আলো পরিষ্কার করা যায় না। আলোর, রক্ষাগারে নিয়োজিত হলেই সবাই আলো হতে পারে না। সমস্যাগুলো উপভোগ করলে; এর সমস্ত বাঁধা সমাধান হতে থাকে। বোঝা সরে যায়।
গার্হস্থ্য প্রজাতির হয়েও বিড়াল কখন ইঁদুরের মতো সমাজের চোর গোত্রের পালে চলে আসে? সম্ভবতঃ সামাজিক আলোতে জন্ম নেয়া লোভ থেকেই। দেখা যায়, মাঝে মাঝে পোষ মেনেও বিড়ালের খাবার জোটে না; তাই বোধহয় তাকে নিচু হতে হয়। ছুচোর মতো নিচু এমন লোকে সমাজ পূর্ণ।
ভদ্র সীমায় থাকলেও সবাই ভদ্র নয়। অনেকে ভদ্রতার শীখরে বসে পাপ করে; পাপের কাছে বন্দী হয়। পাপ উপভোগ করার জন্য নয়; এর থেকে বিরত থাকায় পূণ্য৷ অনেকে আলোর মশালে নীচে থেকে আলো-ছায়ার খেলায় নিজেকে মেলে ধরে। এমনভাবে পাপ ও পূণ্যের মিশ্রণেও মানুষের জন্ম। মানুষ পাক; মানুষ নাপাক৷ নাপাকের দ্বারাও পূণ্য দেখা যায়৷ পাকের দ্বারা তেমনি পাপও দেখা যায়৷
পূণ্য ভাবা পাপাচার পানি হলেই তার রঙ নির্মল হবে; সাদা অভিমানে সঞ্চিত হবে, মানুষ হওয়ার মনোদ্যোগ। এরপর হিংসা, ঈর্ষা, অহংকারের দুষ্টরক্ত শোধন করে; কেউ কেউ হাসতে শিখবে; কেউ কেউ অভিমানে ভরবে হৃদয়।
সহজ ভাবনা, সরল চিন্তা থেকেই বিপ্লব এসেছে। ভণ্ডরা ধবধবে সুন্দর কাপড়ে সত্যের ছদ্মবেশ নিলেও নিন্দিত। কারণ তারা সত্যের অবয়বে ঘৃণার প্রতিচ্ছবি বিক্রি করে খাবারের প্লেটে মানুষ খায়, বিপ্লবের পাতা খায়। অথচ সহজ-সরল সাধারণ ভাবনা, সাধারণ জীবনেই স্বর্গের বায়ুদল ঘুমের সাথে মিশে, মানুষকে শ্রান্তি দেয়।
বৃষ্টিভেজা চাঁদনী রাতে, একটি কলমি ডগার সাক্ষাতকালে, দু-একটি কচু ফুলের গল্প করতে করতে, হয়ত কোনো এক পাগলের মুক্তি হবে। অবেলায়; স্বাভাবিক হেলায়; কলমি ফুলের যৌবনে সবার জন্য হাত রাখা বারণ। অনুভবহীন দেহ লীলায়, পাগলেরা মরে যায়।
তবুও
অতি আলোতে ভাসা মৃতের দেহ থেকে বিচ্চূত বিকেলের অন্ধকারের একটি গল্প মনে পড়ল।
নগরে, নাগরের ভীড় থেকে একটু দূরের গল্প এটি। লোক না দেখলেও যেথায় সুখ থাকে; সেখানকার ছোট ছোট জীবনানুভব মিলে যে গল্পরা চির সৌভাগ্যের সাথে নিজেদের বাঁচিয়ে রেখেছে; তাদের দলের গল্প। প্রকাশ্য সফলতার মাঝেও শত শত প্রাণ হেরে যায়; ব্যর্থ থাকে আমরণ। তাই বোধের বচন, ত্বরায় ডরাই; ধীরায়ই না হয় জীবন বাড়াই।
