আজ কোন কিছু বলার আগে চলুন একটু অতীত থেকে ঘুরে আসি।
১৯৯৯ বিশ্বকাপ ক্রিকেট। বাংলাদেশের জন্য এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত। প্রথমবারের মত ক্রিকেটের সর্বোচ্চ আসরে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ সমগ্র দেশবাসীকে ভাসিয়েছিল আনন্দের জোয়ারে। কিন্তু শুধু অংশগ্রহণই নয়। সেই বিশ্বকাপের রানার-আপ পাকিস্তানকে হারিয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল হৈচৈ ফেলে দিয়েছিল সমগ্র ক্রিকেট বিশ্বেই। দেশের রীতি অনুযায়ী এরপর ক্রিকেটাররা ভাসতে লাগলেন অভিনন্দন ও পুরস্কারের জোয়ারে। তবে এই পুরস্কারের মাঝেও একটি ঘোষণা এসেছিল অনেকটা বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতোই।
ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইসিসি বাংলাদেশকে সম্মানীত করেছিল টেস্ট স্ট্যাটাস দিয়ে। একটি মাত্র জয়ের পুরস্কার যে এত বড় হতে পারে, তা বোধহয় কেউই ভাবতে পারেননি। অথবা এমনও হতে পারে, কেউ ভাবতেই চাননি। সেই সময় ক্রিকেটের জাগরণে মোহাবিষ্ট দেশবাসীর ক্রিকেট নিয়ে ভালোবাসা এতটাই প্রবল হয়ে দেখা দিয়েছিল যে ক্রিকেট বিশ্বের কুলীন পরিবারে জায়গা করে নেওয়ার উপলক্ষটা যেন সকলে সাদরে বরণ করার প্রস্তুতি নিতেই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। কেউ একবারও কী সেই সময় ভেবে দেখেছিলেন, আমরা সত্যিই সেই সময় টেস্ট খেলার যোগ্য ছিলাম কী না।
খুব বিশ্বস্ত এক সূত্রের কাছে শুনেছিলাম, বাংলাদেশের এই টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার পেছনে শুধু ক্রিকেটই একমাত্র কারণ ছিল না। এর পেছনে ছিল বিভিন্ন ধরনের পলিটিক্স। আইসিসির তৎকালীন সভাপতি জগমোহন ডালমিয়া ছিলেন একজন ভারতীয়, সর্বোপরি একজন বাঙ্গালী। বিসিবির তৎকালীন সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরীর সাথে ছিল তার উষ্ণ সম্পর্ক। বাংলাদেশকে টেস্ট স্ট্যাটাস দেওয়ার পিছনে এই সম্পর্কের ছিল বড় অবদান। জগমোহন ডালমিয়া যেমন চেয়েছিলেন বাংলাদেশকে টেস্ট স্ট্যাটাস দিয়ে আইসিসিতে নিজের ভীতটা শক্ত করতে। তেমনি সাবের চৌধুরীও চেয়েছিলেন ক্রিকেট বাণিজ্যে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ পাকাপাকি করে নিজেও এতে শামিল হতে। এমনও শোনা যায় যে, বাংলাদেশের এই টেস্ট স্ট্যাটাস প্রাপ্তির পিছনে ছিল আইসিসির পূর্ণ সদস্য কতিপয় দেশকে বাংলাদেশের দেওয়া মোটা অঙ্কের উৎকোচ। তবে এ সবই শেষ পর্যন্ত শোনা কথা। এর কতটা বাস্তব আর কতটা অবাস্তব, তা শেষ পর্যন্ত অজানাই থেকে যাবে।
এবার অতীত থেকে একটু বর্তমানে ফেরা যাক। আজ হারারেতে টানা তৃতীয় ওয়ানডে হারার মাধ্যমে ব্যর্থতার ষোলকলা পূর্ণ করলো বাংলাদেশ। এই হারের মধ্য দিয়ে সর্বাগ্রে এই প্রশ্নটাই কি সবার মনে আসে না যে সত্যিই টেস্ট খেলার জন্য আমরা কতটা প্রস্তুত? যেই জিম্বাবুয়ে কে আমরা এখন বলে কয়ে হারাতে পারি, যেই জিম্বাবুয়ে টানা ৬ বছর ধরে টেস্ট ক্রিকেট থেকে নিজেদের স্বেচ্ছায় দূরে সরিয়ে রেখেছে, সেই জিম্বাবুয়ের সামনেও আমাদের এই হাল??? একটা ম্যাচ হারলে নাহয় সেটাকে আমরা অঘটন বলে চালিয়ে দিতাম। কিন্তু ১টা টেস্ট, ৩টা ওয়ানডে, এমনকি একমাত্র ৩দিনের প্রস্তুতি ম্যাচও??? এই লজ্জা কি সমগ্র দেশের জন্য নয়????
