
মাথার বাম কোণায় হঠাৎ আলুর মতো গজিয়ে ওঠা মাংসপিন্ড দেখে ভয় পেয়ে গেল বাবা-মা। টিউমার-ফিউমার না তো? এই ডাক্তার সেই ডাক্তার দৌড়াদৌড়ি। তখন বয়স আমার কতো হবে? দশ-বারো দিন...হুমম। এরকমই হবে। ঘন ঝাকড়া চুলের মাথা নিয়ে জন্মেছিলাম। প্রথম প্রথম তাই আলুটা চোখে পড়েনি কারও। মায়ের অবশ্য ভিন্নমত, সেটা নাকি জন্মের কিছুদিন পরেই আস্তে আস্তে গজিয়েছিল। বাবা-মার দুশ্চিন্তাকে ছাপিয়ে গেল খালা-মামাদের দুশ্চিন্তা। অমুক ডাক্তার তমুক সার্জনের খবর আনতে লাগলেন নিয়মিত। যাই হোক, খালা-মামাদের ভালোবাসা কিংবা বাবা-মার কোন পূণ্যেই হয়তোবা...মাথার আলুটা আলু হয়েই মাথায় রইলো। বড় কিছু হলো না। সে আলুও আমি চুলের জঙ্গলে দিব্যি আড়াল করে রেখেছি। বলে না দিলে খুব কম মানুষই তার অস্তিত্ব বুঝতে পারে।

শান্ত স্বভাবের জন্য সবাই আমার নাম দিয়েছিল ঠান্ডু মিয়া। ছোট বাচ্চারা যে শান্ত হতে পারে...এটা আজকালের বাচ্চাদের দেখে আমার একরত্তিও বিশ্বাস হয় না


জন্মের পরে সব শিশুই কিছুটা গাবদুগুবদু থাকে। আমিও ব্যতিক্রম ছিলাম না। স্বাস্থ্য বেশ ভালো ছিল। সেই সাথে আমার শরীরের হাড় ছিল খুবই নরম। সব মিলিয়ে তুলতুলে পুতুল আর কি! তাই আমাকে কোলে নিতে সবাই উৎসুক। আমিও সব বুঝতে পেরে সেই বয়সেই নিজের দাম বাড়িয়ে ফেললাম


আরেকটু বড় হতেই আমি এটা সেটা ধরার বায়না ধরতাম। এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, আমার মা বেশ কড়া মানুষ ছিল...বিশেষ করে সন্তান লালন-পালনে। একদিন আমাকে টেবিলে বসিয়ে মা ইস্ত্রি করছেন। এইসময় আমি বায়না ধরলাম ইস্ত্রি ধরবো। এ বায়নাটা আমি প্রায়ই ধরতাম। মায়ের মাথায় ঢুকলো, যে কখনো অসতর্ক মুহূর্তে গরম ইস্ত্রি যদি আমি ধরে ফেলি! নিদেনপক্ষে ঠান্ডা ইস্ত্রিও পায়ে পড়ে ক্যাঁচা খেতে পারি! তাই ইস্ত্রি ধরার জন্য সেদিন আমি ইস্ত্রির দিকে হাত বাড়াতেই মা গরম ইস্ত্রি হাতে লাগিয়ে দিলেন।


এখন এই বয়সে এসে ভুলে যাওয়া শৈশবের গল্প শুনে নিজেকে মেলাই। এই আমি কি সেই আমি? এখনও আলুটা মাথার কোণে আছে, খুলির একটা এক্সটেনশন হিসাবে কাজ করছে। কিন্তু সেই ঝাকড়া চুল আর নেই। কলেজ পর্যন্তও ছিল...ইদানিং গণকযন্ত্রকে মন্ত্র পড়াতে পড়াতে মাথার জঙ্গলের আয়তন ঠিক থাকলেও ঘনত্ব কমে যাচ্ছে। হাড় এখনো আগের মতোই নরম, তর্জনী উলটে বাঁকিয়ে হাতে লাগাতে পারি।

পরিচিত কেউ আর ভুলেও ঠান্ডু মিয়া নামটা মনে করে না। বোনেরা কৃত্তিম ঝাঁঝে বলে," কেন কোলে আসতি না? তোরে খাইয়া ফেলতাম

ছোটবেলায় ভুলে যাওয়া শৈশবের গল্প বলার সময় মা বলেছিল, "ইস্ত্রি দেখলে খালি হাত বাড়াইতি, তাই গরম ইস্ত্রি লাগায় দিসি। তারপর থেকে আর হাত বাড়াস নাই।" মাকে মাঝসাঝে জিজ্ঞেস করি, "এতো নিষ্ঠুর কেমনে হইলা? গরম ইস্ত্রি লাগায় দিলা?


এমনি করে শৈশবের অনেক গল্প বলা যেতে পারে...এ গল্পগুলো শেষ হবে না আসলে। স্মৃতিচারণের গল্প শেষ হয় না। নিজের স্মৃতিতে প্রিয় শৈশবের প্রায় সবটুকু আছে। যেটুকু শৈশবের স্মৃতি থাকার কথা না, তা আশেপাশের মানুষগুলো যত্ন করে মনে রেখেছে, মাঝেসাঝে শুনিয়ে যায়, স্মৃতিকাতর করে দিয়ে যায়। আমি অবাক হই...আমার মতো অভাগার জন্য তারা তাদের কিছু স্মৃতি বরাদ্দ রেখেছে। এ ভালোবাসাও কম নয়। সূর্যবন্দী মেঘের গল্পটুকু সেই ভালোবাসার মানুষদের জন্যই।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১০ সন্ধ্যা ৬:১৪