বৈশাখের পূর্বেই বোশেখীর নিরানন্দ বৃষ্টিতেও হাফিজকে কে যেন ঘরের বাইরে বের করল। সন্ধ্যা সন্ধ্যা অন্ধকারের বৈকালি সময়ের বৃষ্টিতে ধীর পায়চারি তার ভালো লাগে। বৃষ্টি আছে; ছাতা আছে; রাস্তাটিও বর্ষার মতো কাদাময় হয় নি। তাহলে সে কীভাবে এই মহামায়ার অনুভব থেকে বঞ্চিত থাকে।
পাকা রাস্তা পার হয়ে দু’পাশে দুর্বা ঢাকা ইট বিছানো গ্রামের চির চেনা রাস্তায় হাটছে সে। পাশের জমিতে ধান গাছের গোড়ায় মরা পাতার নড়াচড়া দেখতে দেখতে তার মন চলে গেল দূরের তাল-খেজুর গাছের সারির দিকে।
এমনই এক বৃষ্টির দিন; অনুভব হলো তার। শরীরের লোম বুকের প্যারালাইজ্ড ধুকধুক শব্দের সাথে সাথে তাল দিতে পারল না। বয়সের সাথে সাথে স্মৃতির হৃদয় স্পন্দন কমে গিয়েছে।
নীরদ বাবুদের ঘাটের ঐ পাশে ছিল তার বাড়ি। বৃষ্টিতে গোসলের নিমিত্তে
সরলা তার বান্ধবীদের নিয়ে শামুক কুড়াচ্ছে। মেয়েটি সরল হাসি দিত। তার পোশাক ছিল মার্জিত। লাজ লাজ ভঙ্গিমায় এই হিজল তলার পাশেই সে প্রথম আড় চোখে হাফিজকে দেখেছিল।
হাফিজ এর আগে কারও আড় চোখের মায়ায় পরেনি। সেই মেয়েটিই প্রথম তার দিকে ভিন্ন রকমের ভিন্ন দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল। নারী-পুরুষের বিভেদ যে টান সৃষ্টি করে; তেমন টান এখানে ছিল না। শরতের মেঘের মতো অজানা কোনো সম্পর্কের আত্মিক টানে তারা কিছুদিনের পরিচয়ে চিরঞ্জীবের ভাবাবেগে জড়িয়ে যায়।
বৃষ্টির দৃঢ় সিদ্ধান্তে সে দিন বৃষ্টির অঝোর ধারা ঝরছিল টিনের চালে, খালে, বিলে কিংবা কাদাময় গেয়োদের রাস্তায়। সকলের জন্য যখন গৃহে বন্দী থাকাটাই বাধ্যবাদকতা হয়; তখও কেন জানি সরলা তার সখীদের নিয়ে শামুক কুড়ানোর প্রতিজ্ঞায়, প্রতিজ্ঞাবহ হলো।
শহরে বেড়ে ওঠা হাফিজ কোনোদিন এমন অঝোর ধারায় ভিজে নি। কিন্তু সে দিন সম বয়সী চাচাতো ভাই ওর জানালাই এসে বাউণ্ডুলেদের রঙ্গে দৈড়ানোর নিমন্ত্রণ জানালো। পাঁচ-ছয় জনের দল বেড়িয়ে গেল বৃষ্টির মিছিলে। বৃষ্টির প্রতিটি ফোটার সঙ্গে মিশে যেতে যেতে তারা গাছে উঠল; দৌড়ালো; বাগানের পেয়ারা খেল; বাঁশের চারের উপর থেকে বহুক্ষণ লাফালাফি করল।
একটানা বৃষ্টির বর্ষণে পাপের দরজা যেন সেদিন বন্ধ হয়েছিল; সবাই ফিরে গেলেও সরলা ফিরে নি। হাফিজও রয়ে গিয়েছিল বাড়ি ফেরার প্রস্তুতিতে। সকাল থেকে বিকেল, একটানা সে বৃষ্টি স্নাত সময়ের কথা মনে পড়ে হাফিজের। বৃষ্টি সঙ্গীদের অগোচরে, কী এক অজানা সম্পর্কে দু’জনে দাড়িয়ে ছিল সেদিন দীর্ঘ বৃষ্টির অঝোর বর্ষণে।
