জীবনের শেষ প্রান্তে দাড়িয়ে মুক্তিযোদ্ধা, বাংলাদেশের ব্যান্ড সঙ্গীতের পথিকৃত, অলিখিত সম্রাট - আজম খান। লাইফ সাপোর্ট দিয়ে তাঁকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। মনটা অসম্ভব খারাপ করে বহু পুরনো তাঁর কিছু গান শুনছি,
"হয়ত বা এই দিন থাকবে না কোন দিন।
তুমিও চলে যাবে আমিও চলে যাবো
ধর কোন দিন।"
এই কথাটা সত্যি করে হয়ত আর সকলের মত চলে যাবেন আজম খান। মনে পরে "আসি আসি বলে তুমি", "অভিমানী".... "বাংলাদেশ" গান শুনে জীবনে প্রথম গিটার হাতে নিয়েছি। সেই নব্বই এর গোড়ার দিকে যার গানের অনুপ্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তৈরি হয়েছিল ব্যান্ড সঙ্গীতের নবজাগরণ। যদিও আজম খানের মিউজিক ক্যারিয়ার/জনপ্রিয়তা আরো আগে, দেশ স্বাধীন হবার পর থেকেই। আমার সময় দেখেছি পাড়ায় পাড়ায় ব্যান্ড ফর্ম হতে। তারা সবাই প্রথমেই তুলে ফেলছে আজম খানের গান। সে সময় আমার বাড়ির পাশে মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোডে স্যাটেলাইট ক্লাব নামের একটি ক্লাব দেশের নামকরা ব্যান্ড যেমন, আর্ক, প্রমিথিউস, উইনিং, ফেইথ, সকিং ব্লু আর পাড়ায় উঠতি ৮/১০ ব্যান্ড নিয়ে কনসার্টের আয়োজন করত। মজার ব্যাপার নতুন ব্যান্ডগুলো ২/৩টি গান করার সুযোগ পেলেও একটি না একটি আজম খানের গান কভার করত। আসি আসি, অভিমানী, বাংলাদেশ, সালেকা মালেকা, আলাল আর দুলাল, আমি যারে চাই রে.. এই কটা গান এক কনসার্টে ঘুড়ে ফিরে অন্তত ২০ বার কভার হতে দেখেছি। তাতে বোর হইনি কখনও, এনজয় করেছি অকুণ্ঠ। আমার জীবনে গিটারে হাতে খড়ি হয়েছে আজম খানের গান তুলে। প্রথম কর্ড প্রগ্রেশন/লিডটা বোধ হয় আসি আসি আর অভিমানী গানটার। সব ভুলতে পারি, কিন্তু আজম খানের গান আমার রক্তে ঢুকে গেছে, আমৃত্য সাথে থাকবে এই গানগুলো্।
গুরুর কথা অনুযায়ী, হারিয়ে গেছে, খুঁজে পাবো না। তবু বাংলাদেশ যতদিন টিকে থাকবে, যতবার রচিত হবে বাংলার ইতিহাস, তার সাথে মিশে থাকবে আজম খান ও তাঁর গানগুলো। প্রেরণায়, শিকড়ের টানে ঘুড়ে ফিরে তাঁর কাছে আসতেই হবে।
প্রিয় একটি গান:
আমি যারে চাইরে,
সে থাকে মোরই অন্তরে। ।
আমি তারে পেয়েও হারাইরে। ।
আমি তারে পেয়েও হারাইরে। ।
আমি যারে চাইরে,
সে থাকে মোরই অন্তরে।
এই আছে এই নাই,
অন্তরে নিয়েছে ঠাঁই,
বিরাজ করে সে ভুবনে। ।
আমি তারে পেয়েও হারাইরে। ।
আমি তারে পেয়েও হারাইরে। ।
আমি যারে চাইরে,
সে থাকে মোরই অন্তরে।
ভক্তিতে মুক্তি,
জানি এ শক্তি,
বাসনা পূর্ণ হবে সাধনে। ।
আমি তারে পেয়েও হারাইরে। ।
আমি তারে পেয়েও হারাইরে। ।
আমি যারে চাইরে,
সে থাকে মোরই অন্তরে। ।
আমি তারে পেয়েও হারাইরে। ।
আমি তারে পেয়েও হারাইরে। ।
আজম খানের জনপ্রিয় কিছু গান (এমপিথ্রি) :
১. রেল লাইনের ঐ বস্তিতে (বাংলাদেশ)
২. ওরে সালেকা, ওরে মালেকা
৩.আলাল ও দুলাল
৪. জীবনে কিছু পাবোনা হায়!
