অক্ষয়কুমার দত্ত, বাঙালি সাংবাদিক, প্রবন্ধকার এবং লেখক। তিনি ছিলেন ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলার নবজাগরণ যুগের অন্যতম কবি ও ধর্মচিন্তাবিদ। অক্ষয়কুমার সংবাদপত্রে লেখালেখির মাধ্যমে লেখক জীবন শুরু করেন। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত সম্পাদিত সংবাদ প্রভাকর পত্রিকায় তিনি নিয়মিত লিখতেন; তিনি মূলত ইংরেজি সংবাদপত্রের প্রবন্ধগুলি বাংলায় অনুবাদ করতেন। বাংলা, সংস্কৃত এবং ফারসিসহ বিভিন্ন ভাষায় তার দক্ষতা ছিল। বাংলার নবজাগরণ যুগের অন্যতম কবি অক্ষয়কুমারের আজ জন্মদিন। জন্মদিনে কবিকে শুভেচ্ছা।
অক্ষয়কুমার দত্ত ১৮২০ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ জুলাইতে বর্ধমান জেলার চুপী গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। পিতা পীতাম্বর দত্ত এবং মাতা দয়াময়ী দেবীর কনিষ্ঠ পুত্র অক্ষয়কুমার। শৈশবে তিনি পিতাকে হারান। তারপর তিনি দারিদ্র-দশার ভিতর প্রতিপালিত হয়েছেন। এ ছাড়া দীর্ঘকালব্যাপী নানাবিধ অসুখে ভুগেছেন। ওরিয়েন্টাল সেমিনারীতে বছর-দুই পড়ার পরেই পিতৃবিয়োগের ফলে প্রাতিষ্ঠানিক পড়া স্থগিত হয়ে যায়। এরপর তিনি ছেড়ে দেন অর্থোপার্জনে উদ্যোগী হন। ইনি নিজের চেষ্টায় সংস্কৃত, ফারসী, জার্মান প্রভৃতি বিভিন্ন ভাষায় গভীর পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। মাত্র ১৪ বছর বয়সে তিনি অনঙ্গমোহন নামক কাব্যগ্রন্থ রচনা করেন। একটু বড় হয়ে, তিনি ঈশ্বর গুপ্ত সম্পাদিত সংবাদ প্রভাকর পত্রিকার জন্য ইংরেজী সংবাদপত্র থেকে প্রবন্ধাবলী বঙ্গানুবাদ শুরু করেন। এই ভাবে গদ্য রচনার সূত্রপাত।
অক্ষয়কুমার দত্ত ১৮৩৯ খ্রিষ্টাব্দে তত্ত্ববোধিনী সভার সভ্য হন এবং কিছুদিন এই সভার সহ-সম্পাদক ছিলেন। ১৮৪০ খ্রিষ্টাব্দে তত্ত্ববোধিনী পাঠশালার শিক্ষকের পদে নিযুক্ত হন। ১৮৪১ খ্রিষ্টাব্দে তত্ত্ববোধিনী সভা থেকে তাঁর রচিত বাংলা ভূগোল প্রকাশিত হয়। ১৮৪২ খ্রিষ্টাব্দে টাকির প্রসন্নকুমার ঘোষের সহযোগিতায় বিদ্যাদর্শন নামক একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। দু'টি সংখ্যার পর পত্রিকাটি বন্ধ হয় যায়।
১৮৪৩ সালের ১৬ আগস্ট তারিখে তাঁর সম্পাদনায় ব্রাহ্মসমাজ ও তত্ত্ববোধিনী সভার মুখপাত্র তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা আত্মপ্রকাশ করে। রচনাসম্ভারে ও পরিচালনার গুণে পত্রিকাটি শ্রেষ্ঠ বাংলা সাময়িকপত্রে পরিণত হয়। পত্রিকাটিতে তত্ত্ববিদ্যা, সাহিত্য, দর্শন, ইতিহাস, পুরাতত্ত্ব, বিজ্ঞান, ভূগোল প্রভৃতি নানা-বিষয়ক প্রবন্ধ থাকত। সচিত্র প্রবন্ধও থাকত। স্ত্রী-শিক্ষার প্রসার ও হিন্দু-বিধবাদের সমর্থনে এবং বাল্যবিবাহ ও বিবিধ কুসংস্কারের বিরুদ্ধে যুক্তিবহুল বলিষ্ঠ লেখাও এতে প্রকাশিত হত। নীলকর সাহেব ও জমিদারদের প্রজাপীড়নের বিরুদ্ধে তিনি এই পত্রিকায় নির্ভীক ভাবে লেখনী চালনা করেন। ১২ বছর এই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। উল্লেখ্য তাঁর পৌত্র ছিলেন প্রখ্যাত কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত অর্থাৎ অক্ষয়কুমার দত্ত ছিলেন "The Wizard of Rhymes" বা ছন্দের জাদুকর খ্যাত কবি ও ছড়াকার কবি ও ছড়াকার সত্যেন্দ্রনাথ দত্তেদাদু।