আজ, প্রায় বিশ বছর পরে হাফিজ গ্রামে এসেছে। তার স্ত্রী ও ছেলেরা গ্রামের হাওয়ায় বেশ মুগ্ধ হচ্ছে।
হাফিজকে পেয়েই যেন গ্রামের আবহাওয়া বৃষ্টি আনল। কোনো এক অজানা টানে, ছাতা হাতে হাফিজ ঘর ছেড়ে বেড় হলো। বড় ছেলেটি জিজ্ঞাসা করল, “বাবা, এই কাদার মধ্যে কোথায় যাচ্ছ?”।
ছেলের কাদাময় অনুভবে হাফিজ পায়ের জুতা খুলে নিল। বৃষ্টিতে হাটবে; অথচ কাদা মাড়াবে না; তা তো হয় না।
বৃষ্টি, কাদা ও হাফিজ প্রকৃতিতে এক হলো। খালের পাশে দাড়াতেই নীরদ বাবুদের পুকুরে, গ্রামের কিশোরদের আনন্দ মুখোর স্নানের কলোরব অনুভব হলো। নিজের অজান্তেই হাফিজের চোখ দুটি চলে গেল; অতীতের সেই শামুক কুড়ানো মেয়েটির বাড়ির সামনের জমির দিকে। সেখানে কারা যেন নতুন ঘর তুলেছে। চোখ খোলা রেখেই হাফিজ তার মনের জানালা খুলে দিল। অনুভবের তীব্রতায় ফিরে গেলো সেই তার হারানো শৈশবে। বৃষ্টিরা সঙ্গীদের সাথে সে দাড়িয়ে আছে। সরলা দূর হতে তার সরল চোখে দৃষ্টি রেখেছে। হৃদয়ের স্পন্দন শরীরের লোম পর্যন্ত পৌছালো। বহুদিন পর হাফিজ এমনভাবে বিভোর হলো; যেন নতুন জীবনে অতীত পেল। আহা! এমন করে কিছুক্ষণ পর পর যদি অতীত পাওয়া যেত; তাহলে বোধহয় বর্তমানের না পাওয়ার আফসোস মানুষ করতো না।
জীবনে বড় কিছু হওয়ার তাড়ণায় সেই যে কবে হাফিজ গ্রাম ছাড়ল। সরলারও বিয়ে হলো ইট ভাটায় কাজ করা কোনো এক ছেলের সাথে। দু’দিন পর বাড়ির উঠোনে কে যেন গেয়োদের ভাষায় হাফিজের স্ত্রীর কাছে দুঃখ প্রকাশ করছে। হাফিজ বেড়িয়ে এলো, দেখল, মাঝ বয়সী কোনো এক মহিলা মাটিতে বসে বসে তার স্ত্রীর সাথে কথা বলছে। হাফিজের উপস্থিতি বুঝতে পেরেই মহিলাটি মুখে কাপড় দিল; বলল, ”ভাইজান, ভালো আছেন? আমি ঐ পারায় থাকি। আমার মেয়েকে কি আপনাদের বাসার কাজের জন্য নিবেন। তিন বেলা খাবার দিলেই হবে। শুধু ওর বিয়ের সময় কিছু সাহায্য দিবেন।”
হাফিজের সম্মতিতে মহিলার মেয়েটিকে তারা শহরে নিয়ে গেল। হাফিজ ব্যস্ততার কারণে মেয়েটিকে ভালো করে দেখতে পারে নি। কয়েকদিন যাওয়ার পর, হঠাৎ হাফিজের স্ত্রী মেয়েটি সম্পর্কে অভিযোগ তুল্ল যে, সে কাজ পারে না। দুর্বল।
এভাবেই চল্ল কিছুদিন। একদিন বাড়ি ফিরেই হাফিজ জানতে পারল তার স্ত্রী মেয়েটিকে রান্নায় লবণ বেশি দেয়ার জন্য আঘাত করেছে। হাফিজ কষ্ট পেল। মেয়েটির কাছে মাপ চাইতে গেল। মেয়েটির চেহারা দেখেই হাফিজের বুকে করুণ এক ব্যথার জন্ম হলো। অবিকল সেই চোখ, সেই মলিন চির সম্পর্কের আকৃতি। তার মানে সেই মহিলাটিই সরলা। এ সরলার মেয়ে।
