দেশের বর্তমান খারাপ অবস্থা কারোরই অজানা নয়, এটাই আমার ধারণা । তবে এমন অনেকেই আছেন যারা ভাবেন, দেশ রসাতলে গেলেই বা আমার কি, আমার নিজের আখেরটা গোছানো গেলেই হয় । হ্যাঁ, তাদের জন্যই হয়তো আমাদের নেতৃত্বপ্রদানকারী লোকগুলো যা ইচ্ছা তাই করার সাহস পাচ্ছে । তবে বর্তমানে আমাদের দেশে দুইটি অতি আলোচিত শব্দ দুইটি হলো, মুক্তচিন্তা ও মুক্তবুদ্ধি । তাহলে কি এই মুক্তচিন্তা ও মুক্তবুদ্ধি ? আসুন, একটু আলোচনা করা যাক ।
মুক্তচিন্তা হচ্ছে মুক্তভাবে চিন্তা করা । অর্থাৎ আপনি যখন কোন কিছু নিয়ে ভাবছেন তখন আপনি সবকিছুর প্রভাব থেকে মুক্ত হয়েই চিন্তা করছেন । কে কি ভাবছে, কে কি করছে, কে কি নিয়ে বেশি আগ্রহী, কে দেশের জন্য করছে আবার কেইবা দেশকে বিক্রি করে দেওয়ার জন্য করছে ইত্যাদি । এখন স্বভাবতই একটি প্রশ্ন আসে, চিন্তা তো হয় মনের মধ্যে । তাহলে আমি কি নিয়ে চিন্তা করছি, সেটি কারও প্রভাবযুক্ত কি করে হবে ? হ্যাঁ, অত্যন্ত যুক্তিপূর্ণ প্রশ্ন । আপনার সেই চিন্তার ব্যাপারটি কারও জানার কথা নয় । তবে আপনি যখন সেই চিন্তাধারাকেই কলম বা অন্য কিছু যেমন সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইট অর্থাৎ ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব ইত্যাদির মাধ্যমে আপনার সেই চিন্তাধারাকে প্রকাশ করবেন তখনই কিন্তু বাগড়া বাধবে । কারণ তখন সেটা শুধু আপনার মনের অন্তরালে সীমাবদ্ধ থাকবে না । সাধারণত ইদানিং মুক্তচিন্তার চর্চা ধর্মীয় বিষয়গুলো নিয়েই বেশি হতে দেখা যাচ্ছে । কোন ধর্ম কি রকম, কোনটা সঠিক বা কোনটা সঠিক নয়, কোন ধর্মের উৎপত্তি আগে আর কোন ধর্মের উৎপত্তি সবার পরে, কোন ধর্মে কি ধরণের সীমাবদ্ধতা আছে ইত্যাদি ইত্যাদি । আর এখানেই যত সমস্যা । এবার আসি মুক্তবুদ্ধি নিয়ে ।
মুক্তবুদ্ধি হচ্ছে সেটাই যা সেইসব মুক্তচিন্তার মাধ্যমে আমাদের নিজেদের মধ্যে যেই ধরণের বিশ্বাসগুলোর জন্ম হয় বা আমরা যার দ্বারা সামাজিকতাকে প্রভাবিত করার চেষ্ঠা করি । এই মুক্তবুদ্ধি আর মুক্তচিন্তার মধ্যে যে সম্পর্ক তা অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী । মুক্তচিন্তার চর্চা হয় না কিন্তু মুক্তবুদ্ধির হয় । যেমনঃ আমি আমার কথার মাধ্যমে আপনাকে বা আপনাদেরকে প্রভাবিত করতে পারি এভাবে যে হ্যাঁ এই ব্যাপারটা যেভাবে ঘটেছে তা আসলে সেভাবে না ঘটে অন্যভাবে ঘটেছে । আপনারা এটা বুঝতে পারেননি কারণ আপনারা যা দেখেছেন তাই বিশ্বাস করেছেন কিন্তু একটু গভীরে গিয়ে বুঝার চেষ্ঠাও করেননি । অর্থাৎ আমি আমার মুক্তচিন্তাটাকেই মুক্তবুদ্ধির মাধ্যমে আমার আশেপাশে বা সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে পারি সহজেই । তাহলে মানুষ কিসের দ্বারা বেশি প্রভাবিত হয়, মুক্তচিন্তা নাকি মুক্তবুদ্ধি ? এই প্রশ্নটা অনেকটাই অমূলক । এই প্রশ্নটা এখানে দিলাম যদি এখনও অনেক এই মুক্তচিন্তা আর মুক্তবুদ্ধির ব্যাপারটা ভালো করে ঠাউর করতে না পারেন । কারণ মুক্তচিন্তাকে ছড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমটির নামই তো মুক্তবুদ্ধি ।
এই যে ব্লগার রাজীব থেকে শুরু করে প্রকাশক দীপন হত্যা হলো, এটা আসলে কেন হয়েছে ? এর সাথে আসলে কারা জড়িত ? বাংলাদেশে কি আদৌ মুক্তচিন্তা বা মুক্তবুদ্ধি চর্চার কোন সুযোগ রয়েছে ? এই হত্যার পিছনে কি কোন ধর্মীয় ব্যাপার জড়িত ? নাকি কোন জঙ্গীগোষ্ঠী জড়িত ? নাকি বাংলাদেশে ইচ্ছামত কথা বলাই নিষেধ ? এমন হাজারটা প্রশ্ন আমার-আপনার মনে । কিন্তু এই প্রশ্নগুলো করার আর এর উত্তরগুলো পাবার কোন সুযোগ ও সম্ভাবনা না পেয়ে আমরা সকলেই নীরবতা পালন করছি । আর এই নীরবতার সুযোগ নিয়েই এক একটা করে মুক্তচিন্তার চর্চাকারী মৃত্যুবরণ করছে । তাইলে দেখি, উপরের প্রশ্নগুলোর সামান্য সন্তুষ্টজনক উত্তর দেয়া যায় কিনা । প্রথম কথা হলো, মুক্তচিন্তার ধারকরা নিজেদের ধর্মীয়ক্ষেত্রে বেশিরভাগই নাস্তিকতাবাদকে সমর্থন করছে । অর্থাৎ তারা সকলেই নাস্তিক বা নাস্তিকতাকে সমর্থন করে । কিন্তু তাদের লেখনীতে বা লেখার ভাষায় যে তীব্র নিন্দা বা ধিক্কার বা প্রতিবাদ সবই যেন শুধুমাত্র ইসলাম ধর্মের ও এই ধর্মের অনুসারীদের জন্য । যা সাধারণ যে কারও খটকা বাঁধতে বাধ্য । আমার এক বন্ধু এমনই নাস্তিকতাবাদকে সমর্থন করে । একদিন আমি আমাদের এক আড্ডায় কথায় কথায় তাকে নাস্তিক বলে উপহাস করতে লাগলাম । তখন সে সিরিয়াস হয়ে বললো, তুই যেমন একটি ধর্মের অনুসারী ঠিক তেমনি আমিও নাস্তিকতাবাদের অনুসারী । তোর বিশ্বাস নিয়ে উল্টাপাল্টা বললে যেমন তোর খারাপ লাগে, ঠিক তেমনি আমার বিশ্বাস নিয়ে কেউ উপহাস করলে আমারও খারাপ লাগে । আমি তখনই চুপ হয়ে যাই । আসলেই তো । এটা নিয়ে ভেবে দেখিনি কোনদিন । নাস্তিকতাবাদ নিয়ে আমাদের ধারণা অনেকটাই সেকেলে । আমরা তাদেরকে মানসিক বিকৃতকারী হিসেবে দেখি । এর জন্য দায়ী সেই নাস্তিকতাবাদ বিশ্বাসী মানুষগুলোই । কারণ তারা তো পর্দার অন্তরাল থেকে বেরিয়ে এসে কখনও আমাদের শুধরে দেয়নি । বরং তারা বেছে নিয়েছে খারাপ পথ । অত্যন্ত নিন্দনীয় একটি পথ । আর সেটি হলো, অন্য ধর্ম নিয়েও উপহাস করা, বাজে কথা বলা । আর সেটি বেশি পরিলক্ষিত হয়েছে ইসলাম ধর্ম নিয়েই । এখন ইসলাম ধর্মের অনুসারীরা যখন আগ বাড়িয়ে এসে বিভিন্নভাবে তাদের নিষেধ করছে তবুও তারা থামছে না । তখনই ইসলাম ধর্মের অনুসারীরা অনেকেই নিজের উপর কন্ট্রোল হারিয়ে বিভিন্ন অপকর্ম করে বসছে । যেটি আদতে কাম্য নয় ।
