somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গুলতেকিন কে যেভাবে বিয়ে করেছিলেন হুমায়ূন আহমেদ

২২ শে আগস্ট, ২০১২ দুপুর ১:০০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এই জীবনে বেশিরভাগ কাজই আমি করেছি ঝোকের মাথায়।

ডিগ্রী শেষ করে দেশে ফিরলাম। সাত বছর আমেরিকায় কাটিয়ে যে সম্পদ নিয়ে ফিরলাম তা হল নগদ পঞ্চাশ ডলার, দুই স্যুটকেস ভর্তি বাচ্চাদের পুরানো খেলনা, এক স্যুটকেস বই এবং প্রচুর চকলেট।

আমি যে সব সময় ইমপালস- এর উপরে চলি তা কিন্তু না। কাজে-কর্মে, চিন্তা-ভাবনায় আমি শুধু যে গোছানো তা না, অসম্ভব গোছানো। কখন কি করব, কতক্ষণ করব তা আগে ভাগে ঠিক করা। কঠিন রুটিন। সময় ভাগ করা তারপরেও হঠাৎ হঠাৎ কেন জানি মাথা এলোমেলো হয়ে যায়। উদ্ভট একেকটা কাণ্ড করে বসি। কোন সুস্থ মাথার মানুষ যা কখনো করবে না।

গুলতেকিনের সঙ্গে বিয়ে হয় এমন ঝোঁকের মাথায়। তখন আমি হতদরিদ্র। লেকচারার হিসেবে ইউনিভার্সিটি থেকে সব মিলিয়ে সাত/আটশ’ টাকা পাই। দুই ভাইবোন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। বাবর রোডের এক বাসায় থাকি। সে বাসা সরকারী বাসা। এভিকেশন নোটিস হয়ে গেছে। ম্যাজিস্ট্রেট নিজে এসে বলে গেছেন বাড়ি ছেড়ে দিতে। পনেরো দিনের নোটিস। বাড়ি না ছাড়লে পুলিশ দিয়ে উঠিয়ে দেয়া হবে। টাকা পয়সার দিক দিয়ে একেবারে নিঃস্ব। মাসের শেষের দিকে বেশির ভাগ সময়ই বাসে করে ইউনিভার্সিটিতে আসার পয়সাও থাকে না। হেঁটে হেঁটে আমি ক্লাসে যাই। ক্লাস শেষ করে ক্লান্ত হয়ে হেঁটে হেঁটে বাসায় ফিরি। নিতান্ত পাগল না হলে এমন অবস্থা কেউ বিয়ের চিন্তা করে না।

আমার মনে হল গুলতেকিন নামের এই বালিকাটিকে পাশে না পেলে আমার চলবে না। গুলতেকিনের মা-বাবা আমার কাছে মেয়ের বিয়ে দেবেন না। বড় মেয়েরই বিয়ে হয় নি। ক্লাস টেনে পড়া মেয়ের বিয়ে হবে কি করে? কি করা যায় কিছুই ভেবে পাই না।
একদিন গুলতেকিন ডিপার্টমেন্টে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। আমি বললাম, চল এক কাজ করি – আমরা কোর্টে গিয়ে বিয়ে করে ফেলি।

সে চোখ বড় বড় করে বলল, কেন? কোর্টে গিয়ে বিয়ে করব কেন?
‘খুব মজা হবে। নতুন ধরনের হবে। ব্যাপারটা খুব নাটকীয় না? তোমাকে ভাবার জন্য তিন মিনিট সময় দিলাম। তুমি ভেবে দেখ, তারপর বল।’