৫. অভিমানী
৬. আসি আসি বলে
৭. হয়ত বা এই দিন
৮. হারিয়ে গেছে যে
৯. চুপ টুপ অনামিকা চুপ
১০. মাগো মা, তোর কি ভাবনা
১১. আমি যারে চাইরে
১২. এই সুন্দর দুনিয়ায়
১৩. জ্বালা জ্বালা (ফ্রাসট্রেশন নাই)
আজম খানের সব গান এক সাথে এখানে পাবেন:
গানের এমপিথ্রি
গানের ভিডিও
____________________________________________
মুক্তিযোদ্ধা গায়ক গুরু আজম খান:
নাম: মোহাম্মদ মাহবুবুল হক খান।
মায়ের নাম: মৃত জোবেদা খানম।
বাবার নাম: মৃত মোহাম্মদ আফতাব উদ্দিন খান।
বাবার পেশা: অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার, সেক্রেটারিয়েট হোম ডিপার্টমেন্ট। ব্যক্তিগতভাবে হোমিওপ্যাথির চিকিৎসক ছিলেন।
জন্ম ও জন্মস্থান:
জন্ম: ২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৫০
জন্মস্থান: ১০ নম্বর সরকারি কোয়ার্টার, আজিমপুর কলোনি, ঢাকা।
ছেলেবেলা
১৯৫৫ সালে প্রথমে আজিমপুরের ঢাকেশ্বরী স্কুলে বেবিতে ভর্তি হন।
১৯৫৬ সালে কমলাপুরের প্রভেনশিয়াল স্কুলে প্রাইমারিতে ভর্তি হন।
১৯৬৫ সালে সিদ্ধেশ্বরী হাইস্কুলে বাণিজ্য বিভাগে ভর্তি হন।
১৯৬৮ সালে এসএসসি পাস করেন।
১৯৭০ সালে টি অ্যান্ড টি কলেজ থেকে বাণিজ্য বিভাগে দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হন।
১৯৭১ সালে জগন্নাথ কলেজের বানিজ্যে স্নাতক শ্রেনীর ছাত্র ছিলেন (মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহনের কারনে স্নাতক শ্রেনী শেষ করতে পারেননি)।
১৯৫৬তে তার বাবা কমলাপুরে বাড়ি বানান।
পারিবারিক জীবন:
বিয়ে করেছিলেন ১৯৮১ সালের ১৪ জানুয়ারি ঢাকার মাদারটেকে। তখন তাঁর বয়স ছিল ৩১ বছর।
স্ত্রীর নাম: সাহেদা বেগম।
প্রথম সন্তান: ইমা খান।
নাতনি: কায়নাত ফাইরুজ বিনতে হাসান।
দ্বিতীয় সন্তান: হূদয় খান।
তৃতীয় সন্তান: অরণী খান।
বর্তমান ঠিকানা: ২ নম্বর কবি জসীমউদ্দীন রোড, কমলাপুর, ঢাকা-১২১৭।
বড় ভাই: সাইদ খান।
পেশা: সরকারি চাকরিজীবী।
মেজো ভাই: আলম খান।
পেশা: গীতিকার ও সুরকার।
ছোট ভাই: লিয়াকত আলী খান। মুক্তিযোদ্ধা।
পেশা: ব্যবসায়ী।
ছোট বোন: শামীমা আক্তার খানম।
সহধর্মিনী মারা যাবার পর থেকে একাকী জীবন।
উপাধি:
পপসম্রাট আজম খান
কিংবদন্তি আজম খান
গুরু নামে খ্যাত।
মুক্তিযোদ্ধা আজম খান:
