও আছে। হয়তো খোঁজ নিলে দেখা যাবে বাকীদেরও একই অবস্থা। অন্যরকম স্বস্তি অনুভব করেছিলাম তখন।
মঈনকে দেখে স্বস্তির ছাপ টের পাওয়া যায়। তার চোখ বন্ধ করে উর্ধ্বমুখী ধোঁয়া ছাড়ার ব্যাপারটা কলের পুতুলের মতো পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকে। ভেসে যাওয়া ধোঁয়া ভাসতে ভাসতে উপস্থিত হয় যতীনের কাছে। কোদালের শব্দের অনতিদূরেই একটি ভাঙ্গা পাইপের উপর তার অবস্থান। দুই পা হাঁটু ভাজ করা। তবে ডান পায়ের হাঁটুর চার আঙ্গুল নীচ দিয়ে উধাও। গলায় ঝুলানো গামছা দিয়ে তৈলাক্ত মুখ বার বার মুছতে দেখা যায়৷ সামনের কোদাল চালানোর ব্যাপারটায় তার চোখে মুখে বেশ আগ্রহ। সেও নিশ্চুপ কিছু ভাবছে বলে মনে হয়।
মাটির নীচে জিন্দা কবর দিলে কেমন লাগে? পোলাটার কি শ্বাস ছিলো তখনো?
ঘুমের ঘোরে দম বন্ধ হয়ে আসছিলো। চোউখ মেইলা দেখি বুকের উপর হাঁটু ভাজ কইরা পাঁচ ছয় বছরের বাচ্চা বইসা আছে। তার শকুনের মতো লম্বা ঠোঁট ঝুইকা আমার কপাল সোজাসুজি নিশানা করছে। দুইপাশে দুইটা মণিছাড়া সাদা চোখ। বুকটার মধ্যে বাতাসের জন্য আকুলি বিকুলি। দম যায় যায়! বাচ্চা আজরাইল ঘাপটি মারছে কিসের আশায়! কেস কি আইজকাই ফাইনাল! স্পষ্ট দুই তিন বছরের বাচ্চার খটখট হাসির শব্দ শুনলাম। সন্তু ছোট থাকতে এরাম কইরা হাসতো। সন্তুর কথা মনে হইতে বুকটা হঠাৎ হালকা হইলো। গলগল হাওয়া ঢুইকা জায়গা নিলো। বুকের উপর শকুন হইলো উধাও। বাচ্চা আইজরাইল সিদ্ধান্ত বদলাইলো বুঝি! তয় বাচ্চার খটখট হাসির ঘটনা বুঝলাম।
ফোন ধরলাম। শুনলাম। ধীরে ধীরে উইঠা বসলাম। দেখি সারা শরীর ঘামে ভেজা। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর হাজির হইলাম জায়গামতো। নীচতলার সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে উঠতেই দেখলাম চার পাঁচ জনে একটা মাদুরে মোড়াইয়া নামতেছে। মাদুরে মোড়ানো মাংসপিন্ড। কম তো দেখি নাই! ঘটনা বুঝতে অসুবিধা হয় নাই। এক পোলায় আইসা ধমকাইলো, "থাকেন কই? ডিউটি মিউটি তো করেন না। ফ্রি গাঞ্জা খাইয়া চিৎ হয়ে থাকেন গা রুমে। ফোন দিলেও ধরেন না।" হেহ! ঘটনা বুইঝা লইলাম। কইলাম,
"দাদু থাকি তো আশেপাশে। কি লাগবো!"
