এক,
”যুদ্ধে প্রতারনা বৈধ”-
ওহুদের যুদ্ধে মুসলমানদের ভুলের কারণে তাদের খেসারত দিতে হয় যা ঐতিহাসিক সত্য। তথাপি মুসলিমরা অতি কষ্টে কাফেরদের পরাজিত করে অনেক ক্ষয় ক্ষতির বিনিময়ে। যুদ্ধ ফেরত মুসলিমদের ঘরে ঘরে তখন চলছিল শহীদ পরিবারগুলোর মাতম। সহায় সম্বল হারিয়ে অনেকে দিশেহারা। এদিকে কাফেররা প্রায় জিততে জিততে হেরে গিয়ে তারা পূনরায় যুদ্ধের প্রিপারেশন নিচ্ছিল। খবর এলো, মক্কা ও তার আশ পাশের সকল কাফের শক্তি এক জোট হয়ে নবী মুহম্মদ (সা এর মদিনায় আক্রমন করবে।
এই খবর প্রচার হলে মুসলিমদের মনে তখন বড় ভয়ের সঞ্চার হয়। সেল্ফ ডিফেন্স হিসেবে মদিনার সম্মুখপ্রান্তে খন্দক বা খাল খনন করার কাজ শুরু হলো। মুনাফিকরা হাসাহাসি শুরু করে দিল। মুনাফিক সর্দার ইবনে উবাই যিনি মুহম্মদ সা: মদিনায় প্রবেশের পূর্বে মদিনাবাসী তাকে সর্দার বা বাদশা হিসেবে এক প্রকার মনোনয়ন দিয়ে রেখেছিল এবং তার মুকুটও তৈরী করা হয়েছিল যে কিনা অনেক লোকজনকে সঙ্গে নিয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহন করে তারা মুমিনদের মনোবল ভেঙ্গে দিতে নানা ধরনের অপ-প্রচার চালাতে থাকলো।
তারা এমনও বলতে থাকলো, আক্রমন কারীদের সাথে আপোষ রফা করে নাও এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তাদের হাতে তুলে দাও। এটা এমন একটা কঠিন পরীক্ষার সময় ছিল যার মধ্যে পড়ে এমন প্রত্যেক ব্যক্তির মুখোস উন্মেচিত হয়ে গেছে যার অন্তরে সামান্য পরিমাণও মুনাফিকি ছিল।
মদিনার এক প্রান্তে ছিল ইয়াহুদিরা যাদের সাথে ছিল মুসলিমদের মৈত্রী চুক্তি। তাদের কাছে মুসলিম পরিবারগুলোকে পাঠিয়ে দেয়া হলো এবং সেদিক থেকে কোন প্রতিরোধের ব্যবস্থা করা হলো না। যখন এই অঞ্চলের ইয়াহুদিদের সর্দারকে মুহম্মদ সা: এর বিরুদ্ধে দাড়ানোর আহ্বান জানানো হলো প্রথমাবস্থায় বিরত থাকলেও পরবর্তীতে মুসলিমদের প্রতি তাদের বৈরী মনোভাবের কারণে চুক্তি ভঙ্গ করতে প্রস্তুত হলো। অর্থাৎ মুসলমানরা চুতর্দিক থেকে পুরো অসহায় এক অবস্থার মধ্যে পড়ে যায়।
এই অবস্থায়, নবী মুহম্মদ এক প্রকার সিদ্ধান্ত নেন মদিনার এক তৃতীয়াংশ ফসল দিয়ে একটি সন্ধি করা হবে কাফের জোটের এক দলের সাথে। কিন্তু সাহাবীরা বাধ সাধেন। তারা নবীকে জিজ্ঞেস করেন, এটা কি আল্লাহর হুকুম, যা ছাড়া আর কোন পথ নেই ? না কি নিছক আমাদেরকে বাঁচাবার একটি ব্যবস্থা।
জবাবে নবী মুহম্মদ বলেন, “আমি কেবল তোমাদের বাচাবার জন্য এ ব্যাবস্থা অবলম্বন করছি। কারন আমি দেখছি সমগ্র আরব একজোট হয়ে তোমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। আমি তাদের এক দলকে অন্য দলের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত করে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে চাই।
সাহাবীরা বললেন, এ চুক্তি খতম করে দিন। যখন আমরা মুশরিক ছিলাম তখনও এ গোত্রগুলো আমাদের কাছ থেকে একটি শস্যদানাও কর হিসেবে আদায় করতে পারেনি, আর আজ তো আমরা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের প্রতি ঈমান আনার গৌরব অধিকারী। এ অবস্থায় তারা কি এখন আমাদের থেকে কর উসূল করবে? তাঁরা চুক্তিপত্রের খসড়াটি ছিঁড়ে ফেলে দেন, যার ওপর তখনো স্বাক্ষর করা হয়নি।
নবী মুহম্মদ যে গোত্রের সাথে চুক্তির চিন্তা ভাবনা করছিলেন সেই গোত্রের এক নব মুসলিম এসে বললেন, তার ইসলাম ধর্ম গ্রহনের খবর এখনও কেউ জানে না। চাইলে তাকে গুপ্তচর হিসেবে কাফেরদের যুদ্ধের ময়দানে পাঠিয়ে গোপন খবর সংগ্রহ করাতে পারেন। নবী সা: বললেন, তুমি গিয়ে শত্রুদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করার চেষ্টা করো।