১৯৬৯ সালের গণ অভ্যুত্থানের সময়ে আজম খান পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। তখন তিনি ক্রান্তি শিল্পী গোষ্ঠীর সক্রিয় সদস্য ছিলেন এবং পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর শোষণের বিরুদ্ধে গণসঙ্গীত প্রচার করেন।১৯৭১ সালে আজম খানের বাবা আফতাব উদ্দিন খান সচিবালয়ের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা।বাবার অনুপ্রেরণায় যুদ্ধে যাবার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন আজম খান। ১৯৭১ সালে যুদ্ধ শুরু হলে তিনি পায়ে হেঁটে আগরতলা চলে যান।আগরতলার পথে তার সঙ্গী হন তার দুই বন্ধু। এসময় তার লক্ষ্য ছিল সেক্টর ২ এ খালেদ মোশাররফের অধীনে যুদ্ধে যোগদান করা। আজম খান মুক্তি যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন ২১ বছর বয়সে। তার গাওয়া গান প্রশিক্ষণ শিবিরে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণ যোগাতো। তিনি প্রাথমিক প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন ভারতের মেলাঘরের শিবিরে।যুদ্ধ প্রশিক্ষণ শেষে তিনি তিনি কুমিল্লায় পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে সমুখ সমরে অংশ নেয়া শুরু করেন।কুমিল্লার সালদায় প্রথম সরাসরি যুদ্ধ করেন। এর কিছুদিন পর তিনি পুনরায় আগরতলায় ফিরে আসেন। এরপর তাকে পাঠানো হয় ঢাকায় গেরিলা যুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য। আজম খান ছিলেন দুই নম্বর সেক্টরের একটা সেকশনের ইনচার্জ।আর সেক্টর কমান্ডার ছিলেন কর্নেল খালেদ মোশাররফ। ঢাকায় তিনি সেকশান কমান্ডার হিসেবে ঢাকা ও এর আশেপাশে বেশ কয়েকটি গেরিলা আক্রমণে অংশ নেন। আজম খান মূলত যাত্রাবাড়ি-গুলশান এলাকার গেরিলা অপারেশান গুলো পরিচালনার দায়িত্ব পান। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল তার নেতৃত্বে সংঘটিত "অপারেশান তিতাস" । তাদের দায়িত্ব ছিল ঢাকার কিছু গ্যাস পাইপলাইন ধ্বংস করার মাধ্যমে বিশেষ করে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল (বর্তমান শেরাটন হোটেল) , হোটেল পূর্বানীর গ্যাস সরবরাহে বিঘ্ন ঘটানো। তাদের লক্ষ্য, ঐ সকল হোটেলে অবস্থানরত বিদেশি রা যাতে বুঝতে পারে যে দেশে একটা যুদ্ধ চলছে।এই যুদ্ধে তিনি তার বাম কানে আঘাতপ্রাপ্ত হন সেটি এখনো তার শ্রবণক্ষমতায় বিঘ্ন ঘটায়।আজম খান তার সঙ্গীদের নিয়ে পুরোপুরি ঢাকায় প্রবেশ করেন ১৯৭১ এর ডিসেম্বারের মাঝামাঝি। এর আগে তারা মাদারটেকের কাছে ত্রিমোহনী তে সংগঠিত যুদ্ধে পাক সেনাদের পরাজিত করেন।
গায়ক আজম খান:
আজম খানের কর্মজীবনের শুরু প্রকৃতপক্ষে ৬০ দশকের শুরুতে। ৭১ এর পর তার ব্যান্ড উচ্চারণ এবং আখন্দ ( লাকী আখন্দ এবং হ্যাপী আখন্দ ) ভাতৃদ্বয় দেশব্যাপী সংগীতের জগতে আলোড়ন সৃষ্টি করে। বন্ধু নিলু আর মনসুরকে গিটারে, সাদেক ড্রামে আর নিজেকে প্রধান ভোকাল করে করলেন অনুষ্ঠান। তারপর একদিন বিটিভিতে প্রচার হলো সেই অনুষ্ঠান। সেটা ৭২ সালের কথা। ‘এতো সুন্দর দুনিয়ায় কিছুই রবে না রে’ আর ‘চার কালেমা সাক্ষী দেবে’ গান দুটি সরাসরি প্রচার হলো বিটিভিতে। ব্যাপক প্রশংসা আর তুমুল জনপ্রিয়তা এনে দিলো এ দুটো গান। দেশজুড়ে পরিচিতি পেয়ে গেলো তাদের দল আজম খান ১৯৭৪-১৯৭৫ সালের দিকে বাংলাদেশ টেলিভিশনে বাংলাদেশ ( রেললাইনের ঐ বস্তিতে) শিরোনামের গান গেয়ে হইচই ফেলে দেন।তার পাড়ার বন্ধু ছিলেন ফিরোজ সাঁই। পরবর্তীতে ওর মাধ্যমে পরিচিত হন ফকির আলমগীর, ফেরদৌস ওয়াহিদ, পিলু মমতাজ এদের সাথে। এক সাথে বেশ কয়েকটা জনপ্রিয় গান করেন তারা। এরই মধ্যে আরেক বন্ধু ইশতিয়াকের পরামর্শে সৃষ্টি করেন একটি এসিড-রক ঘরানার ‘জীবনে কিছু পাবোনা এ হে হে!আজম খানের দাবী এটি বাংলা গানের ইতিহাসে- প্রথম হার্ডরক
অন্যান্য ভূমিকায় আজম খান:
১৯৯১—২০০০ সালে তিনি প্রথম বিভাগ ক্রিকেটখেলতেন গোপীবাগ ফ্রেন্ডস ক্লাবের হয়ে।
লেখার এই অংশটি ব্লগার সংকলক এর কাছ হতে সংগৃহীত।
__________________________________________
আমি যুদ্ধ শেষ করতে পারি নি: আজম খান
(এই লেখাটি এর আগে সচলায়তন ডটকমে প্রকাশিত)
আমার নকশালাইট বড়ভাই মানব ৭০ দশকে যখন লম্বা চুল রেখে, বেল বটম প্যান্ট পরে, গিটার বাজিয়ে আজম খানের গান করতেন, তখন সেই শৈশবে পপ সম্রাট এই শিল্পীর গানের সঙ্গে পরিচয়। আরো পরে লংপ্লেয়ারে তার নানান হিট গান শুনেছি।
তাকে আমি সামনা - সামনি প্রথম দেখি ১৯৮৬ - ৮৭ সালে, এএইচসিতে পড়ার সময়। বুয়েটের মাঠে কনসার্ট হচ্ছে -- গাঁদাগাদি ভীড়, গাঁজার ধোঁয়া, 'গুরু, গুরু' জয়ধ্বনী, আর তুমুল হট্টগোলের ভেতর সেদিন শিল্পীকে ভাল করে চোখেই পড়েনি। তবু রাতে বন্ধুরা দল বেঁধে গান করতে করতে ফিরেছিলাম, হাইকোর্টের মাজারে, কতো ফকির ঘোরে, কয়জনা আসলও ফকির?...
মুক্তিযুদ্ধের সময় আগরতলার রণাঙ্গনে তার মুক্তিযোদ্ধাদের গান গেয়ে শোনানোর কথা জানতে পারি 'একাত্তরের দিনগুলি'তে। তো, আজম খান সব মিলিয়ে আমার কাছে এক বিরাট আইকন।
শুধু মাত্র মুক্তিযুদ্ধকে ফোকাস করে শিল্পীর সঙ্গে কথোপকথনের জন্য আমি তার ফোন নম্বর খুঁজতে শুরু করি। এ পত্রিকা, সে পত্রিকার অফিসে খোঁজ করে কোথাও তার নম্বর পাই না। বিনোদন পাতার এক সাংবাদিক আমাকে জানালেন, তিনি মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন না। আর তার বাসার ল্যান্ড ফোনটিও অনেকদিন ধরে বিকল!