"শাবল আর কোদালের ব্যবস্থা করেন।"
করলাম। দশ বারো জন মিইলা খুঁড়তে কতক্ষণ আর লাগে! তয় কাজ শেষ করতে ভোর হইলো। বইসা বইসা দেখলাম ক্যামনে মাটির নীচে হারায় গেলো। আহ! দম ফুরানির কষ্ট মনে হইলো। বুকের ভিতরে হাওয়ার জন্য আকুতি।
জানতাম এই যে যতদিন মাটির উপরে আছি ওই আমারে মাটির নীচে টানবো। ঘটনার পর ছয় মাস পলাতক ছিলাম৷ নিজের জন্যে নয়। ঐ যে কাবিলের বংশধরদের জন্য। ওরাই কইলো "যান গা কোথাও। বাড়ি আসার দরকার নাই। আপনার সংসারে টাকা পয়সা লাগলে আমরা দেবো।" পরে ফিরা আইলাম। ততদিনে সব স্বাভাবিক। ছাত্ররা কিছুদিন আন্দোলন কইরা যে যার কাজে ব্যস্ত। কয়েক বছরের মধ্যে বাচ্চা শকুনেরাও একে একে উঁড়াল দিলো। আমি আর যাবো কই! এখানেই থাকি। রাইত হইলে প্রথম প্রথম এই দিকে ডিউটিতে আইতাম না। কিন্তু টানের কথা যে বলছিলাম। না আইয়া উপায় কি! মাটি ফুইলা উঠে আমারে ডাক দিয়ে কয় আহো যতীন পাল! তোমার গুপ্তধন উপচাইতেছে! তাড়াতাড়ি মাটির উপরে ফাটল সারাইলাম৷ উপরে ঘাস বিছাইলাম। রাইতে ঘুমাইলে পরে বাচ্চা শকুন আইসা বুকের উপর উইঠা বসতো। দম আটকাইতে আটকাইতে সন্তুর মায়ের ধাক্কায় লাফ দিয়া উঠতাম। হাঁফাইতে হাঁফাইতে মাটির নীচে দম আটকানির কথা ভাবতাম।
কয়েক বছর পর চাকরি ছাড়লাম। দুই বছর আগে পাও কাটার আগে মাঝে সাঝে আইতাম। সব ঠিকঠাক। কাবিলের গুপ্তধনের খোঁজ তখনো কেউ পায় নাই। আইজকা পাবো নি?""
ধুপধাপ কোদালের শব্দ চলে। যতীন অপেক্ষায় থাকে। কোন একজনের বক্তব্যের শব্দে তার ধ্যান ভাঙ্গে।
"ঠিক জায়গা মতো দেখাইছিস তো?"
"জি।"
"তাইলে তো পাওয়ার কথা এতক্ষণে। কত গভীরে?"
"তা তো স্যার স্মরণে নাই। এত বছর আগের কথা।"
ওসি মনসুর মাটির কাছে দাঁড়িয়ে থাকেন। জোরে জোরে শ্বাস টেনে নেন। তারপর আগের জায়গায় ফিরে যান। মাটির গন্ধ তাঁর পিছু নিয়ে কিছুদূর পর ম্লান হয়ে যায়। চেয়ারে বসতে বসতে মনসুর বাবুলকে ডেকে বলেন আরো এক চা দিতে। চোখে মুখে বিরক্তির ছাপ। ভিতরে ভিতরে হয়তো আরো বিরক্ত। দূরে হ্যান্ড কাফড পাগলটাকে দেখে তাঁর দৃশ্যমান বিরক্তির ভাব আরো বাঁড়ে। দুধের সর ভাসা গরম চায়ে চুমুক দিয়ে সিধা হওয়া কুঁচকানো ভ্রু কিছুটা শান্ত মনের ইঙ্গিত দেয়। এই সুযোগে কিছু ভাবনা হয়তো একত্রিত হওয়ার সুযোগ পেলো।
কবেকার সেই মান্ধাতার আমলের ঘটনা। এতদিন মাটি চাপা ছিলো। খুড়াখুড়ি করে উঠাও। তারপর ফাইল চাপা দাও। দরকার কি বাপু! পাবা তো কয়খান হাড্ডিগুড্ডি। দেশে কি নতুন কেসের অভাব পড়ছে! বড় বড় হেডলাইন দিছে আবার "দেড় যুগ আগে মেধাবী ছাত্রের অন্তর্ধান রহস্য উদঘাটন, সন্দেহভাজনের স্বীকারোক্তি" বাল! স্বীকারোক্তি দিলেও বা কি! মিডিয়াতে না আসলে ব্যাপারটা সাইজ করা যেত। স্বীকারোক্তি দেওয়ার পর থেকে সারা দেশে আন্দোলন শুরু হলো। হেন স্লোগান তেন স্লোগান! দেশ উদ্ধারে নেমেছে সব। আরে বাপুরে এ দেশে এরকম কতগুলোরে মাটিতে, কাদায়, ঝোপে জঙ্গলে লুকায়ে রাখছে তার সবগুলারে খোঁজ দেখি! কত কেসই তো দেখলাম। রাতের আঁধারে ড্রাইভার গুম। পাটকল শ্রমিক গুম হয়। তার জন্যে নামিস না ক্যান? যখন উর্ধতন ফোনের হেচকা টানে পুলিশের চাকরি নিয়ে টানাটানি পড়ে তখন কিছু বলিস না কেন! মেধাবী ছাত্র! মেধাবী ছাত্র! মরার পর সব মেধাবী ছাত্র।
মনসুর লম্ব চুমুক দিয়ে সরটা খেয়ে ফেলে। কোদালগুলোর দিকে তাকিয়ে নতুন ভাবনার উদয় হয় তার মনে।
মামলা এখন পর্যায়ে আছে সেটাকেও ম্যানেজ করা কঠিন হবে না। এখনো তদন্ত শেষ হয়নি। এদের কোন না কোন রাজনৈতিক বাপ এর ভিতরে কন্ট্যাক্ট করবেই। রাজনৈতিক বাপ না আসলেও বায়োলজিক্যাল বাপকে ধরতে হবে। কিছু লাভ সেখান থেকে আদায় করা যাবে৷ কেবল যদি লাশটা...