হাফিজ কিছুক্ষণের জন্য স্থির হলো। বিশেষ অবাক অনুভবে সে বুঝল যে, সে তার শহুরে ভদ্রতা নিয়ে পালিয়ে গেলেও সরলা পালায় নি। সরলারা পালাতে পারে না। তারা সহজ-সরলে বন্দী থাকে সারাটা জীবন। যদিও তারা জানে, পালিয়ে গেলে কেউ, স্থান পূরণ হবে। ভিন্ন পূরণ আসবে। ধৈর্যশীলরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে, পরের পূরণেই মুক্তি পায়।
সরলার সাথে হাফিজের যে বেনামের সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল; তা থেকে হাফিজ পালিয়ে গিয়েছিল ঠিকই কিন্তু বড় হওয়ার প্রবণতা এবং সফলতা তাকে আজও মুক্তি দিতে পারে নি। শহরের জটিল স্বার্থপরতার শিক্ষায় হাফিজ সরলাকে ছেড়েছিল। যদিও সরলা সে বিষয়ে কোনো দুঃখ রাখে নি তবুও কেন জানি হাফিজের কষ্ট হল। সে বুঝল, প্রকৃতির ভারসাম্যে বিভাজন এলে, প্রকৃতিই একদিন প্রতিশোধ প্রবণ হয়। মানুষকে ফিরিয়ে আনে গোড়ায়। ধীরে বুঝা গেলেও ক্ষমার প্রতিশোধ টেকশই হয়। হাফিজ এখন সরলার ক্ষমার প্রতিশোধ অনুভব করতে পারে।
সরলার মেয়ে আজ তার বাড়িতে। সরলা সেদিন তার বাড়িতে এসেছিল, বসেছিল মাটিতে। অথচ সে যদি অতীতে চাইতো, তবে সে সরলাকে জীবন সঙ্গী বানাতে পারত; উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করতে পারত।
দু’ফোটা বৃষ্টি ঝরে গেল যেন জীবনের পাটাতনে। বড় বড় সমাজে, বন্ধু কিংবা শত্রু হওয়ার জন্যও যোগ্যতা লাগে। উন্নত নামের এই নীচু সমাজে, ভালো- মন্দের চেয়ে নিজের স্বার্থকে প্রাধান্য দিলেই হয়৷ এজন্যই বোধহয় নীচুরা বরাবরই ছোটলোক থাকে।
সরলারা গ্রাম ছেড়ে যেদিন হাফিজদের বুকের পাজরে এসে নিশ্চিন্তে ঘুমাবে, সেদিন থেকে তারা উভয়ই মুক্ত হবে। সম্পদ দিয়ে হাফিজ অনেক কিছু পেলেও সরলাকে পাইনি। সরলাও হয়ত তার জন্মের স্থান নিয়ে স্রষ্টার কাছে প্রশ্ন রাখবে।
খারাপাত্মা নয়; ভদ্রতা ছিঁড়ে তাতে অদম্য সাহস প্রবেশ করানোর পরই জনতার স্রোতে বিপ্লব এসেছে।
অনেক পরে হলেও হাফিজ সরলার মেয়েটিকে প্রশ্ন করল, ”মা, তোমার নাম কী?”
কাঁদতে কাঁদতে মেয়েটি বল্ল, “অপয়া, ছোটলোকের বাচ্চা, কালো, বেটে, মুর্খ, অভদ্র”।
------ অন্ধকারের গল্প
------ আব্দুল্লাহ আল- মাহমুদ।