[হুমায়ূন আহমেদ ক্যানসারের চিকিৎসা নিতে যুক্তরাষ্ট্র যাওয়ার পর প্রথম আলোয় ‘নিউইয়র্কের আকাশে ঝকঝকে রোদ’ শিরোনামে নিয়মিত কলাম লেখা শুরু করেন। এই লেখাটি তারই একটি।]
হারুকি মোরাকামি একজন জাপানি লেখক। ১৯৪৯ সালে জন্ম। বয়সে আমার এক বছরের ছোট। বাস করেন টোকিও শহরে। যেদিন তাঁর নতুন বই প্রকাশিত হয়, সেদিন বইয়ের দোকানের সামনে ক্রেতাদের লম্বা লাইন পড়ে যায়। এই মুহূর্তে আমি মোরাকামির যে বইটি পড়ছি তার নাম Blind Willow, Sellping Women. এটি একটি গল্পের বই। সর্বমোট ২৪টি গল্প বইটিতে আছে। বেশির ভাগই পড়া হয়েছে। দুপুরের খাওয়া শেষ হয়েছে। প্রশস্ত বিছানায় লাল রঙের কমফর্টারের নিচে শুয়ে আছি। পা হট ওয়াটার বোটলে রাখা। হাতে জাপানি লেখকের গল্প। গল্পের নাম ‘The kidney shaped stone that moves everyday’। গল্পটির সঙ্গে আমার লেখা ‘পাথর’ গল্পের অস্বাভাবিক সাদৃশ্য দেখে চমকাচ্ছি। ‘আয়না’ নামে তাঁর একটা গল্প পড়লাম। ‘আয়না’ নামে আমার নিজের একটা গল্প আছে। এই দুটি গল্পও কাছাকাছি। আমার একটি গল্পে লিফটে করে এক পত্রিকা অফিসের পিয়ন অন্য এক জগতে চলে যায়, মোরাকামির একটি উপন্যাসের মূল নায়ক লিফটে করে উঠে অন্য এক জগতে চলে যায়। আমি মোরাকামির লেখা আগে কখনো পড়িনি, এই প্রথম পড়ছি। এই জাপানি লেখকের আমার লেখার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই। তা হলে কি লেখকদের মধ্যে অদৃশ্য অলৌকিক কোনো যোগসূত্র আছে? ন্যুন্ট হামসুনের ভাগাবন্ড উপন্যাসে একটি প্যারা আছে হুবহু বিভূতিভূষণের উপন্যাসের প্যারা। এডগার অ্যালান পোর কবিতার ‘Annabe Lee’ এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘একই গায়ে’ দুই ভাষায় লেখা এক কবিতা। এর অর্থ কী? ক্যানসারে আক্রান্ত হুমায়ূন আহমেদ তাঁর দীর্ঘ দিবস দীর্ঘ রজনী কী করে কাটাচ্ছেন, তা জানার বিপুল আগ্রহ বাংলাদেশের মানুষ দেখাচ্ছেন। কেন এই আগ্রহ তাও বুঝতে পারছি না। সময় প্রতিটি মানুষের জন্য আলাদা। একজনের সময়ে অন্যজনের উঁকি দেওয়াটাও মনে হয় ঠিক না। তবে আমি নিজেই চাচ্ছি কী করছি না করছি, তার একটি রেকর্ড রাখতে। ডায়েরি লেখা আমার স্বভাবের মধ্যে নেই। অভ্যাস থাকলে ডায়েরি লিখতাম। আজ নভেম্বরের ১২ তারিখ। রাত ১২টায় জন্মদিনের কেক কাটা হবে। আইসক্রিম কেক কেনা হয়েছে। ব্যক্তিগত ডায়েরিতে এ অংশটি লেখা যেতে পারে। লাভ কী? অন্যের ব্যক্তিগত ডায়েরি পড়ে কেউ কি আনন্দ পাবে? আমি নিজে পাই না। ভুল বললাম। সালভাদর দালির ডায়েরি পড়ে আনন্দ পেয়েছিলাম। তাঁর আঁকা ছবি দেখে মনে হয়, তিনি ঘোরের এক জগতের বাসিন্দা। ডায়েরি ভিন্ন কথা বলে। আমার অনেক দিনের অভ্যাস—জন্মদিনের রাতে নতুন একটা উপন্যাসে হাত দেওয়া, প্রথম দুই পৃষ্ঠা লিখে ফেলা। মাথায় গল্প এসে বসে আছে। তবে পরাবাস্তব ধরনের কাহিনি। আমেরিকান এক ভূতনীর সঙ্গে নিউইয়র্কের জ্যামাইকার এক বাঙালি রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ীর প্রণয়গাথা। দেখা যাক কী হয়? নিউইয়র্কের প্রবাসী লেখকেরা তাঁদের বই প্রায় প্রতিদিনই পাঠাচ্ছেন। আমি গাজি কাশেম নামে এক লেখকের একটি বইয়ের প্রশংসা করে কালের কণ্ঠে একটি লেখা দিয়েছিলাম (‘মিলন কেন দুষ্ট’)। প্রবাসী লেখকেরা এই কারণেই কি আমার