চেয়ারে বসা রাজিয়ার হবু জামাই। দু’জনে চুপচাপ। পিনপতন নিরবতা ভেঙ্গে রাজিয়াই প্রথম বলে উঠে।
- কিছু খাচ্ছেন না যে?
- এই তো খাচ্ছি। আপনিও খান। আচ্ছা আপনার এই বিয়েতে মত আছে তো।
রাজিয়া ভাবছে বাবার পছন্দই তার পছন্দ। একবার অবশ্য মুখ তুলে তাকিয়েছিল তার সম্ভাব্য বরের দিকে। বেশিক্ষন তাকিয়ে থাকা হয় নি। ঐ এক পলকই যা।
- আপনার?
- আমার তো মন চাইছে এখনই বিয়ে করে নিয়ে যাই।
- আপনি তো ভারি দুষ্টু।
- আচ্ছা আপনার কি বিয়ে করার পর পড়াশুনার ইচ্ছা আছে।
- যদি স্বামী অনুমতি দেয় তাহলে।
- স্বামী অনুমতি না দিলে?
- পড়বো না।
- আপনার মা কোথায় দেখছি না যে?
রাজিয়া কি উত্তর দেবে ভেবে পায় না। তার মা তো মারা গেছেন তার যখন ৫ বছর বয়স। এরপর বাবা যাকে বিয়ে করে নিয়ে আসেন তিনিও তো সেই কবে বাবা ও তাকে ছেড়ে চলে গেছে।
- বললেন না আপনার মা কোথায়?
- মা মারা গেছেন সেই ছোট্ট বেলায়।
- শুনেছি আপনার বাবা আরেকটি বিয়ে করেছিলেন যে কিনা আপনাদের ছেড়ে চলে গেছে! কেন?
এই প্রশ্নের উত্তর কিভাবে রাজিয়া দেবে। সে তো জানে তার মা কেন ও কার সাথে পালিয়ে গেছে। কিন্তু এইসব কথা কি বলা যায়। উত্তর কি দেবে ভাবতে থাকে রাজিয়া।
- আপনি কি আমাকে বিয়ে করতে এসেছেন নাকি আমার মা’র খবর নিতে এসেছেন।
- না, মানে এমনিতেই জিজ্ঞেস করছি। যে বাড়িতে সম্পর্ক করবো সে বাড়ির মহিলা এভাবে চলে গেলো কেন জানবো না?
- আচ্ছা শুনুন তাহলে। মা’র একজন ছেলের সাথে সম্পর্ক ছিলো তার সাথে চলে গিয়েছে।
কথাগুলো বলতে রাজিয়ার কন্ঠ একটুও কাপেনি। বরং দরাজ কন্ঠে সে কথাগুলো বলে চেয়ার থেকে উঠে দাড়ায়।
- দাড়িয়ে পড়লেন কেন? বসুন।
- আপনাদের খাওয়ার এনতেজাম করতে হবে তাই।
- বসুন আরেকটু কথা বলি। আপনার কিছু জানার থাকলে প্রশ্ন করতে পারেন।
- আমার কিছু জানার নেই।
- বুঝেছি আপনি রেগে গিয়েছেন। আপনি জানেন না রেগে গেলেন তো হেরে গেলেন।
- না আমি রাগ করিনি।
- এই তো আপনি রাগ করেছেন। তানাহলে আপনার নাক লাল হলো কেন? হা হা হাহা
- আপনি কচু বুঝেছেন।
বাহির থেকে ছেলের ফুফু তাদের কথা শেষ হয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করেন। নাকি আরো সময় লাগবে। রাজিয়ার বাবা এবং ছেলের মা ও ফুফু ঘরে এলেন। রাজিয়া দাড়িয়ে রইলো। ছেলের মা রাজিয়াকে কাছে টেনে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে আবার চেয়ারে বসতে বললেন। একটি আংটি বের করে রাজিয়ার হাতে পড়িয়ে দেয়া হলো।
