অনিশ্চয়তা তত্ত্ব কেনো গ্রহনযোগ্য হতে পারে না সে বিতর্কের দার্শণিক প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছিলো নিউটনের গতিসূত্র এবং মহাকর্ষ সূত্রের ব্যপক সাফল্যের পর সে সময়ের শিক্ষিত মানসে এর প্রভাবের কারণে। নিউটনের গতিসূত্রগুলো যেকোনো বস্তুর গতির পরিবর্তনকে ব্যাখ্যা করে, নিতান্ত আটপৌরে শব্দ "বল"কে সম্পূর্ণ আলাদা একটা অর্থে উপস্থাপন করে, বস্তুর গতির পরিবর্তণের জন্য আলাদা একটা কারণ প্রয়োজন এটা উপলব্ধি করেছিলেন গ্যালিলিও'ও তবে তার সময়ে দ্বিঘাত-ত্রিঘাত সমীকরণের সমাধান হলেও গাণিতিক সমস্যার সমাধান এতটা উৎকর্ষ লাভ করে নি, এমন কি গাণিতিক পরিভাষায় বিজ্ঞান বিশেষত পদার্থ বিজ্ঞান কিংবা গতির সূত্র উপস্থাপনের প্রচলন হয় নি, সে কারণেই একেবারে সংক্ষিপ্ত আকারে গাণিতিক সংকেতে গ্যালিলিও তার পর্যবেক্ষণ উপস্থাপন করেন নি বরং দীর্ঘ বাক্যে তার যুক্তি তুলে ধরবার চেষ্টা করেছেন।
নিউটন এবং লিবনিজ প্রায় একই সময়ে ডিফারেন্সিয়াল ক্যালকুলাসকে বিজ্ঞানের সমস্যা সমাঢানের উপায় হিসেবে নির্মাণ করেন, ইন্ট্রেগ্রাল ক্যালকুল্যাসের ধারণা তারও অনেক আগে থেকে প্রচলিত থাকলেও ক্যালক্যুলাসের জন্ম হওয়ার পর ইন্ট্রেগ্রাল ক্যালক্যুলাসের ধারণা ও ব্যবহারও অনেক বেশী বিস্তার লাভ করলো।
গ্যালিলিও যখন বেছিলেন অন্য কোনো কিছুর প্রভাবে বস্তুর গতি পরিবর্তিত হয় তখন তিনি আলাদা করে " বল" শব্দটি ব্যবহার করেন নি,নিউটন তার জন্মের ঠিক ১০০ বছর পর জন্মে বস্তুর গতির পরিবর্তনের কারণগুলোকে সংক্ষেপে গাণিতিক আকারে উপস্থাপন করলেন। অবশ্য নিউটনের সূত্রগুলোকে এখন আমরা যেভাবে দেখছি সেটার পেছনে আরও অনেক বিজ্ঞানীর অবদান আছে।
নিউটন বললেন বস্তুর গতির পরিবর্তনের জন্য বল প্রয়োজন, সে বলের দিকেই বস্তুর গতি পরিবর্তিত হবে, যদি কোনো একটি বস্তুর গতি অপরিবর্তিত থাকে তাহলে বুঝতে হবে এই বস্তুর উপরে ক্রিয়াশীল বলগুলো পরস্পরকে নাকচ করছে।
যদিও নিউটনের সময়ে ভিন্ন ভিন্ন বলের ধারণা তৈরি হয় নি, তবে প্রত্যেকটি ক্রিয়ার সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া বিদ্যমান এই ধারণাটুকু উপস্থাপনের জন্য িউটন স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। যদিও নিউটনের তৃতীয় সূত্র ব্যবহারিক জীবনে নিয়মিতই ব্যবহার হচ্ছে কিন্তু এটা এমন কি পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্ররাও অনেক সময় ভুলভাবে বুঝে।
নিউটনের গতিসুত্র পৃথিবীতে যেমন বস্তুর গতির পরিবর্তনকে ব্যাখ্যা করলো ঠিক টেমন ভাবে মহাকর্ষ সূত্রও গ্রহ-নক্ষত্রের গতিকে ব্যাখ্যা করতে সক্ষম হলো। নিউটনের সুত্র গাণিতিক সমীকরণ- এবং গাণিতিক সমীকরণ বলেই যেকোনো বস্তুর গতির প্রাথমিক তথ্যগুলো জানা থাকলে এবং এর উপরে প্রযুক্ত বলের দিক ও পরিমাণ জানা থাকলে পরবর্তী যেকোনো মুহূর্তে বস্তুর অবস্থান নিশ্চিত বলা যায়। এই নিশ্চিত ভবিষ্যতবানী করার ক্ষমতাটুকু বিজ্ঞানীদের এক ধরণের স্বস্তি দিয়েছিলো।