সে ভাবার জন্য তিন মিনিটের মত দীর্ঘ সময় নিল না। এক মিনিট পরেই বলল, চলুন যাই। কিন্তু আমি তো শাড়ি পরে আসি নি। সালোয়ার-কামিজ পরে কি বিয়ে করা যায়?
কোর্টে শেষ পর্যন্ত যাওয়া হল না। কনের বয়স চৌদ্দ। এই বয়সে বিয়ে হয় না। আমি কোন উপায় না দেখে তাঁর ফুপু খালেদা হাবীবকে একটি দীর্ঘ চিঠি লিখলাম। আমার সাহিত্যপ্রতিভার পুরোটাই ঢেলে দিলাম চিঠিতে। চিঠি পড়ে তিনি বিস্মিত এবং খুব সম্ভব মুগ্ধ। কারণ তিনি গুলতেকিনের পরিবারের সবাইকে ডেকে দৃঢ় গলায় বললেন, এই ছেলের সঙ্গেই গুলতেকিনের বিয়ে দিতে হবে। অন্য কোথাও নয়। ভবিষ্যৎ-এ যা হবার হবে।
আমার চিঠির জবাবে তিনি লিখলেন – “আপনার অদ্ভুত চিঠি পেয়েছি। এত বানান ভুল কেন?”
তারা ক্লাস টেনে পড়া মেয়েকে আমার সঙ্গে বিয়ে দিতে রাজী হয়েছেন। এপ্রিল মাসের ২৮ তারিখে বিয়ে হবে। এই খবরে আমার এবং মা’র মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। হাতে একটা পয়সা নেই। যে কোন মুহুর্তে আমাদের বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবে। এই অবস্থায় বিয়ে। কে জানে নতুন বউ নিয়ে বাসায় এসে দেখা যাবে পুলিশ দিয়ে সবাইকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। নতুন বউ নিয়ে রাস্তায় রাত কাটাতে হবে।
মা তাঁর সর্বশেষ সম্বল বাবার দেয়া হাতের একজোড়া বালা, যা তিনি চরম দুঃসময়েও যক্ষের ধনের মত আগলে রেখেছিলেন, বিক্রি করে বিয়ের বাজার করলেন। জিনিসপত্রগুলি খুব সস্তা ধরনের কিন্তু তাতে মিশে গেল আমার বাবা এবং মা’র ভালবাসা। আমি জানতাম ভালবাসার এই কল্যাণময় স্পর্শেই আমার অনিশ্চয়তা, হতাশা কেটে যাবে।

বউ নিয়ে বাসায় ফিরে বড় ধরনের চমক পেলাম। আমার শোবার ঘরটি অসম্ভব সুন্দর করে সাজিয়ে দিয়েছে আমার ছোট বোন। আমাদের কোন ফ্যান ছিল না। কিন্তু আজ মাথার উপরে ফ্যান ঘুরছে। বিছানায় কি সুন্দর ভেলভেটের চাদর। খাটের পাশে সুন্দর দুটি বেতের চেয়ার। বেতের চেয়ারের পাশে ছোট্ট একটা টেবিলে একগাদা রক্ত গোলাপ। গোলাপের পাশে একটা চিঠিও পেলাম। মেজো বোন শিখুর লেখা চিঠি -

“দাদা ভাই,
তুমি যে সব গান পছন্দ করতে তার সব ক’টি টেপ করা আছে। কথা বলতে বলতে তোমরা যদি ক্লান্ত হয়ে পড় তাহলে ইচ্ছা করলে গান শুনতে পার। দরজার কাছে একটা ক্যাসেট প্লেয়ার রেখে দিয়েছি।”

ক্যাসেট প্লেয়ার চালু করতেই সুচিত্রা মিত্রের কিন্নর কন্ঠ ভেসে এল – ভালবেসে যদি সুখ নাহি তবে কেন, তবে কেন মিছে এ ভালবাসা?
গভীর আবেগে আমার চোখে জল এসে গেল। আমি সেই জল গোপন করবার জন্য জানালা দিয়ে তাকিয়ে বললাম, কেমন লাগছে গুলতেকিন?
সে নিচু গলায় বলল, বুঝতে পারছি না। কেমন যেন স্বপ্ন স্বপ্ন লাগছে।
‘ঘুম পাচ্ছে?’
‘না।’
সারারাত আমরা গান শুনে কাটিয়ে দিলাম দু’জনের কেউই কোন কথা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। গান শোনা ছাড়া উপায় কি?

পরদিন ভোরবেলা খুব দুঃখজনক ব্যাপার ঘটল। যাদের বাসা থেকে সিলিং ফ্যান ধার করে আনা হয়েছিল তারা ফ্যান খুলে নিয়ে গেল।