- মা তুমি যাও মেহমানদের খাওয়ার ব্যবস্থা করো।
- বিয়াই সাহেব আপনার মেয়েটা আমাদের পছন্দ হয়েছে। এখন দিন তারিখটা পাকা করে ফেললেই হয়। রাজিয়াকেও জিজ্ঞেস করে দেখুন তার ছেলে পছন্দ হয়েছে কিনা। এই মিনার তোমার কি রাজিয়াকে পছন্দ হয়েছে।
- মা আপনারা যা ভালো মনে করেন।
- বিয়ানি সাহেবা মেয়েটা আমার এতিম। সেই ছোট্ট বেলা মা মারা যাওয়ার পর থেকে সে একাই সংসারের হাল ধরে আছে। বাড়ির সমস্ত কাজ কর্ম করে। আপনাদের পরিবারে গিয়ে কোন কাজের ত্রুটি সে রাখবে না এটা হলফ করে বলতে পারি।
- আমরা বুঝে গেছি। এখন দিন তারিখটা পাকা করে ফেলা যাক। আমরা একটু তাড়াতাড়ি করতে চাইছি। আপনার জামাইয়ের চাকুরির কথা বার্তা ফাইনাল। টাকাটা যত তাড়াতাড়ি দিতে পারি আরকি।
- বিয়ানী সাহেবা আমাকে একটু সময় দিতে পারলে সুবিধা হতো। আচ্ছা ঠিক আছে সামনের মাসে প্রথম সপ্তাহে শুক্রবার কি বলেন?
- আলহামদুলিল্লাহ। আমাদের কোন সমস্যা নাই। আপনারা এদিকে বিয়ের আয়োজন করুন।
খাওয়া সময় রাজিয়ার দিকে তার হবু জামাই মিনার বেশ কয়েকবার আড় চোখে তাকায় যা রাজিয়ার চোখ এড়াতে পারে না। রাজিয়াও অবশ্য তার হবু জামাইয়ের দিকে তাকাতে গিয়ে দেখে মিনারও তার দিকে তাকিয়ে আছে। দু’জনার চোখাচুখিতে রাজিয়া খুব লজ্জা পায়। মেহমানরা সবাই চলে যাওয়ার পর রাজিয়া তার বাবাকে ডেকে বলে, বাবা তুমি কি সত্যি আমাকে ছাড়া থাকতে পারবে? আজমল উত্তর না দিয়েই মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বাহিরে বের হয়ে যান।
বিয়ের সকল আয়োজন সম্পন্ন। যে জমিগুলো বিক্রির কথা ছিল তা বিক্রি করে দেয়া হয়। তা থেকে লাখ পাঁচেক টাকা আসে। সেখান থেকে চার লাখ টাকা বিয়ের দু’দিন আগে মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে দিয়ে আসে। রাজিয়া অবশ্য এসবের কিছুই জানে না। হয়তো জানলে সে রাজি হতো না বিয়েতে। তাই আজমল মেয়েকে যৌতুকের বিষয়টি জানায়নি। কিন্তু রাজিয়া জেনে যায়।
- বাবা এটা কি শুনছি।
- কেন মা কি হয়েছে।
- তুমি নাকি আমার বিয়ের জন্য জমি বিক্রি করে দিয়েছো।
- তোকে কে বললো?
- সত্যি কিনা তাই বলো?
- না, মানে। বিয়েতে তো অনেক খরচ। তাছাড়া আমার একমাত্র মেয়ের বিয়ে একটু ধুমধাম না করলে কি হয় বল?
- আমি শুনেছি তুমি যৌতুক স্বরুপ তাদের টাকা দিয়েছো, এটা কি সত্যি?