তবু লোকেশন জেনে হাজির হই এক বিকালে তার উত্তর কমলাপুরের বাসায়। একটি দাঁড় করানো জুতোর বাক্সের মতো লম্বালম্বি পুরনো একচিলতে দোতলা ঘর। সরু সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে দরজা ধাক্কাতে একটি মেয়ে বের হয়ে এসে বললেন,
“আঙ্কেল তো খুব অসুস্থ্য। আজ দেখা হবে না। আপনি কাল সকালে আসুন।”
পরদিন সকালে আবার হামলা। এবার দরজা খোলা। নক করতেই সেই বিখ্যাত খনখনে গলা,
'' কে রে?''...
আমি উঁকি দিয়ে অনেকটা ঠেলেই ঘরে ঢুকে পড়ি। একটা সালাম ঠুকে ভয়ে ভয়ে বলি আগমনের হেতু।
শিল্পী তখন একটি খাটে শুয়ে পা দুলচ্ছেন। পরনে একটি সাদা টি শার্ট আর ট্র্যাকিং প্যান্ট। ফর্সা, লম্বা আর হাড্ডিসার ফিগারে এই বয়সেও (৫৭) তাকে সুদর্শন লাগে।
সব শুনে তিনি বলেন,
"একাত্তরের কথা কেউ মনে রেখেছে না কি? আর তাছাড়া আমি তো যুদ্ধ শুরু করেছিলাম মাত্র, শেষ করতে পারি নি। আমার যুদ্ধ ভারতীয় সেনারাই তো শেষ করে দিলো!"
শুরু হলো আনুষ্ঠানিক কথোপকথন। পুরো সময় শিল্পী শুয়েই রইলেন। মাঝে মাঝে বিছানার পাশে রাখা একটি গিটার ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখেন। খুক খুকে কাশি দেখে বুঝি, তার শরীর বেশ খারাপ করেছে।...
“যুদ্ধে গেলেন কেনো” আমি জানতে চাই।
"১৯৬৮ টিতে ছাত্রাবস্থায় আমরা বন্ধু - বান্ধব মিলে গান করতাম। সেই সময় আমি গণসঙ্গীত শিল্পী গোষ্ঠি 'ক্রান্তি'র সঙ্গে যুক্ত হই। ঢাকায়, ঢাকার বাইরে গান করতে গেলে পুলিশ নানা রকম হয়রানী করতো।"
“১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানের সময় দেশপ্রেম থেকে আমরা রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে অবরোধ তৈরি করতাম। ১৯৭১ সালে যুদ্ধ শুরু হলে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর ভয়ে বাসায় টেঁকা যেতো না। সেই সময় বন্ধু - বান্ধব দল বেধে সিদ্ধান্ত নিলাম, ঢাকায় থাকলে এমনিতেই মরতে হবে, তার চেয়ে যুদ্ধ করে মরাই ভাল। তখন সবাই একসঙ্গে যুদ্ধে যাই।”
“আম্মাকে বললাম, আমি যুদ্ধে যাচ্ছি। আম্মা বললেন, যুদ্ধে যাবি, ভাল কথা, তোর আব্বাকে বলে যা। আব্বা ছিলেন সরকারি চাকুরে। ভয়ে ভয়ে তাকে বলালাম, যুদ্ধে যাচ্ছি। উনি বললেন, যাবি যা, তবে দেশ স্বাধীন না করে ফিরবি না! তার কথা শুনে অবাক হয়ে গেলাম। একটা সালাম দিয়ে যুদ্ধে যাই। তখন আমার বয়স ২১ বছর।”
জানতে চাই, “মাসটি মনে আছে?”
