হিনা রাব্বানি এসেছিলেন। হিনা রাব্বানি, মানে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন, চলেও গেছেন।সকাল দশটায় এসেছেন, চলে গেছেন বিকেল চারটায়। আসা আর যাওয়ার মাঝখানে এই ছয় ঘন্টায় তিনি করেছেন অনেক কিছুই - ডি-৮ সম্মেলনের দাওয়াত পত্র দিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে, সাক্ষাৎ করেছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে,দেখা করেছেন বিরোধীদলীয় ন
েত্রীর সাথেও।তার সাথে সাথে করে গেছেন একটি বড় সড় তামাশা, বাংলাদেশের মানুষকে অতীত ভুলে সামনের দিকে তাকাতে বলে গেছেন হিনা রাব্বানি। অতীত মানে - ঊনিশশো একাত্তর।
হিনা রাব্বানি রবীন্দ্রনাথ পড়েননি, পড়ার কথাও নয়। তার দেশ পাকিস্তান, এই দেশটি কোনদিন সৃষ্টি ও সুষমার জন্য আদর্শ নয়, শিল্প আর সৌন্দর্যের বুক ফাঁড়া লাশ পড়ে থাকে পাকিস্তানের অলিতে গলিতে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় - পাকিস্তান সেই দেশ,যেখানে হিন্দুয়ানির অভিযোগে রবীন্দ্রনাথের গান নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। যাই হোক, বাংলা ভাষাকে গ্রাহ্য না করে তার দেশ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা বানাতে চেয়েছিল। কাজেই সেই বাংলা ভাষার সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথের কবিতা হিনা রাব্বানির পড়ার সম্ভাবনা নেই তেমন।কিন্তু যদি ভুলক্রমেও একবার পড়তেন, তাহলে হয়তো এই তামাশাটা করার আগে একবার ভেবে নিতেন।রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন,
অদৃষ্টরে শুধালেম, চিরদিন পিছে
অমোঘ নিষ্ঠুর বলে কে মোরে ঠেলিছে?
সে কহিল, ফিরে দেখো। দেখিলাম থামি
সম্মুখে ঠেলিছে মোরে পশ্চাতের আমি।
হিনা রাব্বানি এক কথায় বলে দিয়েছেন অতীত ভুলে যেতে হবে। এখন একটু হিসেব নিকেশ করে দেখা যাক, আসলে ঠিক কী কী জিনিস ভুলতে হবে।
ভালুকার কিরণবালাকে ভুলে যেতে হবে তার নিজের অপমানের কথা, ভুলে যেতে হবে নিজের চোখে দেখা সেই মৃত্যুদৃশ্যের কথা !
"আমার পাশেই একটা মাইয়া ছিল।দেখতে যেমন সুন্দর,বয়সটাও ছিল ঠিক।আর তারেই সবাই পছন্দ করত বেশি।তাই তার কষ্টও হইত বেশি বেশি।একদিন দুই তিনজন একলগে আহে।এরপর সবাই তারে চায়।এই নিয়া লাগে তারা তারা।পরে সবাই এক সঙ্গে ঝাঁপায় পড়ে ঐ মাইয়াডার উপর।কে কি যে করবে,তারা নিজেরাই দিশা পায়না।পরে একজন একজন কইরা কষ্ট দেয়া শুরু করে।তখন সে আর সইতে না পাইরা একজনরে লাথি মাইরা ফেলাইয়া দেয়।তারপর তো তারে বাঁচায় কেডা।হেইডারে ইচ্ছামত কষ্ট দিয়ে মাইরা ঘর থাইকা বের হয়ে যায়।আমরা তো ভাবছি,যাক বাঁচা গেল।কিন্তু না,একটু পরে হে আবার আহে,আইসাই বুটজুতা দিয়ে ইচ্ছামতো লাইত্থাইছে।তারপরে গরম বইদা ( ডিম ) সিদ্ধ করে তার অঙ্গে ঢুকায় দেয়।তখন তার কান্না,চিল্লাচিল্লি দেখে কেডা।মনে হইছিল যে,তার কান্নায় দেয়াল পর্যন্ত ফাইটা যাইতেছে।তারপরেও তার একটু মায়া দয়া হলো না।এক এক করে তিনটা বইদা ঢুকাল ভিতরে।কতক্ষণ চিল্লাচিল্লি কইরা এক সময় বন্ধ হয়ে যায়।