মাটিতে জুতা ঘষার শব্দ পাওয়া যায়। মনসুরের চায়ের কাপে ছায়া পড়ে। ছায়াটি যার এই মুহুর্তে তার পোশাক আশাক দেখে অনুমান করা কঠিন তিনি কে। বয়স অল্প, স্মার্ট পোশাক। ওসি মনসুরের সাথে কথা বার্তায় জানা যায় তাঁর নাম ওয়াহেদুল। সম্ভবত আইন বেঁচে জীবিকা অর্জন করা তার পেশা। কথা বার্তা শেষ করে ভদ্রলোক ফিরে চলেন। গন্তব্য হলের লবিতে দাঁড়িয়ে থাকা দুজন পৌড় পুরুষ এবং নারী। এই খনন কাজের আশেপাশে ছড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর ভিতরে এই দুইজন মানুষের মুখের অনুভূতির ভিন্নতা লক্ষণীয়। তাদের শান্ত চোখের দৃষ্টিতে গভীর বিষাদ হয়তো চোখে পড়ে। পথ হারা হতাশাও দেখা যেতে পারে। শুকিয়ে যাওয়া কান্নার দাগ। তবে কোন রাগ বা প্রতিহিংসার চিহ্ন খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে। কেউ যদি সেটা খুঁজে পায় তবে তা হবে নতুন আবিষ্কার।
ওয়াহেদুল তাদের কাছে পৌছানোর আগেই দ্রুত কিছু বিষয় মনে মনে গুছিয়ে নেয়।
এই মামলায় বেশ জটিল হয়ে যাচ্ছে। আসামীরা বেশিরভাগই বিদেশে পলাতক বহু বছর থেকে। একমাত্র স্বীকারোক্তি দেয়া আসামীকেও ইনসেন প্রমাণ করা খুব কঠিন হবে না। যতীনের একক স্বাক্ষীও আনরিলায়েবল। হতাশ হওয়া যাবে না। বাদীপক্ষকেও হতাশ করা যাবে না।
ওয়াহেদুল বিড়বিড় করে 'চিয়ার আপ' 'চিয়ার আপ' জাতীয় কিছু বলে। এত আস্তে বলে যে অনুমান করা যায় সেটা নিজেকেই শোনাচ্ছে।
কোদালের ভোঁতা আওয়াজ আর শোনা যাচ্ছে না। মাটি খোঁড়ার সমাপ্তি ঘটেছে।
প্রথমে ওসি মনসুর এবং একজন সান্ত্রীকে দেখা যায় গম্ভীর মুখে ও দ্রুত পদে জিপ গাড়িতে উঠে বসতে৷ মঈনকে তার আগেই গাড়িতে উঠানো হয়েছে। ইঞ্জিন চালুর হওয়ার কর্কশ শব্দ হয়। ক্যাম্পাসের মেইন গেট দিয়ে বের হওয়ার আগে গাড়িটার গতি অনেকটাই কমে যায়। সামনে বিশাল জনসমাবেশ। প্রধান রাস্তায় অনেক মানুষ বসে, কিছু মানুষ দাঁড়িয়ে মুহুর্মুহু স্লোগান এবং সমতালে হাততালিতে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে তুলছে। অনেকের কাঁধে ব্যাগ। কপালে বাংলাদেশের পতাকা। বয়সে তরুণ এদের দেখে পথচারীরা বুঝতে পারেন এরা এই বিশ্ববিদ্যালয় অথবা অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। তাদের অগ্নীঝরা স্লোগান পথচারীদের ব্যস্ত সমস্ত ছোটাছুটিতে মন্থরতা আনে। তারা কৌতূহলী হয়ে এদের পর্যবেক্ষণ করেন। কারো কারো মুখে হাসি দেখা যায়। সেটা কি অনেকগুলো ছেলে মেয়ের একসাথে স্লোগানের কারণে। না কি এদিকে ওইদিকে টিভি ক্যামেরায় নিজের চেহারা দেখানোর সুবাদে। না কি রাস্তার মাঝখানে গোল হয়ে বসে থাকা একটি বড় দলের কেন্দ্রে ছন্দবদ্ধ স্লোগানরত এক