আজমল কোন উত্তর দেয় না। কি উত্তর দেবে? তার জবাব দেয়ার কিছুই নেই। মেয়েটি তার ছোট থেকেই অনেক নীতিবান। তাকে বোঝানোর ক্ষমতা আজমলের নেই। বেশি কিছু বললে যদি মেয়ে বিয়েই ভেঙ্গে দেয়, তাই চুপ থাকে আজমল। মেয়ের সুখের কথা ভেবেই তো করা। তাই বলে যৌতুক দিয়ে মেয়েকে বিয়ে দিতে হবে? সমাজে এসব এখন অপেন সিক্রেট। রাজিয়ার বিয়ের প্রতি যে আগ্রহ ছিলো যৌতুকের বিষয়টি শোনার পর একেবারেই মন উঠে যায় তার। বরপক্ষ যারা দেখতে এসেছিল যে পরিমান শ্রদ্ধা তাদের প্রতি তখন জন্মেছিল এখন তাতে ভাটা পড়েছে। রাজিয়া সিদ্ধান্ত নেয় সে এ বিয়ে কিছুতেই করবে না।
রাজিয়া এক প্রকার সিদ্ধান্ত নিয়েই রেখেছে সে এ বিয়েতে কিছুতেই বসবে না। আজমল বিষয়টি নিয়ে বেশ চিন্তায় আছে। মেয়েকে কিভাবে বা কাকে দিয়ে বোঝালে সে বুঝবে। রাজিয়ার মামা-মামিকে খবর দেয়া হলো। মামা-মামিকে দেখে রাজিয়া বুঝে গেছে তারা আসলে কি জন্য এসেছে। মামি রাজিয়াকে কাছে ডেকে কিছু বলার আগেই হুংকার দিয়ে উঠে রাজিয়া। জবাব দেয়, তোমরা যত কিছুই বলো আমি ঐ ছেলেকে কিছুতেই বিয়ে করবো না। ওরা আমাকে নয় আমার বাবার টাকাকে বিয়ে করছে।
- মামি তুমিই বলো। ওখানে গেলে কি আমি সুখি হব?
- মা দেখ্। তোর বাবা কথা দিয়েছে। মান সম্মানের ব্যাপার। আর এখন তো বিয়েতে জামাইকে খুশি হয়ে মেয়ের পরিবার অনেক কিছুই দেয়। কেন বুঝতে পারছিস না, এসব তোর বাবা তোর ভালোর জন্যই করেছে।
- মামি আমি বলছি না আমি বিয়ে করবো না। কিন্তু পনবন্দি হয়ে না .....
- কোন কিন্তু না। তোর বাবার দিকে তাকিয়ে অন্তত রাজি হয়ে যা মা। ছেলের পরিবার ভালো শিক্ষিত। তুই ওখানে গেলে নিজের পড়াশুনাটাও চালু রাখতে পারবি।
- আমি সেই আশা করি না। অন্তত তাদের কাছ থেকে নয়ই। যারা যৌতুক নিতে পারে তাদের কাছ থেকে এমন আশা করা বোকামি।
আজমল পাশের ঘর থেকে মেয়ে ও মেয়ের মামির আলাপচারিতা শুনছিল। গলা খেকর দিয়ে আজমল মেয়ের ঘরে ঢুকলেন।
- দুলাভাই। কিছু বলবেন?
- রাজিয়া না চাইলে আমি ওদের না বলে দেই।
- বাবা, আমি চাইনি তুমি কষ্ট পাও। আমার কথায় যদি তুমি কষ্ট পেয়ে থাকো, তাহলে আমাকে মাফ করে দাও। তোমরা যা চাও তাই হবে।
আজ শুক্রবার রাজিয়ার বিয়ে। বিয়ের গেটসহ বাড়ির আঙ্গিনা ডেকোরেটর দিয়ে সাজানো হয়েছে। বরপক্ষদের আপ্যায়নের কোন কমতি রাখেনি আজমল। পাড়া প্রতিবেশি সবাইকেও দাওয়াত করা হয়েছে। যারা আসতে পারেনি তাদের বাড়িতে খাওয়ার পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। একমাত্র মেয়ের বিয়ে তাই কোন ঘাটতি রাখেনি বাবা আজমল।
বরপক্ষ চলে এসেছে। পুরো বাড়িতে হইচই পড়ে গেলো। পাড়ার ছোট ছেলে-মেয়েরা দৌড়ে গিয়ে বিয়ের গেট আটকায়। জামাইবাবুকে মিষ্টি খাওয়ানো হলো এবং বরপক্ষদের কাছ থেকে মিস্টি খাওয়ানোর ও ভিতরে প্রবেশের টাকা চাওয়া হয়। ছোট ছেলে-মেয়ের দাবি তা না হলে বিয়ে বাড়িতে ঢুকতেই দেয়া হবে না বরপক্ষদের। বরপক্ষ কোন টাকা দেবে না, বাচ্চারা না নিয়ে ছাড়বে না। এ নিয়ে কথা কাটাকাটিও হয়। আজমল এগিয়ে গিয়ে ছোট ছেলে-মেয়েদের সরিয়ে দেয় এবং তাদের ভিতরে নিয়ে আসে। পাড়ার লোকজন বলাবলি করতে থাকে বরপক্ষের লোকজন ছোট মানসিকতার।