ভালো করে খেয়াল করলে দেখা যাবে, সেইসব নাস্তিকতাবাদে বিশ্বাসী লোকগুলোই এই মুক্তচিন্তা ও মুক্তবুদ্ধিকে একটি রোগ হিসেবে পরিণত করছে । তবে সবকিছুর মূলে কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো । ভালো করে খেয়াল করলে দেখা যাবে, ধর্মীয় ব্যাপার ছাড়া সরকারের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডগুলো নিয়ে কিন্তু কোন কথা ছড়াচ্ছে না । এর কারণ কি জানেন ? বর্তমান সংবিধানের ৫৭ নাম্বার ধারা । আপনার মুখ, চোখ, কান, গলা, হাত, পা ইত্যাদি সবই এক অর্থে কারাগারে বন্দী করে রাখা হয়েছে । আপনি দেখতে পাবেন কিন্তু বলতে পারবেন না, শুনতে পারবেন কিন্তু বলতে পারবেন না, তাদের অপকর্মগুলো হাতেনাতে ধরতে পারবেন কিন্তু বলতে পারবেন না । এটাই ৫৭ নাম্বার ধারা । যার কারণে দেশের মানুষদের নাকের ডগা দিয়েই সরকারী দল যত অপকর্ম করে যাচ্ছে । এই ধরেন, নিজের দেশের মানুষদের চাইতে ভারত প্রীতি, বিভিন্ন মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ, ছাত্রলীগের মাত্রাতিরিক্ত আগ্রাসন ও সন্ত্রাস, বিরোধী দোল নিয়ে অতিরিক্ত কপচানো ইত্যাদি বিভিন্ন অপকর্মের অসংখ্য সাক্ষী থাকলেও সেগুলো জনসম্মুখে আনার মত সাহস কারোরই নেই । কারণ বিড়ালের গলার ঘণ্টাটা বাধবে কে ?
আপনার মুক্তচিন্তা করাটাই যেখানে অপরাধ সেখানে আপনি স্বাধীনতা চাচ্ছেন, ব্যাপারটা আসলেই অনেক হাস্যকর । ভেবে দেখুন তো, সরকারদলীয় রাজনৈতিক দলের এখন প্রধান উক্তিটি কি ? হ্যাঁ, দেশ এখন জঙ্গীতে ভরে গেছে । তাহলে আসুন তো একটু পিছনে ফিরে যাই । মনে আছে, ২০১৫ সালের ১৪ই এপ্রিল ঢাকা ইউনিভার্সিটির টিএসসি চত্বরে সংঘটিত সেই লোমহর্ষক কাহিনীর কথা ? আপনি জানেন কি, পুলিশ যখন পরবর্তীতে আসামী খুঁজতে খুঁজতে হয়রান, তখন সেই ঘটনার দায়িত্ব কারা নেয় ? না জানলে জেনে নিন । সেই ঘটনার দায়িত্ব নেয় আনসারুল্লাহ বাংলা টিম । জি, হ্যাঁ, সেই জংগীসংঘটনের কথা বলে সরকার বারবার পাড় পেয়ে যায় । পরবর্তীতে কিন্তু প্রমাণ হয়, সেই ঘটনা আসলে ঘটিয়েছে ছাত্রলীগেরই কয়েকজন সদস্য । তাহলে এবার বুঝলেন তো, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম আসলে কারা ? এবার আসি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ।