একবার শুধু গত ১১টা বছরের দিকে তাকিয়ে দেখুন। গত ১১বছরে বাংলাদেশের যে পারফরম্যান্স, তাতে সত্যিই কি মনে হয় যে বাংলাদেশ টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার যোগ্য ছিল? যেই পাকিস্তানকে হারিয়ে আমরা টেস্ট স্ট্যাটাস পেয়েছিলাম, গত ১১বছরে আমরা কি আর একবারও পেরেছি সেই পাকিস্তানকে হারাতে? অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ডের মত দলকেও আমরা একবারের বেশী হারাতে পারি নি। ভারতকে হারিয়েছি ২বার। গত এগারো বছরে কেনিয়া পর্যন্ত বিশ্বকাপের সেমি-ফাইনালে খেলেছে। অথচ সেই একই বিশ্বকাপে আমরা টেস্ট স্ট্যাটাস নিয়েও কানাডার কাছে হার মেনেছি। টেস্ট প্লেয়িং দেশ হওয়া সত্ত্বেও আমরা টানা পাঁচ বছর জয়শূণ্য থেকেছি। এই হল একটা টেস্ট প্লেয়িং কান্ট্রির রেকর্ড? এখনো হাতের কড়ে গুনে বলতে হয় ঐ দেশের সাথে সেই একদিন জিতেছিলাম, ঐ দেশের সাথে একদিন খুব সম্মানজনকভাবে হারতে পেরেছিলাম। এই অপমান কি দেশের ক্রিকেট কর্তাদের মনে কোন অনুভূতি জাগায় না? তারা কি দেশের ক্রিকেটারদের এহেন নির্লজ্জতার পরেও কোন পদক্ষেপ নিবেন না?
সব কিছু নাহয় বাদই দিলাম। গত ৩ বছরে আমরা কী করেছি? এক জিম্বাবুয়ে কে বারবার ডেকে এনে খেলেছি, আর জিতেছি। এই করে করেই কি আমাদের ক্রিকেট দল দেশবাসীর সাথে প্রতারণা করে নি? দেশের মানুষ কে জয়ের গান শুনিয়ে তারা কি আসলে দেশের ক্রিকেটকেই পিছনে ঠেলে দেননি? এখন তো সেই জিম্বাবুয়েও বাংলাদেশ কে বলে কয়ে হারাচ্ছে। এই অপমানের জবাব কি? এই অপমান কি দেশের ক্রিকেট কর্তাদের মনে কোন অনুভূতি জাগায় না? তারা কি দেশের ক্রিকেটারদের এহেন নির্লজ্জতার পরেও কোন পদক্ষেপ নিবেন না?
জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটে যখন স্বর্ণযুগ চলছিল, তখন বাংলাদেশ জিম্বাবুয়ের সাথে সম্মানজনকভাবে হারার কথাও ভাবতে পারতো না। তারপর এক ঝড়ে লন্ডভন্ড হয়ে গেল জিম্বাবুয়ের ক্রিকেট। একের পর এক তারকা ক্রিকেটার দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার পর যখন তাদের ক্রিকেটের মান দিন দিন নিচে নেমে যাচ্ছিল, তখন তারা নিজেরাই নিজেদের সরিয়ে রেখেছিল টেস্ট ক্রিকেট থেকে। ৬ বছর ধরে তারা নিজেদের তৈরি করেছে শুধু এই দিনটার জন্য। ৬বছর প্রস্তুতি নিয়েছে তারা, শুধু টেস্ট ক্রিকেটে প্রত্যাবর্তনের জন্য।
আর আমরা? গত এগারো বছর ধরে শুধু হেরেই চলেছি। তাও আমাদের মোটা চামড়ায় কোন অনুভূতি হয় না। এমনকি জিম্বাবুয়েও এখন আমাদের গো হারা হারায়। আর আমরা চোখ মুখ বন্ধ রেখে সব কিছু দেখেও না দেখার ভান করে অদের “অর্ডিনারি” বলে যাচ্ছি।
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড, আপনাদের উদ্দেশ্যেই বলছি। যদি পারেন, এই দেশের ক্রিকেটকে বাঁচান। পারলে আপনারাও জিম্বাবুয়ের মত স্বেচ্ছানির্বাসনের পথ ধরেন। যারা আগে দুই বেলা ঠিকমত খেতে পারত না, তারাই এখন ক্রিকেট খেলে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকার মালিক হয়ে গেছে। পারলে তাদের বাস্তবতার মাটিতে নামিয়ে আনুন। টাকার নেশা থেকে ক্রিকেটারদের সরিয়ে এনে ক্রিকেট খেলায় মনোযোগী করুন। দেখুন, প্র্যাকটিস বাদ দিয়ে শ্যুটিং তো দূরে থাক, বাসায়ও যাবে না।
[এই লেখার শুরুতে সবকিছু গুছিয়ে লিখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু প্রচন্ড রাগে সবকিছু এলোমেলো হয়ে গিয়েছে। তাই কী লিখতে যেয়ে কী লিখেছি, নিজেও জানি না। আশা করি, লেখার ভুল ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।]