নিউটনের সূত্র মেনে চলা জগতে সকল পরিবর্তনের নেপথ্যে কোনো না কোনো উদ্দীপনা বিদ্যমান এবং সেসব উদ্দীপনাকে চিহ্নিত করা সম্ভব হলে পরিস্থিতির পরিণতি সম্পর্কে নিশ্চিত ভবিষ্যতবানী করা সম্ভব ভাবনাটা শুধু পদার্থবিজ্ঞানে উৎসাহী বিজ্ঞানীদেরই প্রভাবিত করেছিলো এমন না , বরং সিগমুন্ড ফ্রয়েড মনোবিজ্ঞানে এবং কার্ল ম্যার্ক্স ও ফ্রেডরিক এঙ্গেলস তাদের সমাজ বিশ্লেষণেও নিউটনের সূত্রগুলোকে সামাজিক পরিবর্তনের কার্যকরণ নির্ধারণ ব্যবহার করেছেন।
সে সময়েই গ্যাসের গতিতত্ত্ব এক ধরণের অনুমাণ হিসেবে বিকশিত হচ্ছিলো। যেকোনো গ্যাসের আয়তন চাপে পরিবর্তিত হয়, যদি চাপ পরিবর্তিত না হয় তবে তাপমাত্রা বাড়ালেও গ্যাসের আয়তন পরিবর্তিত হয়, বয়েল এবং চার্লসের পর্যবেক্ষণের ব্যাখ্যা করতে পরমাণুর ধারণা বিকশিত হওয়ার সময় কিছু পূর্বাণুমাণ ধরে নেওয়া হয়েছিলো- গ্যাস অতিক্ষুদ্র কণিকা দিয়ে তৈরি, এইসব কণিকাগুলোর ভর নগন্য এবং এরা পরস্পরের সাথে এবং যে পাত্রা রাখা হয়েছে সে পাত্রের দেয়ালের সাথে সারাক্ষণ ধাক্কা খায় এবং এদের গতির দিক পরিবর্তিত হয়।
গ্যাসে অনু-পরমাণুর সংখ্যা এত বেশী যে একটি নির্দিষ্ট পরমাণুর গতিপথ আলাদা করে নির্ধারণ করা কঠিন- প্রায় অসম্ভব, তবে এরাও নিউটনের সুত্র মেনে চলে, প্রতিবার ধাক্কা লাগার আগ পর্যন্ত এরা সরল রেখায় চলাচল করে। কিন্তু প্রতিটি পরমাণুকে আলাদা করে চিহ্নিত করে এডের সামগ্রীক গতির অবস্থা ব্যাখ্যা করা সম্ভব না, তবে সম্মিলিত ভাবে এদের প্রভাবটা পরিমাপযোগ্য। নিশ্চিত, নিখুঁত ভবিষ্যতবানীর জগত থেকে পদার্থ বিজ্ঞান এ সময়েই বিচ্যুত হয়ে যায়, জেমস ক্ল্যার্ক ম্যাক্সওয়েল পরবর্তীতে বললেন একটি গ্যাসের সকল পরমাণুই একই গতিবেগে চলাচল করে না, বরং এদের গতি পরিসাংখ্যনিক, একটি নির্দিষ্ট সীমার ভেতরেই ঠাকবে, ফলে কোনো কোনো পরমাণুর গতিবেগ প্রায় শূণ্য হতে পারে, এবং কোনো কোনো পরমাণুর গতিবেগ অসীম হতে পারে, কিন্তু মোটামুটি সকল পরমাণুর গতি একটি নির্দিষ্ট সীমার ভেতরে থাকবে- তাপমাত্রা বাড়লে এই গড়গতিবেগ বৃদ্ধি পাবে।
পরিমাপ অযোগ্যতা কিংবা প্রতিটি কণার ভবিষ্যত নিশ্চিত বলতে না পারার অক্ষমতা এক ধরণের দুর্বলতা চিহ্নিত হয়েছিলো, যদিও পরবর্তীতে নিজগুণেই স্ট্যাটিসটিক্যাল মেকানিক্স পদার্থ বিজ্ঞানে জায়গা করে নিয়েছে কিন্তু যেসব বিজ্ঞানী বিশ্বাস করতেন বিজ্ঞানের মূল লক্ষ্য প্রকৃতিকে ব্যাখ্যা করা এবং পরিমাপযোগ্য গাণিতিক আকারে প্রতিটি বস্তুর পরিবর্তনকে চিহ্নিত করটে পারাটাই পদার্থ বিজ্ঞানের সাফল্য- যারা বিশ্বাস করতেন পরীক্ষাগারেই বিজ্ঞানের তত্ত্ব নিশ্চিত প্রমাণিত হবে এবং প্রতিটি ক্ষেত্রেই পরিমাপ একটি নির্দিষ্ট মাণই প্রদান করবে তারা এমন পরিসংখ্যানিক কণার অস্তিত্বেব বিশ্বাস করেন নি, যদিও বিদ্যমান সমস্যা সমাধানে ও ব্যাখ্যায় সফল বলে অগ্যতা মেনে নিয়েছিলেন, তাদের অনুযোগ অব্যহত ছিলো। এমনই বিরোধ পরবর্তীতে বোল্টজম্যানকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করে।