“আরে না রে ভাই। যুদ্ধের সময় এতো মাস - তারিখ মনে রাখা সম্ভব নয়।... প্রথমে কুমিল্লা বর্ডার দিয়ে ত্রিপুরার আগরতলা যাই। সেখান থেকে মেলাঘরে মুক্তিযুদ্ধের ২ নম্বর সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফের সেক্টরে মেজর এটিএম হায়দারের কাছে দু'মাস গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেই। কুমিল্লার সালদায় পাকিস্তানি সেনা বাহিনীর সঙ্গে একটি সম্মুখ সমরে সাফল্যের পর আমাকে ঢাকার গেরিলা যুদ্ধের দায়িত্ব দেওয়া হয়।”
“১৯৭১ সালে ঢাকার মুক্তিবাহিনীর একটি গেরিলা গ্রুপের সেকশন কমান্ডার হিসেবে আমি যাত্রা বাড়ি, ডেমরা, গুলশান, ক্যান্টনমেন্ট এলাকাসহ বেশ কয়েকটি সম্মুখ সমরে যুদ্ধ করি, এ সব যুদ্ধের নেতৃত্ব দেই।”
“মুক্তিযুদ্ধের কোনো বিশেষ স্মৃতি?...”
আজম খান বলেন, “শহীদ মুক্তিযোদ্ধা জাকিরের কথা প্রায়ই মনে পড়ে। ঢাকার গোপীবাগে একজন আহত মুক্তিযোদ্ধাকে বাঁচাতে গিয়ে সে পাকিস্তানী সেনাদের গুলিতে মারা যায়।... সে সময় জাকিরের মৃত্যর খবর আমি গ্রুপের কাছে চেপে গিয়েছিলাম, নইলে তারা মনোবল হারাতে পারতো।”
অবহেলিত মুক্তিযোদ্ধাদের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, “এই তো সেদিন ফকিরাপুলে আমার গ্রুপের একজন মুক্তিযোদ্ধাকে দেখি, ফুটপাতে চা বিক্রি করছে! কি আর করবে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যার ভেতর আছে, সে তো আর চুরি করতে পারে না!...মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো সরকারই তো মূল্যায়ন করেনি। এর পাশাপাশি অনেক বিপথগামী মুক্তিযোদ্ধা সে সময় লুঠপাট - ডাকাতি করেছে, বিহারীদের বাড়ি - জমি দখল করেছে, মা - বোনদের ইজ্জত হানী করেছে। অনেকে ডাকাতি করতে গিয়ে গণপিটুনিতে মারাও গিয়েছে।”
“আমি নিজেও এ সব কারণে অনেক বছর নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিচয় দেই নি।...বিপথগামী মুক্তিযোদ্ধাদের কারণে জাতিও বহুবছর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানের চোখে দেখেনি।”
“স্বাধীনতা বিরোধী -- যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কী ভাবে সম্ভব?”
“অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন স্বাধীনতা বিরোধী - যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কঠিন হয়ে গেছে” -- কথা জানিয়ে শিল্পী বলেন, “এখন রাজাকার, আল - বদর, আল - শামসরা সাংগঠনিকভাবে অনেক বেশী শক্তিশালী। একজন গোলাম আজমের বিচার করলেই এদের ভিত্তি নির্মূল করা যাবে না। এদের যে বিস্তৃতি গত ৩৬ বছরে ঘটেছে, তাকে উৎখাত করা সত্যিই কঠিন। তবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার একদিন না একদিন হতেই হবে।”
“স্বাধীনতার পর পরই এই বিচার হওয়া উচিৎ ছিল। কিন্তু তা হয়নি, কারণ ভারত সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে হস্তক্ষেপ করে পাকিস্তানী সেনাদের স্ব-সম্মানে পাকিস্তানে ফেরৎ পাঠিয়েছে। একই সঙ্গে এর পরের সরকারগুলো ক্ষমতার লোভে পাক সেনাদের সহযোগি যুদ্ধাপরাধীদের লালন - পালন করেছে।”