তরুণীর শরীরী ভাষা দেখে। মেয়েটি চমৎকার বলিষ্ঠ কন্ঠে স্লোগান দিতে থাকে। সে একটি লাইন বলে। বাকীরা চিৎকার করে আর একটি লাইন বলে। দেখার মতো দৃশ্যই বটে। বেশ কয়েকজনকে দেখা যায় সমাবেশকে ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে ভি চিহ্ন দেখিয়ে সেলফি তুলতে। সমূহ সম্ভাবনা আছে এই ছবিগুলো প্রো পিক হওয়ার। কেউ একজন পাশের জনকে খোঁচা দিয়ে বলে, "ওই ব্যাটা, প্রোপিকের স্টিকার ক্যামনে লাগাইছস। ওই যে জাস্টিস ফর...কে যেন।"
কিছু টিভি সাংবাদিককে দেখা যায় তারা পুলিশের গাড়িটিকে ঘিরে ধরেছে৷ রাস্তায় ব্যারিকেড দেওয়া ছাত্র সমাবেশ তাদের এ কাজে সুবিধা করে দিয়েছে। পুলিশের কাছ থেকে কিছু তথ্য তারা বের করতে পেরেছেন বলে মনে হয়। একজন সাংবাদিক কিছুক্ষণ ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে গরমাগরম আপডেট সাজিয়ে নেন মনে মনে। তবে আমাদের আর তার মনের ভিতরে উঁকি ঝুঁকি দেওয়ার প্রয়োজন নাই৷ একটু পর নিজেই সেটা বলে দেন,
"ফারজানা, আপনি জানেন আমরা এখন দাঁড়িয়ে আছি...এ...এ... আপনি দেখতেই পারছেন আমার পিছনে শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন চলমান। তারা নানারকম স্লোগান দিয়ে এই হত্যাকান্ডের বিচার দাবি করছেন। তাদের সাথে শিক্ষকদের একাংশও যুক্ত হয়েছেন। যদিও... শিক্ষার্থীরা ক্লাস বর্জন করলেও শিক্ষকেরা যেটা বলছেন যে...এ...এ...এ...আন্দোলনের পাশাপাশি ক্লাস চালিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করছেন তাঁরা। আপনি জানেন যে আজকে এই মামলা একমাত্র গ্রেফতারকৃত আসামীকে নিয়ে... এ... ঘটনাস্থলে পুলিশ লাশ উদ্ধার করতে...এ...এসছিলো। কিন্তু আমরা... আমরা... দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশের কাছ থেকে যেটা জানতে পেরেছি যে...যে... তাঁরা এখানে কোন লাশ খুঁজে পাননি। এখানে ঘটনাক্রমে বলে রাখি যে গ্রেফতারকৃত আসামী আসামী একটি মাদক মামলায় আটক হয়েছিলেন এবং জিজ্ঞাসাবাদের সময় অনেকটা...অনেকটা...অনেকটা... অপ্রত্যাশিতভাবেই পনেরো বছর আগে ঘটে যাওয়া একটি...একটি হত্যাকান্ডের কথা স্বীকার করেন। এই স্বীকারোক্তিতেই পুনরায় মামলাটি চালু হয়... সোস্যাল মিডিয়ায় এই খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে... এবং... এবং... আন্দোলন শুরু হয়। এখন পর্যন্ত অনেকে সন্দেহ করা হচ্ছে এটি... এটি... একটি রাজনৈতিক হত্যাকান্ড ছিলো। যদিও পুলিশ কিংবা কোন দলের পক্ষ থেকে কোন বক্তব্য দেওয়া হয়নি। হত্যাকারীরা খুন করার পর সংশ্লিষ্ট হলের পিছনে মাটি চাপা দিয়েছিলো... সেখানে... সেখানে লাশ না পাওয়াতে এখন হয়তো... হয়তো...হয়তো..."