অতিথি সবাইকে চিনি ও লেবুর শরবত দেয়া হলো। শরবত দেয়ার সময় বরপক্ষের কাউকে বলতে শুনা গেলো এগুলো লেবু-চিনির শরবত তারা খায় না। বিয়ে বাড়িতে অনেকে অনেক কথাই বলে সেদিকে কান দেয়া ঠিক নয়। এজন্য আজমল সবাইকে আগেই জানিয়ে রেখেছে, কেউ যেন বরযাত্রীদের সাথে কোন রকম কথাকাটি বা বেয়াদবি না করে এবং তাদের আপ্যায়নে কোন কমতি যেন রাখা না হয়।
রাজিয়াকে বধুর সাজে লাল শাড়ি গহনায় বেশ সুন্দর লাগছিল। স্যামা গায়ের বরন। আগের দিন গায়ে হলুদ দেয়ায় আরও উজ্জল দেখাচ্ছিল রাজিয়াকে। কিন্তু তার মুখে কোন হাসি নেই নেই কোন খুশির ছোয়া। দেখলে বোঝাই যাচ্ছে না আজ তার বিয়ে। আনমনস্ক চারদিকে কাউকে খুজে ফিরছে তার চোখদুটো। রাজিয়া কাকে খুজছে? সে অবশ্য তার বাবাকে খুজছে। ওদিকে আজমল অনেক ব্যস্ত বরযাত্রীদের নিয়ে। বরপক্ষের খাওয়া শেষে কাজিকে ডাকা হলো। কাজি বিয়ে পড়ার পর বরপক্ষ যখন বিদায় নেবে খুজে পাওয়া যাচ্ছিল না রাজিয়ার বাবা আজমলকে। কোথায় গেলো লোকটা? সবাই এদিক ওদিক খুজতে লাগলো। কোথাও নেই। কে যেন এসে বললো গোরস্থানের দিকে যেতে দেখেছে আজমলকে। মেয়েকে বিয়ে দিয়ে পরের ঘরে পাঠাচ্ছেন কিন্তু রাজিয়াকে ছোট রেখেই দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছেন তার মা, যাকে জানানো হয়নি। তাই গোরস্থানে গিয়ে আজমল স্ত্রীর কবর জিয়ারতে গিয়ে মেয়ের বিয়ের খবর জানিয়ে আসেন।
বিদায়ের বেলা রাজিয়ার বুক ফেটে কান্না বেরুচ্ছিল। আঙ্গিনায় এসে গোয়াল ঘরে চোখ পড়তেই দেখে বাড়ির পোষা গরুগুলো রাজিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। বাবাকে খুজছে সেই তখন থেকে রাজিয়া। কাজের চাপে বাবা মেয়ের সামনে একবারও আসতে পারেনি। মেয়েকে বিয়ের সাজে দেখাও হয়নি আজমলের। এবার মেয়েকে বিদায় জানানোর পালা। ছেলের হাতে মেয়েকে তুলে দিয়ে আজমল বলেন, এই এতিম মেয়েটাকে বাবা তুমি দেখে রেখো। বলেই ডুকরে কেঁদে উঠে আজমল। রাজিয়াও বাবার গলা ধরে কান্না শুরু করে দেয়। এবার আজমল মেয়ের কান্না দেখে নিজেকে সামলায়।
সবাইকে গাড়িতে উঠিয়ে দিয়ে আজমল বাড়িতে ফিরে আসে। গোটা বাড়ি যেন বোবা কালা হয়ে আছে। গোয়াল ঘরে গিয়ে গরুগুলোকে খড় দেয়া হয়। সকাল থেকে সবাই ব্যস্ত থাকায় তাদের খাওয়ানোর কথা মনে ছিলো না কারও। তাছাড়া যার মনে থাকার কথা সেই তো নাই। গরুগুলো মাথা এপাশ ওপাশ করে জানায় তারা খাবে না। অবুঝ পোষা প্রাণীগুলোও বুঝে গেছে সার্বক্ষনিক তাদের দেখাশুনা করার মানুষটি তাদের চলে গেছে।
পরিচিত পরিবেশ ছেড়ে নতুন এক জায়গায় এসে রাজিয়ার লজ্জাভাবটা যেন আরো বেড়ে গেছে। স্বামীর পরিচতি বন্ধু ছোট ভাই আত্মীয় স্বজন এসে দেখা করতে থাকে। রাত প্রায় ১১টা। বাসর ঘরটা সাদামাটাভাবে সাজানো হয়েছে। এ নিয়ে রাজিয়ার অবশ্য কোন আক্ষেপ নেই। খুব সাধারণভাবে বেড়ে উঠায় জাকজকমতা তার পছন্দ নয়। সালাম দিয়ে ঘরে প্রবেশ করলো মিনার অর্থাৎ রাজিয়ার স্বামী।
- আসসালামু আলাইকুম।
- ওয়ালাইকুম আসসালাম।
- এখানে কোন সমস্যা হচ্ছে না তো।
- সমস্যা কিসের?