... তার পরের দিন আবার হেইডা আহে।আর কত চুপ থাকবে।চিল্লাচিল্লি করলে বেশি শাস্তি দিব।সেই মেয়ের কাছে গিয়ে দেখে তার অবস্থা খুব খারাপ।তখন বন্দুকের মাথা দিয়ে তার ভেতরে গুতাগুতি করছে।আরেকজন তার পেটের উপর খাড়াইয়া বইছে।আর গড় গড়াইয়া রক্ত বাইর হইতেছে।যেন মনে হয়,গরু জবাই দিছে।সে শুধু পড়েই রইল।প্রথমে একটু নড়ছিল পরে আর নড়ল না।তারপরেও তার মরণ হইল না।ভগবান তারে দেখল না।এমন কত রকম নির্যাতন করে প্রতিদিন।এই অবস্থায় বাইচা ছিল সাত-আট দিন।পরের দুই দিন চেতনা ছিল না।এক সময় অবশেষে মরল।"
খুব দেখতে ইচ্ছা করে, অতীত ভুলে যাবার এই বচনামৃতখানি এরশাদ আলীর সামনে বলতে হলে কী করতেন হিনা রাব্বানি?
আমাদের ভুলে যেতে হবে কপিলমুনির সেই মুক্তিযোদ্ধাটির কথা যার হাতে পায়ে পেরেক বিধিঁয়ে সেঁটে রাখা হয়েছিল দেয়ালের সাথে। আমাদের ভুলে যেতে হবে সেই দেড়শো মহিলার কথা যাদের সেজদা দেবার ভঙ্গিতে বসতে বলে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে হয়েছিল। ভুলে যেতে হবে কিশোরগঞ্জের বরইতলার সেই তিনশো ছেষট্টি জনকে যাদের মাথার খুলি গুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল তিরিশ কেজি ওজনের শাবলের আঘাতে। ভুলে যেতে হবে সেই কিশোরটিকে যার পেট উড়্যে দেয়া হয়েছিল বোমা বেঁধে। এতই সহজ !
বাংলাদেশের প্রতিটি ইঞ্চি তখন এক একটি মাইলাই, প্রতি বর্গমিটারে একজন মানুষের লাশ, প্রতিটি ঘরে একজন ধর্ষিতা। মাঠ, নদী, রাস্তা মৃতের পাহাড় - শিশুর লাশ,নরের লাশ, নারীর লাশ। মৃতের মাংসে এতটা পুষ্ট হয়েছিল একাত্তরের শকুনেরা, আকাশে উড়তে তাদের কষ্ট হতো। এসব দিনের কথা ভুলে যেতে হবে বাংলাদেশকে?
এরশাদ আলী মোড়লকে ভুলে যেতে হবে ২০ মে, ১৯৭১ তারিখটি। খুলনার চুকনগরে এদিন ইতিহাসের সর্ববৃহৎ একক গণহত্যা সংঘটিত হয়।
"এর পর মিলিটারিরা রাস্তার অপর সাইডে চলে গেল এবং বটিয়াঘাটা,দাকোপ,ছিয়ানব্বই গ্রাম ইত্যাদি এলাকা থেকে আগত হাজার হাজার শরণার্থীর উপর নির্বিচারে গুলি করতে লাগলো।মিলিটারিরা প্রথমে মালথিয়া গ্রামে এসে আমার বাবাকে গুলি করে হত্যা করে তাদের হত্যাযজ্ঞের সূচনা করে।আমরা দেখতে পেলাম মেশিন গানের ব্রাশফায়ারে হাজার হাজার মানুষ পাখির মতো পড়ে যেতে লাগলেন।বৃদ্ধ মহিলা পুরুষসহ আনুমানিক ২ থেকে ৩ হাজার মানুষ সেখানে তারা হত্যা করে।