পুলিশের গাড়িটি জন বাঁধা পার হয়ে অবশেষে বের হয়ে যেতে পারে। গাড়ির পিছনে মঈনের ছবি তোলার জন্য একরকম হুড়োহুড়ি লেগে যায়। মঈন সম্ভবত তার ভাবনা অনুযায়ী ভোঁদড় চেহারার কনস্টেবলের সাথে একটা সখ্যতা তৈরি করে ফেলেছে। তার হাতে নতুন সিগারেট। উপরের দিকে মুখ করে সে ধোঁয়ার রিং বানানোর চেষ্টা করছে। পুলিশের গাড়িটি চলে যেতে যেতে মঈনের কাছে বলিষ্ঠ কন্ঠের মেয়েটির স্লোগানগুলো স্তিমিত হয়ে আসে।
লাশ কই...খোঁজ চাই...
বিচার চাই... বিচার চাই।
----------
বাবুল চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। ভাজ করা বাম হাঁটুর উপর ডান পা তোলা। তার মনে খুব আনন্দ। সেটার বহিঃপ্রকাশ অনুমান করা যায় তার শিষ দেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টায় এবং দ্রুত গতিতে ডান পায়ের পাতা নাচানো দেখে। বাবুলের মনে খুশির ভাবনা৷
"কলোনীতে নানান জনের শখের বাগান বানাইতে মাটি লাগে। হলের পিছনের ঐ জায়গা থেকে মাটি উঠাইতাম। ঐ জিনিস যে লুকায়ে আছে কেমনে বুঝতাম! প্রথম এক সপ্তাহে তো ঘুমাইতে পারি নাই৷ কাউরে কইতেও পারি না। যদি পুলিশে ধরায় দেয় তাইলে কেস তো খাবো আমি। পরে চিন্তা করে দেখলাম। জ্যান্ত মানুষের দাম কয় পয়সা? কোন দামই নাই৷ এই যে অনার্স পাশ কইরা আমি এইখানকার কেয়ার টেকার। পোলাপাইনে কথা কয় তুমি, তুই কইরা। কোন দাম আছে আমার? মরা মানুষের দাম আছে। বুক, কিডনি, চোখ যদি বাদও দেই৷ খালি হাড্ডির দামও আছে৷ দাম নাই শুধু রক্ত মাংসের জ্যান্ত মানুষের। তয় গন্ধটা নিয়ে একটু চিন্তায় ছিলাম৷ এত বছরের পুরানো। মাটিতে যদি পচা মাংসের গন্ধ মিশা থাকে! ফেসবুকে কোন এক কবি মবির একটা লাইন দেখছিলাম। "বাতাসে লাশের গন্ধ পাই..." হাফ ডজন সস্তা আতর আইনা ঢাইলা দিছিলাম পরে। যাক! গন্ধ না ছড়ায়ে এইবার খুশবু ছড়াক।"
বাবুল শিষ দিতে দিতে তার ফোনের দিকে তাকায়। আপাতত কেউ তাকে মৃত মানুষের দাম কত জিজ্ঞেস করলে সে নিদেন পক্ষে হাড্ডির দাম বলে দিতে পারে। পুরানো হাড্ডির দাম তার কাছে এই ফোনসেটের বাজারদরের সমান। পঁয়ত্রিশ হাজার টাকা। এক বছর পুরাতন হইলেও ফোনের সার্ভিস ভালো। বাবুলের সম্ভবত আতরের খুশবুর কথা মনে হওয়াতেই একটি গানের কথা মনে পড়ে। কিছুক্ষণ পর তার পছন্দের ফোন সেটে গানটি বাজতে শোনা যায়।
"হাওয়া হাওয়া এ হাওয়া খুশবু লুটা দে..."
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে ডিসেম্বর, ২০২০ রাত ৮:৩৪