তারপরের ঘটনা সেই লোকটির কুটচালেই পুরো কাফের জোট একে অপরকে অবিশ্বাসের কারণে একে অপরের বিপক্ষে দাড়িয়ে যুদ্ধের ময়দান থেকে চলে যায়। একি সাথে আল্লাহ প্রচন্ড ধুলি ঝড় দিয়ে কাফেরদের মনোবল একেবারে ভেঙ্গে দেন। একদিন সকালে দেখা যায় কেউ নেই যুদ্ধের ময়দানে। বেঁচে যায় মুসলিমরা। বিনা যুদ্ধে মুসলিমরা জয়ী হয়।
দুই,
পালক পুত্রের তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীকে বিয়ে
বদর ও খন্দক যুদ্ধের মধ্যবর্তী সময় তেমন কোন যুদ্ধ বিগ্রহ না থাকায় সময়টা ছিল সমাজ সংস্কারের। এরই মধ্যে মুসলিমরা বিয়ে ও তালাকের বিধান সম্পর্কে জানতে পারে এবং মদ ও জুয়াকে হারাম ঘোষনা করা হয়। পাশাপাশি উত্তরাধিকার আইন সম্পর্কেও ওয়াকিবহাল হয়ে যায় মুসলিমরা।
তৎকালিন আরব সমাজে তখন সন্তানদের দত্তক নেয়ার প্রচলন ছিলো। নিজ সন্তানের মতো দেখা এমনকি সম্পদের ভাগও দেয়া হতো। পালক পুত্র বা কণ্যা কোন রক্তের সম্পর্ক না হলেও তথাপি তাদের কারো সাথে সেই পরিবারের কারো বিয়ে দেয়াকে অবৈধ ধরা হতো।
যায়েদ নামক একজন মুক্তিপ্রাপ্ত গোলামকেও নবী মুহম্মদ সা: সেই সময় পালক পুত্র হিসেবে গ্রহন করেছিলেন। তখন সমাজে উচ্চ বংশীয় ও নিচু গোলাম শ্রেণীর মধ্যে পার্থক্যটা সপ্রকটমান ছিল। তা লোপ করার জন্যই সেই পালক পুত্রের সঙ্গে নবী মুহম্মদ সা: এর নিজ ফুফুর মেয়ে জয়নবকে বিয়ে দেন। জয়নব ছিলেন কুরাইশ উচ্চ বংশীয় আর যায়েদ ছিলেন সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত গোলাম। তাই জয়নব স্বভাবতই সেই বিয়েতে অখুশি ছিলেন। শুধু রাসুলের দিকে তাকিয়ে কিছু বলেন নি।
এদিকে দত্তক নেয়ার প্রথাটির কারণে কোরআনে যার যার সাথে বিবাহ জায়েজ ঘোষনা করা হয়েছিল তা সাংঘর্ষিক হয়ে পড়ছিল। পর্দার বিধান সুরা আহযাব বা খন্দকের যুদ্ধের সময় সুচনা হয়। এই পর্দার বিধানটি আসে মুলত এই দত্তক নেয়া সন্তানদের নিজ সন্তানের মতো তাদের সামনে চলাফেরা ও উঠা বসাকে কেন্দ্র করে। কেননা নিজ আত্মীয়তা আর মুখে ডাকা আত্মীয়তার সম্পর্ক এক হতে পারে না। এদিকে এই বিধানটি রহিত করলেই নয় একটি নজির স্থাপন করতে হবে।
পূর্বেই আমরা জানতে পারি জয়নব তার বিয়েতে খুশি ছিলেন না বংশীয় মর্যাদা ও অপছন্দ হওয়ার হেতু। তাছাড়া আগেই তালাকের বিধান যেহেতু চালু হয়েছে তাই জয়নব সিদ্ধান্ত নেয় যায়েদকে তালাক দিবেন। এদিকে আল্লাহ নবী মুহম্মদ সা: কে আরবের তথাকথিত প্রথা দত্তক নেয়া সন্তানদের স্ত্রীকে বিবাহ করা যাবে না এই প্রচলনকে ভাঙ্গার জন্য জয়নবকে বিয়ে করার হুকুম দেন। একটি মজার ঘটনা সংক্ষেপে বলি একদিন আয়েশা ও জয়নবের মধ্যে কথা কাটাকাটির এক পর্যায় কার মর্যাদা বেশি এ প্রসঙ্গে জয়নব (রা আয়েশাকে (রাবলেন, আমি জয়নব বেশি মর্যাদাবান। কেননা আল্লাহ আমার বিয়ে দিয়েছেন।
নাস্তিকরা হযরত মুহম্মদ সা: ও জয়নব রা: এর বিয়ে প্রসঙ্গে অনেক মনগড়া কিচ্ছা কাহিনী অপবাদ দিয়ে থাকে। তারা বলে, নবী মুহম্মদ একদিন জয়নবকে দেখে তার প্রেমে পড়ে যান এবং তাকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেন যেখানে জয়নব ছিলেন নবী সা: এর আপন ফুফাতো বোন তাহলে হুট করে দেখা আর প্রেমে পড়া একটা গবর গণেষ টাইপের মাথার চিন্তা ভাবনা ছাড়া বৈ কিছুই নয়।
(বিস্তারিত: সুরা আহযাব)
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে আগস্ট, ২০১৬ রাত ৮:০৭