(কবি ও ছড়াকার সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত)
কবি ও ছড়াকার সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত সম্পর্কে জানতে দেখুনঃ ছন্দের জাদুকর খ্যাত কবি ও ছড়াকার সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত
অক্ষয়কুমার দত্ত ১৮৪৩ খ্রিষ্টাব্দের ২১ ডিসেম্বর, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং অপর ২১ জন বন্ধুর সঙ্গে রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশের কাছে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষাগ্রহণ করেন। উল্লেখ্য এই দলই প্রথম দীক্ষিত ব্রাহ্ম। বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদে বিশ্বাসী অক্ষয়কুমার বেদের অভ্রান্ততা স্বীকার করতেন না। এ সম্পর্কে তিনি তিনি যে আন্দোলন আরম্ভ করেন, তার ফলে দেবেন্দ্রনাথ ও ব্রাহ্মসমাজ শাস্ত্রের অভ্রান্ততায় বিশ্বাস বর্জন করেন। ব্রাহ্মসমাজে সংস্কৃত ভাষার পরিবর্তে বাংলা ভাষায় ঈশ্বরোপাসনার তিনি অন্যতম প্রবর্তক। পরে তিনি প্রার্থনাদির প্রয়োজন স্বীকার করতেন না এবং শেষ বয়সে অনেকটা অজ্ঞাবাদী হয়ে পড়েন।
১৮৫৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ জুলাই বিদ্যাসাগর কলিকাতায় নর্ম্যাল স্কুল স্থাপন করলে, অক্ষয়কুমার ১৫০ টাকা বেতনে প্রধান শিক্ষকের পদে নিযুক্ত হন। কিন্তু মাথার প্রদাহজনীত রোগের প্রাবল্যে তিন বছর পরে এই কাজ ত্যাগ করতে বাধ্য হন। এরপর 'তত্ত্ববোধিনী সভা' থেকে তাঁকে মাসিক ২৫ টাকা বৃত্তিদানের ব্যবস্থা হয়। কিন্তু অল্পকালমধ্যেই পুস্তকাবলীর আয় বৃদ্ধি পাওয়ায় তিনি বৃত্তিগ্রহণ বন্ধ করেন।
তাঁর রচিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থঃ
ভূগোল (১৮৪১), বাহ্যবস্তুর সহিত মানব প্রকৃতির সম্বন্ধ বিচার (১ম ভাগ ১৮৫২, ২য়ভাগ ১৮৫৪), ধর্মনীতি (১৮৫৫), চারুপাঠ (১ম ভাগ ১৮৫২, ২য় ভাগ ১৮৫৪, ৩য় ভাগ ১৮৫৯) পদার্থবিদ্যা (১৮৫৬), ভারতবর্ষীয় উপাসক-সম্প্রদায় (প্রথম ভাগ ১৮৭০, দ্বিতীয় ভাগ ১৮৮৩) 'ভারতবর্ষীয় উপাসক-সম্প্রদায়; নামক পাণ্ডিত্যপূর্ণ গবেষণা-গ্রন্থটি তার শ্রেষ্ঠকীর্তি (প্রথম ভাগ ১৮৭০, দ্বিতীয় ভাগ ১৮৮৩)। গ্রন্থখানির সুদীর্ঘ উপক্রমণিকায় তিনি আর্যভাষা ও সাহিত্যের প্রধান শাখাত্রয় (ইন্দো-ইউরোপীয়, ইন্দো-ইরানীয় এবং বৈদিক ও সংস্কৃত) সম্বন্ধে গভীর পাণ্ডিত্যপূর্ণ আলোচনা করেন।
১৮৮৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ মে মৃত্যুবরণ করেন অক্ষয়কুমার দত্ত। আজ এই কবির জন্মদিন, জন্মদি্নে কবির জন্য আমাদের শুভেচ্ছা
সূত্রঃ
বাঙালি চরিতাভিধান। প্রথম খণ্ড। সাহিত্য সংসদ। জানুয়ারি ২০০২
বাংলা বিশ্বকোষ। প্রথম খণ্ড। নওরোজ কিতাবিস্তান। ডিসেম্বর, ১৯৭২