- না মানে গরীব মানুষের ঘর কিনা তাই!
- মেয়েদের বিয়ের পর স্বামীর ঘরই আপন। গরীব হলেও যা ধনী হলেও তা।
বিয়ের পরের দিন খুব সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে রাজিয়া রান্না ঘরে যায়। অগোছালো রান্নাঘরটা পরিস্কার করে গুছিয়ে রাখে। ইতিমধ্যে শাশুড়ি ঘুম থেকে উঠে ছেলে বৌকে রান্না ঘরে দেখে অবাক হয়।
- মা তুমি এখানে কি কর?
- এমনিতেই দেখছিলাম। অনেক অগোছালো তাই একটু পরিস্কার করছিলাম।
রাজিয়া কপালে ঘাম নাকটা লাল হয়ে আছে। শরীরটাও ঘেমে থ্যাকথ্যাকে হয়ে আছে। সেই সকাল বেলা গোসল করে রান্না ঘরে ঢুকেছে। যা অবস্থা আরেকবার তাকে গোসল করতে হবে।
- কি করবো বলো? বাড়িতে মহিলা মানুষ আমি একাই। নিজের চাকুরি তারউপর বাপ ছেলের জন্য রান্না বান্না। ঠিক মতো গুছিয়ে রাখা হয় না।
- এখন থেকে আর আপনার রান্না ঘরে প্রবেশ নিষেধ।
বৌমার মুখ এমন কথা শুনে মিনারের মায়ের বুকটা ভরে গেলো। রাজিয়াকে প্রথম দেখাতেই তার পছন্দ হয়েছিল কিন্তু এত সংসারি মেয়ে এটা জানা ছিলো না। এভাবে চলতে থাকলো রাজিয়ার নতুন সংসার। স্বামী, শ্বশুড় ও শাশুড়ির সেবা যতœ করাকে রাজিয়া এক প্রকার ইবাদতে পরিনত করলো। তাদের খাওয়া দাওয়া কাপড় চোপড় ধোয়া বাড়ি ঘর ঝাড়– দেয়া মুছা সব কাজ একাই করে রাজিয়া। এ নিয়ে তার কোন আক্ষেপ নেই।
রাজিয়া একদিন তার স্বামীর পুরাতন বই বের করে মুছতে থাকে। মা পাশে দাড়িয়ে দেখে তার একটি বইয়ের কিছু অংশ পড়ছে রাজিয়া।
- মা তুমি কি পড়াশুনা করতে চাও?
