নিকষ আঁধারে ডুবে থাকা আকাশের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না। হৃদয় অন্ধ হয়ে আসে। তবু আমি আজ কুয়াশা ঢাকা কালো আকাশের দিকে চোখ মেলে আছি। আমার খারাপ লাগছে না। তাছাড়া খুব নেশাগ্রস্থও হয়ে পড়েছি ইদানিং। অন্ধকার দেখার নেশা। আজকাল খুব মনে পড়ে আমার প্রিয়তমা অতীতকে। অতীতের দুঃখগুলো সুখের মতো মনে হয়। অতীতের কোন কোন কান্না আমার নীল হৃদয়জুড়ে হাসি ফোঁটায়। কেউ কী এমনভাবে কাঁদে? আমি কেঁদেছিলাম। তাও দীনার সামনে! দীনাকে আমিই ডেকে নিয়ে গিয়েছিলাম কলেজ ক্যান্টিনের পাশে।
-কী হয়েছে? এভাবে সবার সামনে থেকে ডেকে আনলি কেন?
আমি নির্বাক। হাত-পা কাঁপছে। নিয়ন্ত্রন করতে যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছি কিন্তু দেহ-কম্পন ক্রমশ বেড়েই যাচ্ছে। সেই সাথে শুরু হয়েছে পৃথিবী ঘূর্ণন। চারপাশের পৃথিবীটাকে মনে হচ্ছে ছাঁদে ঝোলান ফ্যান।
-কী হল? কথা বলছিস না কেন?
দীনার শব্দশক্তিকে কাজে লাগিয়ে মুখ খুললাম আমি। মুখ খুলতেই টের পেলাম বুক-সাগর হতে জলোচ্ছ্বাস আসন্ন। সেই দুর্যোগপূর্ণ হৃদয়ে শুধু বলেছিলাম-
-দীনা, আমি তোকে আর শুধুই বন্ধু হিসেবে ভাবতে পারছি না। আমি তোকে ভালোবেসে ফেলেছি। আমি দুঃখিত।
-দুঃখিত মানে? কাউকে ভালোবেসে আবার তাকে ডেকে দুঃখিত বলার মানে কী? আর তুই এভাবে কাঁদছিস কেন? নে টিস্যু নে। চোখ মোছ।
দীনা হেসে ফেলল। আমার লজ্জা পাবার অবসর ছিল না।
-আমি তোর উত্তর জানতে চাই।
-এখানে আরেকটি ক্রন্দনপর্ব অনুষ্ঠিত হোক আমি তা চাই না। আমার যা বলার আমি তোকে লিখে জানাব।
বলেই দীনা হনহন করে হেঁটে চলে গেল। আমার মুহূর্ত পুড়তে লাগল স্বপ্নহীন শূন্যতায়।
পরেরদিন ক্লাস শুরুর আগে ও একটা খাতা এগিয়ে দিল আমাকে।
-এখানে আমার উত্তর লিখা আছে। বাসায় গিয়ে পড়বি।
ক্লাস শুরুর আগেই সেদিন ছুটির ঘণ্টা বাজল আমার। খাতার মাঝে খুঁজে পেলাম একখানা তিন পৃষ্ঠার চিঠি। ঠিক চিঠি ছিল না ওটা, ছিল স্বর্গের সনদপত্র! সেই স্বর্গের বাসিন্দা হলাম আমরা দুজন। সে স্বর্গ নতুন করে সাজতে লাগল। বাড়তে লাগল আমাদের স্বপ্নের পরিধি, ভালোবাসার অসীমতা। আমরাও বড় হলাম। আমাদের সময় কাটতো উদাস উদাস বিকেল দেখে, রুপালি রোদ গায়ে মেখে। আমরা ঘুরে বেড়াতাম শহরের এমাথা-ওমাথা হয়ে। ফেরার পথে ওর আধোঘুম মুখ আশ্রয় নিতো আমার কাঁধে। কাঁচভাঙ্গা বাসে রচিত হত আমাদের বিশুদ্ধ বাসর।
পারিবারিকভাবে আমাদের বিয়ে পাকাপাকি হলো। সেদিন সারাটা বিকাল জুড়ে ঘুরে বেড়ালাম শহুরে নদীর তীর ধরে। কোমল হাতের শক্ত বন্ধনে বসে বসে দেখলাম আকাশের নিঃসঙ্গতা, ঘরহারা জলের স্রোত আর একটা কচুরিপানার বিরহী পথচলা। সেই মৌন বিকেলে গভীর প্রেমের অব্যক্ত কথামালায় জর্জরিত হলাম দুজন। প্রতিদিনের মতো সেদিনও হাতে-হাত রেখে দুজনে বসে ছিলাম ফেরার বাসে। কিন্তু দীনার আদুরে চুলগুলো আশ্রিত হলোনা আমার মরুবুকে। সে উদাস নয়নে চেয়ে ছিল বাইরের শূন্যতার মাঝে।
-তোমার কি মন খারাপ?