ব্যাপারে আগ্রহী হয়েছেন? আমি তাদের বই পড়ার চেষ্টা করছি। একজন আগ্রহ করে আমাকে তার রচনা পাঠাবে, আমি ফেলে রাখব, তা কখনো হবে না। কষ্টের ব্যাপার হলো, বইগুলো (বেশির ভাগই কবিতা) পড়তে ভালো লাগছে না। আমার ভালো লাগা না-লাগা সাহিত্যের মানদণ্ড না। অনেক বিখ্যাত উপন্যাসই আমার পড়ে ভালো লাগেনি। যেমন, আকতারুজ্জামান ইলিয়াসের চিলেকোঠার সেপাই। আবার অতি সাধারণ উপন্যাসও মুগ্ধ হয়ে বারবার পড়েছি। উদাহরণ, সুবোধ ঘোষের শুন বরনারী। পৃথিবীতে নানান ধরনের পাঠক আছে। আমি অতি নিম্নমানের পাঠক। আমি বই পড়ি গল্পপাঠের আনন্দের জন্য। পড়তে পড়তে বুকের ভেতর দুঃখের একটা মোচড় তৈরি হবে। চোখ পানিতে ভিজে আসবে, কিংবা ঝিলিক দিয়ে উঠবে আনন্দ, এই জন্যই পাঠ। সব পাঠকেরই বই পড়ার একটা নির্দিষ্ট পদ্ধতি আছে। আমার পদ্ধতিটা হলো, যার বই ভালো লাগে, তার সব বই পড়ে ফেলতে হবে। একটিও যেন বাদ না থাকে। আমেরিকায় যখন প্রথম পড়তে আসি (১৯৭৮), তখন ন্যুন্ট হামসুনের একটিমাত্র বই আমার পড়া ছিল। নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরিতে ন্যুন্ট হামসুনের আরও দুটি বই পাওয়া গেল। পড়ে শেষ করলাম। লাইব্রেরিয়ান বললেন, ‘তুমি কি এই লেখকের আরও বই পড়তে চাও?’ আমি বললাম, তোমাদের কাছে তো আর বই নেই। ‘আমরা আনিয়ে দিচ্ছি। আমরা আমেরিকার সব লাইব্রেরিতে খবর পাঠিয়ে দেব। যাদের কাছে ন্যুন্ট হামসুনের বই আছে, তারা ধার হিসেবে আমাদের দেবে। তুমি পড়া শেষ করে বই ফেরত দেবে।’ এই হলো আমেরিকা। বই পড়তে হলে এ দেশের তুলনা নেই। পড়াশোনা করতে এসে কত বিচিত্র ধরনের বই-ই না এই আমেরিকায় পড়েছি। আবার পড়তে শুরু করেছি। ল্যাবি নিভানের একটি সায়েন্স ফিকশন অনেক দিন থেকে খুঁজছিলাম। আমাজান ডট কমে পাওয়া গেছে। তারা মেল করে পাঠিয়ে দিয়েছে। শংকু আইচ (জুয়েল আইচের ভাই) পাঠিয়েছে Nook Book. এই বস্তু দিয়েও নাকি দুনিয়ার বই পড়া যায়। আমি হাইটেক পাঠক না। পাতা উল্টে বই পড়ার পাঠক। Nook Book-এর কী গতি হবে, কে জানে?
পাদটীকা: প্রবাসী লেখক ড. নুরুন নবীর Bullets of 71 পড়ে শেষ করেছি। লেখক সম্পর্কে Far Eastern Review (মে ৬, ১৯৭২) বলছে—কাদের সিদ্দিকীর ডান হাত এবং Brain of the Force (অর্থাৎ মূল মাথা)। ঐতিহাসিক কারণে বইটির অনেক গুরুত্ব। অনেক দিন পর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক একটি গ্রন্থ পড়ে আনন্দ পেয়েছি। মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতায় কাদের সিদ্দিকী সাহেবের বই পড়েও প্রভূত আনন্দ পেয়েছিলাম। বঙ্গবন্ধু পরিবারের হত্যার পর তিনি বাংলাদেশ ছেড়ে হিন্দুস্তানে নির্বাসনে চলে যান। কাদের সিদ্দিকীর ‘স্মৃতিকথা’ তখন কলকাতায় প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশের অবস্থা তখন এমন যে, কেউ এই বই নিয়ে কোনো কথা বলবে না। আমার মনে আছে, কাদের সিদ্দিকীর বই নিয়ে একটি দীর্ঘ আলোচনা করেছিলাম। উনি লোক মারফত আমাকে ধন্যবাদ জানিয়ে একটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন। সরাসরি ডাক বিভাগ ব্যবহার করতেও হয়তো তিনি ভয় পাচ্ছিলেন। আহারে,কত বিচিত্র সময়ের ভেতর দিয়েই না আমরা গেছি !
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই মার্চ, ২০১৫ বিকাল ৫:৩৪