... এরপর মিলিটারিরা ওখানকার একটি রাস্তা দিয়ে পূর্ব দিকে যায় এবং সেখান থেকে চুকনগর বাজারে যেয়ে গুলি করে।বাজারে তাদের গুলিতে হাজার হাজার মানুষ নিহত হন।চুকনগর সরদার বাড়ি ও অন্যান্য এলাকার প্রায় চার হাজার মানুষকে গুলি করে হত্যা করে পাকি আর্মিরা।সকাল সাড়ে ন'টা থেকে বিকেল ৩ টা পর্যন্ত তারা অবিরাম গুলি চালিয়ে হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করে।সাতক্ষীরা থেকে প্রথমে এক গাড়ি পাকি আর্মি আসে,পরে আরো দু'গাড়ি আর্মি এসে তাদের সাথে যোগ দেয়।এরপর হত্যাযজ্ঞ শেষ হলে তারা গাড়িসহ সাড়ে তিনটায় সাতক্ষীরার দিকে চলে যায়।
... ২০-২৫ টা করে লাশ প্রতিদিন ঘ্যাংরাইল নদীতে আমরা টেনে ফেলেছি।চার পাঁচদিন যাবত আমরা এই কাজ করি।আর চুকনগরে যে লাশ পড়েছিল তা সব ভদ্রা নদীতে ফেলা হয়।"
ঢাকা পৌরসভার সুইপার সাহেব আলীকে ভুলে যেতে হবে ২৯ মার্চ, ১৯৭১ তারিখটি, যেদিন তিনি আরমানিটোলার এক বাড়িতে দশ এগারো বছরের একটি মেয়ের লাশ পান। মেয়েটির সমস্ত শরীর ক্ষতবিক্ষত ছিল,জমাট বাঁধা ছোপ ছোপ রক্ত সারা গায়ে,এবং তার দেহের বিভিন্ন স্থানের মাংস তুলে ফেলা হয়েছিল।ধর্ষণ শেষে মেয়েটির দুই পা দু’দিক থেকে টেনে ধরে নাভি পর্যন্ত ছিঁড়ে ফেলা হয়েছিল।তাকে ভুলে যেতে হবে ৩০ মার্চ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের চারতলার ছাদের উপরে আনুমানিক ১৮ বছরের একটি মেয়ের লাশ পান সাহেব আলী,যথারীতি উলঙ্গ।পাশে দাঁড়ানো একজন পাক সেনার কাছ থেকে তিনি জানতে পারেন মেয়েটিকে হত্যা করতে ধর্ষণ ছাড়া অন্য কিছু করার দরকার পড়েনি,পর্যায়ক্রমিক ধর্ষণের ফলেই তার মৃত্যু ঘটে।মেয়েটির চোখ ফোলা ছিল,যৌনাঙ্গ এবং তার পার্শ্ববর্তী অংশ ফুলে পেটের অনেক উপরে চলে এসেছে,যোনিপথ রক্তাক্ত,দুই গালে এবং বুকে ছিল কামড়ের দাগ।
হিনা রাব্বানি আমাদের কী ভুলে যেতে বলেন? ১৬ ডিসেম্বর? ২৫ মার্চ? ভুলে যেতে বলেন চুকনগর-রায়েরবাজার-গোলাহাটা? ভুলে যেতে বলেন পিতার লাশ, মায়ের থ্যাঁতলানো শরীর? বাংলাদেশের প্রতি ইঞ্চি মাটিতে শকুন আর শেয়ালের দল হত্যার উৎসব চালিয়েছে সেই স্মৃতি ভুলে যেতে বলেন হিনা রাব্বানি?
দুঃখিত মিসেস রাব্বানি। আমি আমার জন্মের ইতিহাস ভুলতে অপারগ।আমি ভুলতে পারবো না কীভাবে আপনার রাষ্ট্র আমার দেশের মানুষকে হত্যা করেছে - গুলি করে,জীবন্ত কবর দিয়ে,জবাই করে। আমি ভুলতে পারবো না কীভাবে আপনার সেনাবাহিনী আমার বোনকে ধর্ষণের পর হত্যা করেছে যোনীপথে বেয়নেট ঢুকিয়ে। আমি ভুলতে পারবো না সেই মৃত্যুময় বিষাক্ত দিন ও রাত, আমি ভুলতে পারবো না জমাট রক্ত আর থকথকে মগজে ঢেকে থাকা স্বাধীনতার সিঁড়িপথ।
দুঃখিত হিনা রাব্বানি, আমি অতীত ভুলতে অক্ষম।
----ফেসবুক থেকে সংগহীত