-কেন?
-কী দেখো বাইরে?
-কিছু না।
-তাহলে?
-স্বপ্ন বুনি।
-তাই বুঝি? কাকে নিয়ে এত স্বপ্ন তোমার?
-আমার স্বপ্নের পুরুষকে নিয়ে। জানো, আমার মনে হয় আমাদের জীবন হবে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষের জীবন। কোন দুঃখকষ্ট আমাদের ছোঁবেনা। অনন্ত সুখে তলিয়ে যাবে আমাদের অনাগত ভবিষ্যৎ। কিন্তু ভয় হয়...
-কীসের ভয় !
-এই নষ্ট শহরের দূষিত পরিবেশ এতো সুখের অস্তিত্ব সইতে পারবে তো !
আমি হাসি। দীনা মাথা রাখে ওর স্বপ্নের বুকে। আমাদের মুহূর্ত এগিয়ে যায় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সময় ধরে...
খুব ইচ্ছে করছে অতীতকে এখানে স্থির করে দিতে, দীনা সারা জীবন বাস করুক তার স্বপ্নের বুক জুড়ে। কিন্তু অতীত যে কখনো থেমে থাকে না। প্রতিনিয়ত তাড়িয়ে বেড়ায় বর্তমানকে। সেদিন রাতে আমার সেই স্বপ্নময় বাস্তবতার মাঝে কিছু ভয়াল পশু ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। পরেরদিন ছিল কোন এক রাজনৈতিক দলের ডাকা হরতাল। কিছু বুঝে উঠার আগেই আগুনের লেলিহান শিখা গ্রাস করল আমাদের। পুড়লাম দুজন, পুড়ল আমাদের স্বপ্ন। আমি নিঃসাড় দেহে দেখেছিলাম আমার প্রাণ-প্রতিমার ভেঙ্গে পড়া। তিনদিন পর তুমি আমাকে ফেলে চলে গেলে সত্যিকার স্বর্গে। আমি হয়ত বেঁচে রইলাম বাকিটা জীবন পোড়ার জন্য। যাবার আগে কী নরক যন্ত্রণা তুমি সহ্য করে গিয়েছ জানতে পারিনি। জানতে পারিনি মানুষ কি করে পুড়িয়ে মারতে পারে আরেকটা মানুষ। আরেকটা স্বপ্ন।
ক্ষমা করো আমাকে। ক্ষমা করো আমাদের।
আমি দাড়িয়ে আছি নিস্তব্ধ আঁধারের মাঝে। কুয়াশায় ভেসে যাচ্ছে আমার নোনা বেদনার স্রোত। বুড়ি চাঁদটাও যাচ্ছে আজ বেনো জলে ভেসে..
(পুর্বে একটি ফেইসবুক পেইজেও প্রকাশিত)