“কিন্তু তা না হয়ে ভারত যদি মুক্তিযুদ্ধে শুধু সহায়কের ভুমিকা পালন করতো, আমরা নিজেরাই যদি আমাদের যুদ্ধ শেষ করতে পারতাম, তাহলে পরিস্থিতি ভিন্ন হতো। নয় মাসে নয়, নয় বছর পরেও দেশ স্বাধীন হলে আমরা স্বাধীনতা বিরোধী - যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে পারতাম।”
“কিন্তু যুদ্ধাপরাধ কখনো তামাদী হয় না। তবে এদের বিচার বিলম্বিত হওয়ায় অনেক সাক্ষ্য - প্রমান সংগ্রহ করা এখন কঠিন হয়ে গেছে। তাই অনেক দেরীতে হলেও আন্তর্জাতিক আদালত বসিয়ে এর বিচার করা উচিত। এ জন্য সরকারের সদিচ্ছা ছাড়াও আন্তর্জাতিক সমর্থন প্রয়োজন।”
“স্বাধীনতা বিরোধী - যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দায়িত্ব সৎ ও দেশপ্রেমিক সরকারকেই নিতে হবে। তবে যতদিন এটি জাতীয় দাবিতে পরিনত না হবে, ততদিন কোনো সরকারই এই বিচার করবে না।”
এবার আমি পপ সম্রাটের গানের জগতে ফিরে আসি। সেখানেও আমার জিজ্ঞাস্য মুক্তিযুদ্ধ, “আচ্ছা, আজম ভাই, মুক্তিযুদ্ধের পর 'রেল লাইনের ওই বস্তিতে' বা 'ফ্রাস্টেশন' -- ইত্যাদি গানে আপনার হতাশা ফুটে উঠছে কেনো? গানের ভেতরে মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জ্বল দিকগুলো কেনো প্রকাশ পায়নি?”
“তখনকার প্রেক্ষাপটে এই সব গান করেছিলাম।... যে আশা নিয়ে আমরা যুদ্ধে গিয়েছিলাম, যুদ্ধের পর আমাদের সে আশা পূরণ হয়নি। পাকিস্তান আমলে ঘুষ - দুর্নীতি ছিল না। বাজারে সব জিনিসের একদর ছিল। আর যুদ্ধের পর ঘুষ - দুর্নীতি, কালোবাজারী, লুঠপাটে দেশ ছেয়ে গেল। সব জিনিসের দাম হু হু করে বাড়তে লাগলো। শুরু হলো ১৯৭৪ এর দুর্ভিক্ষ। আর বঙ্গবন্ধু রক্ষীবাহিনী গঠন করে আরেকটি বড় ভুল করলেন। সারাদেশে শ্লোগান উঠলো -- সোনার বাংলা শ্মশান কেনো?... এই পরিস্থিতিতে তখন ওই সব হতাশার গান।”
“এখন কী নতুন প্রজন্মকে নতুন করে মুক্তিযুদ্ধের গান, নতুন আশার গান শোনাবেন?”
হতাশা ছড়িয়ে পড়ে শিল্পীর গলায়, “এই প্রজন্মের কেউ তো মুক্তিযুদ্ধের গান শুনতে চায় না! এদের জন্য এই সব গান করে লাভ নেই। তারা তো মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসই জানে না।...তবু এখন দেশ গড়ার গান করছি। দেশের দুঃসময়ে আমাদের আমি এই প্রজন্মকে অন্য এক মুক্তির গান শোনাতে চাই। কারণ এ দেশের অর্থনৈতিক মুক্তি, প্রগতিশীল চিন্তা - চেতনার মুক্তি এখনো আসেনি।”...
কথোপকথনের শেষ পর্যায়ে এসে হাজির হন সহকর্মী ফটো সাংবাদিক ফিরোজ আহমেদ। বাসার সঙ্গের খোলা ছাদে একটি বাতাবি লেবুর গাছ। ফিরোজ বললেন, “আউটডোরে এখানেই ছবি ভাল হবে।” আমি বললাম, “আজম ভাই, সাদা জামাটা বদলে নেবেন না কি? রঙিন জামায় ছবি ভাল আসবে।”
তিনি শিশু সুলভ হাসি দিয়ে বললেন, “দাঁড়াও একটা সবুজ জ্যাকেট পরে আসি... বেশ খানিকটা ফ্রিডম ফাইটার, ফ্রিডম ফাইটার দেখাবে!”
শুরু হলো, আমাদের ফটো সেশন।...
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে মে, ২০১১ সন্ধ্যা ৭:১৪