রাজিয়া জানে স্বামীর সংসারে এসে পড়াশুনা করতে চাওয়ার কথা বললে তারা কি মনে করে তাই উত্তর দেয়, না এমনিতেই দেখছিলাম।
- শুনেছি তুমি ক্লাস ফাইভ ও এইটে বৃত্তি পেয়েছিলে? আমি মিনারকে বলি তোমাকে যেন আবার স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেয়।
- থাক মা। এখন এই বয়সে আর পড়া মাথায় ঢুকবে না।
মনে মনে রাজিয়ার অনেক ইচ্ছা সে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হবে। কিন্তু এই ইচ্ছা পুরন করার কথা সে কাউকে বলতে পারছে না।
রাজিয়ার স্বামীর চাকুরির কথা বার্তা ফাইনাল। সরকারি চাকুরি ৫ লাখ টাকা ঘুষ দিলে চাকুরিটা হবে। রিটার্ণ পরীক্ষায় টিকেছে ঠিকই কিন্তু ভাইভা দেয়ার আগে যদি টাকাটা দিতে পারে তাহলেই চাকুরিটা হবে। এই কারণেই মিনার ঢাকা যাচ্ছে। রাজিয়ার মনটা খারাপ স্বামী তাকে ছেড়ে যাচ্ছে কিন্তু মুখে তার হাসি মাখা।
রাজিয়ার স্বামী মিনার বড় হওয়ার পর এই প্রথম পরিবার ছেড়ে বাহিরে কোথাও যাচ্ছে। যাওয়ার উদ্দেশ্য চাকুরির ইন্টারভিউ। মিনারের বাবা-মা যতটা না চিন্তিত তার ঢের অধিক উদ্বিগ্ন রাজিয়া। তার মাথায় এক চিন্তা ঢাকায় গিয়ে সেখানে কি খাবে কিভাবে চলবে-ফিরবে? অনেক যত্ন করে স্বামীর ব্যাগ গুছিয়ে দেয় রাজিয়া। তাতে কাপড় চোপড়, দাঁত মাজার ব্রাশ পেষ্ট থেকে শুরু করে তেল-ক্রিম-সাবান দৈনন্দিন জীবনে টুকিটাকি যা প্রয়োজন সব গুছিয়ে দেয়। কিছুদিন আগে আমের আচার বানিয়েছে রাজিয়া। এক বৈয়াম আচার স্বামীর বেগে ঢুকিয়ে দেয়।
- শুন, তুমি তো বাহিরের রান্না খেতে পারো না। আচার দিয়েছি। খাওয়ায় রুচি হবে।
- তুমি চিন্তা করবা না। মাস খানেক বাদেই সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে। এরপর তোমাকেও নিয়ে যাবো ঢাকা।
- থাক, আমাকে আর ঢাকা গিয়ে কাজ নেই। আমি এখানেই বাবা-মা’র কাছে থাকবো। পারলে তুমি আরেকটা বিয়ে করে নিও ওখানে।
- সত্যি বলছো তো! আচ্ছা তুমি যখন বললে একটা বিয়ে করে নিবো ওখানে।
রাজিয়ার শ্বশুর বাড়ি সদর উপজেলায়। প্রতিদিন সেখান থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে দুইটি আন্তঃনগর ট্রেন ছেড়ে যায়। ট্রেনের টিকেট অগ্রীম কাটা হয়েছে। ছাড়ার নির্ধারিত সময় রাত ৮.৩০ মিনিট। তার আগেই স্টেশনে চলে আসতে হবে মিনারকে। তাই হাতে সময় নিয়েই বাড়ি থেকে বের হয় মিনার। বাসা থেকে স্টেশনের দুরত্ব পায়ে হেটে ১০/১৫ মিনিট। রাজিয়া স্বামীর পেছন পেছন রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে আসে। তার মনটা চাইছে স্বামীর সাথে যেতে কিন্তু এ যে সম্ভব নয়। বুঝতে দেয়নি স্বামীকে তার মনটা আসলেই খারাপ। হাসিমুখেই বিদায় জানায় রাজিয়া।
স্বামীকে বিদায় দিয়ে ঘরে ফিরে খেয়াল করে ঘরটা কেনজানি খাঁ খাঁ করছে। পাশের ঘর থেকে মা ডাক দেয়।
- কোথায় গেলে মা রাজিয়া, খেতে আসো।
স্বামীকে বিদায় দেয়ায় মনটা খারাপ এটা মা-বাবা বুঝতে যাতে না পারে এজন্য আয়নায় দাড়িয়ে ভালোভাবে চোখ মুখ মুছে নিলো রাজিয়া।
- ভালো লাগছে না মা। আপনারা খেয়ে নিন। আমি না হয় পরে খেয়ে নিব।
- বুঝি মা, দুই একদিন খারাপ লাগবে। পরে ঠিক হয়ে যাবে। এত বড় রাত না খেলে যে অসুখ করবে। যতটুকু পারো খেয়ে নাও।
মন না চাইলেও সামান্য একটু ভাত খেয়ে উঠে পড়ে রাজিয়া। বিছানায় গিয়ে এপাশ থেকে ওপাশ ফেরা মাত্রই তার বুকটা ধক করে উঠে। মিনার কোথায় গেলো? সম্বিত ফিরে পায় রাজিয়া। সে ভুলেই গিয়েছিল তার স্বামী দুরে, অনেক দুরে চলে গেছে। রাজিয়া ভাবতে থাকে মিনার ফিরে এলে তার সাথে সেও ঢাকায় যাবে। একা একা থাকা তার পক্ষে সম্ভব নয়। আবার এও ভাবে বাড়িতে বাবা-মা’কে একা ফেলে গেলে তাদের দেখা শুনা কে করবে?