গুলতেকিন বিস্মিত হয়ে বলল, ওরা আমাদের ফ্যান খুলে নিচ্ছে কেন?
আমি মাথা নিচু করে রইলাম। জবাব দিতে পারলাম না। বিছানার চমৎকার চাদর, বেতের চেয়ার, ক্যাসেট প্লেয়ার সবই তারা নিয়ে গেল। এমন কি টেবিলে রাখা সুন্দর ফুলদানিও অদৃশ্য। গুলতেকিন হতভম্ব। সে বলল, এসব কি হচ্ছে বলুন তো? ওরা আমাদের জিনিসপত্র নিয়ে যাচ্ছে কেন? আমরা বুঝি রাতে গান শুনব না?
গুলতেকিনের প্রশ্নের জবাব দেবার মত মানসিক অবস্থা তখন আমার নেই। আমার জন্য আরো বড় সমস্যা অপেক্ষা করছে। বাসার সামনে পুলিশের গাড়ি এসে দাঁড়িয়ে আছে। আজ আমাদের বাড়ি থেকে বের করে দেবে। এই কারনেই সবাই তড়িঘড়ি করে তাদের জিনিসপত্র নিয়ে যাচ্ছে। ওদের দোষ দিয়ে লাভ নেই।

মা পুলিশ অফিসারের সঙ্গে কথা বলছেন। আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে লজ্জায় কাঁপছি। আমার ছোটবোন এসে বলল, দাদাভাই, তুমি ভাবীকে নিয়ে কোথাও বেড়াতে চলে যাও। এই নোংরা ব্যাপারটা ভাবীর সামনে না হওয়াই ভাল।

আমি গুলতেকিনকে নিয়ে বের হয়ে পড়লাম। বৈশাখ মাসের ঘন নীল আকাশ, পেঁজাতূলার স্তূপীকৃত মেঘ, চনমনে রোদ। আমরা রিকশা করে যাচ্ছি। হুড ফেলে দিয়েছি। আমার মনের গোপন ইচ্ছা – পৃথিবীর সবাই দেখুক, এই রূপবতী বালিকাটিকে আমি পাশে পেয়েছি। গভীর আনন্দে আমার হৃদয় পূর্ণ। বাসায় এখন কি হচ্ছে তা এখন আমার মাথায় নেই। ভবিষ্যতে কি হবে তা নিয়েও ভাবছি না। বর্তমানটাই সত্যি। অতীত কিছু না। - ভবিষ্যৎ তো দূরের ব্যাপার। আমরা বাস করি বর্তমানে – অতীতেও না, ভবিষ্যতেও না।

---হুমায়ূন আহমেদ
৫২টি মন্তব্য ১৯টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হাসান মাহমুদ গর্ত থেকে বের হয়েছে

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:১২


যুক্তরাষ্ট্রের একটি বাংলা টেলিভিশন চ্যানেল হাসান মাহমুদের সাক্ষাৎকার প্রচার করেছে। আমি ভাবতেও পারি নাই উনি এতো তারাতারি গর্ত থেকে বের হয়ে আসবে। এই লোকের কথা শুনলে আমার গায়ের লোম... ...বাকিটুকু পড়ুন

দারিদ্রতা দূরীকরণে যাকাতের তাৎপর্য কতটুকু?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:১৮



দরিদ্র দূরীকরণে যাকাতের কোনো ভূমিকা নেই।
যাকাত দিয়ে দারিদ্রতা দূর করা যায় না। যাকাত বহু বছর আগের সিস্টেম। এই সিস্টেম আজকের আধুনিক যুগে কাজ করবে না। বিশ্ব অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

শেখস্তান.....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:১৫

শেখস্তান.....

বহু বছর পর সম্প্রতি ঢাকা-পিরোজপু সড়ক পথে যাতায়াত করেছিলাম। গোপালগঞ্জ- টুংগীপাড়া এবং সংলগ্ন উপজেলা/ থানা- কোটালিপাড়া, কাশিয়ানী, মকসুদপুর অতিক্রম করার সময় সড়কের দুইপাশে শুধু শেখ পরিবারের নামে বিভিন্ন স্থাপনা দেখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের বিয়ের খাওয়া

লিখেছেন প্রামানিক, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:৪৮


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

১৯৬৮ সালের ঘটনা। বর আমার দূর সম্পর্কের ফুফাতো ভাই। নাম মোঃ মোফাত আলী। তার বিয়েটা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। বাবা ছিলেন সেই বিয়ের মাতব্বর।... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিএনপি-আওয়ামী লীগের মধ্যে মৈত্রী হতে পারে?

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০০


২০০১ সাল থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত আওয়ামী লীগের ওপর যে নির্যাতন চালিয়েছে, গত ১৫ বছরে (২০০৯-২০২৪) আওয়ামী লীগ সুদে-আসলে সব উসুল করে নিয়েছে। গত ৫ আগস্ট পতন হয়েছে আওয়ামী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×