সম্প্রতি একজন শ্বেতাঙ্গ ব্যাক্তি আমেরিকায় কয়েকজনকে গুলি করে হত্যা করে । সেই ব্যক্তি হত্যা করার আগে নিজস্ব ফেসবুক একাউন্টে নিজেকে একজন "ফেডারেল রিপাবলিকান" বলে দাবী করে । অর্থাৎ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার বিরোধীদলীয় সমর্থক সে । কিন্তু পরবর্তীতে সেই ব্যক্তি যখন ধরা পড়ে, তখন প্রেসিডেন্ট স্বয়ং মিডিয়াতে ঐ ব্যক্তিকে একজন সন্ত্রাসী বলে উল্লেখ করে, বিরোধী দলিয় সমর্থক বলে নয় । অথচ আমাদের দেশের অবস্থা খেয়াল করে দেখুন, এখানে সরকার বিরোধী দলকে আর বিরোধী দল সরকারী দলকে বিভিন্নভাবে বিভিন্ন কাজের জন্য দোষ দিতেই বেশি ব্যস্ত, দেশের উন্নয়ন চুলায় যাক । এর কারণ কি জানেন ? কারণ এখন বাংলাদেশের সরকার নির্ধারিত হয় শক্ত প্রয়োগে, ভোট প্রয়োগে নয় । তাই জনগণ কি খাইলো, কি পড়লো, কোথায় থাকলো, মরলো নাকি বাচলো এতে সরকারে কিছুই যায় আসে না । তাই আমরা যতই মুখে বুলি কপচাই আমাদের দেশ উন্নয়ন করছে, এগুলো আসলে ফাঁকা বুলি ছাড়া কিছুই না । দেশের মিডিয়াই যখন সরকারের আগ্রাসনের হাতে বন্দী তখন সঠিক খবর কিভাবে জনগণের কাছে পৌঁছাবে, আল্লাহ্ই জানে । ৫ই ও ৬ই মে, ২০১৩ তে যদি সত্যি সত্যি কোন হেফাজতী হত্যা না হয়ে থাকে তাহলে দিগন্ত ও ইসলামিক এই দুইটি টিভি চ্যানেল খুলে দেওয়ার জোর দাবী জানাচ্ছি । (তাই বলে ভেবে নেবেন না আমি জামায়াতে ইসলামের সমর্থক । বরং আমি সব ধরণের মিডিয়ার মুখ বন্ধ করার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি)
হ্যাঁ, মুক্তচিন্তা ও মুক্তবুদ্ধির অবশ্যই দরকার আছে । দেশে যেখানে দিন দিন শিক্ষার হার ও স্বশিক্ষিতের হার বাড়ছে, সেখানে একমাত্র এই মুক্তচিন্তা ও মুক্তবুদ্ধিই পারে, ভালো ভালো চিন্তাধারার মাধ্যমে দেশের সত্যিকার উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করতে । কিন্তু এর জন্য চাই পরস্পর সহযোগিতামূলক সৌহার্দতা । চাই না কোন হত্যা, কারও মুখ বন্ধ করা কিংবা ভয় দেখানো । কারও ধর্ম নিয়ে কথা বলা বন্ধ করুন বরং দেশ নিয়ে কথা বলুন । সরকারকে বাধ্য করুন এই ৫৭ ধারা বাতিল করার জন্য, মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করার পরিকল্পনাকে বাতিল করার জন্য, সর্বোপরি দেশে বাকশাল প্রতিষ্ঠা করার পরিকল্পনাকে বাতিল করার জন্য । দেশের উন্নতির জন্যই এগুলো বাতিল হওয়া প্রয়োজন । দেশে যদি কথা বলার স্বাধীনতাই না থাকে তাহলে দেশ নিয়ে ভাববোই বা কেন আমরা ? তাই এই মুক্তচিন্তা ও মুক্তবুদ্ধিকে আবশ্যকতা করা প্রয়োজন, এরকম রোগ হতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে আপনার ঘরে ঢুকেই আপনার মুখ বন্ধ করা হবে । তখন আপনি না পারবেন কিছু বলতে, কাউকে ডাকতে আর না পারবেন সহ্য করতে ।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই নভেম্বর, ২০১৫ রাত ১:৩০