দেখতে দেখতে মাস কেটে গেলো। কিন্তু মিনারের বাড়ি ফেরার কোন খবর নেই। স্বামী ফিরছে না কেন, এ কথা বাবা-মাকে বলতেও লজ্জা পাচ্ছে রাজিয়া। ও তো যাওয়ার সময় বলেছিল, এক সপ্তাহের মধ্যে কাজ শেষ হয়ে যাবে। কোন বিপদ হলো না তো আবার। অজানা এক ভয় কাজ করছে রাজিয়ার মনে। একটা চিঠি লিখবে কিন্তু কোন ঠিকানায়। মিনারের ঠিকানা জানে না রাজিয়া। স্বামীকে নিয়ে রাজিয়া যত না চিন্তিত বাবা-মা হিসেবে আরও বেশি চিন্তিত থাকার কথা কিন্তু তাদেরকে দেখে মনে হচ্ছে না। তাই রাজিয়া কিছু জানায় না বাবা-মাকে। তারপর তার সেই ভয়, না জানি মিনারের কিছু হলো না তো!
- মা একটা কথা বলবো?
- হ্যা মা বলো।
- মা, আপনার ছেলে সেই কবে গিয়েছে। উনি ভালো আছেন তো।
- হ্যা। ও ভালো আছে। বাজারে তোমার শফিকুল চাচার কাছে মোবাইল করেছিল। ইন্টারভিউ অনেক ভালো হয়েছে নাকি। সামনের সপ্তাহে চলে আসবে। আসার সময় তোমার বাবা ও তোমার জন্য মোবাইল কিনে আনবে বলেছে।
- আমি মোবাইল নিয়ে কি করবো?
- মিনারের চাকরি হয়ে গেলে ঢাকায় থাকবে। সঙ্গে সঙ্গে তোমাকে হয়তো নিয়ে যেতে পারবে না। তাই কথা বলতে ইচ্ছে করলে তখন মোবাইল করবে।
রাজিয়ার মনটা গত কয়েকদিনের চেয়ে অনেক ভালো। অনেক দিন পর স্বামীর খবর পেয়ে খুব ভালো লাগছে তার।
যোহরের আজান হচ্ছে। বাবা ও মা স্কুল থেকে চলে আসবেন এই ফাকেই গোসলটা সেরে ফেলা যাক। রাজিয়া গোসল করতে গেলে মা ডাক দেন।
- রাজিয়া কোথায় গেলি মা। এই দেখ তোর জন্য মিনার কি পাঠিয়েছে।
একটা মোবাইল রাজিয়ার হাতে দিয়ে মা বলে, এই নে। আমার বউ পাগল ছেলেটা তোর জন্য কি পাঠিয়েছে দেখ।
বিশ্বাস হচ্ছিল না রাজিয়ার। নিজের ঘরে গিয়ে মোবাইটা বুকে জড়িয়ে কান্না জুড়ে দেয় দেয় সে। ওদিকে মিনার অপেক্ষায় আছে কখন রাজিয়ার হাতে মোবাইল পৌছাবে আর ও ফোন করে বলবে কেমন আছে সে?
(চলবে)
১ম পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে নভেম্বর, ২০১৬ রাত ১২:৪৯