১.
আঠারো শতকের শেষ দিকে মার্কিনীরা মাতৃভূমি ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে লড়াই করে নিজেদের স্বাধীনতা হাসিল করে। আমেরিকার স্বাধীনতা হাসিল করার একশ বছর পর ‘রাজার স্বর্গীয় অধিকার’ এই নীতি থেকে বন্ধন মুক্ত হয়ে কাগজে কলমে তারা প্রজাতন্ত্র কায়েম করে ইংল্যান্ডের শ্রেণী প্রথাকে ঘৃণ্য বর্ণাশ্রম অ্যাখ্যা দেয় সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠার আশায়। ওয়াশিংটন লিংকনের মতো গণতন্ত্রের সমর্থক বড় বড় মনীষী তখন রাষ্ট্রের নেতৃত্ব দিচ্ছিল। তবু তারা সুখ শান্তির মুখ দেখছিল না। গৃহযুদ্ধে ও নিগ্রোযুদ্ধে মার্কিন তখন মুল্লুক ক্ষত-বিক্ষত, রক্তাক্ত। ইংরেজরা তাদের দুর্দশা দেখিয়ে বিজ্ঞের মত মাথা ঝুকিয়ে ঝুকিয়ে বলতে থাকলো, বুঝ স্বাধীনতার ঠেলা এইবার।
কেন এমন হচ্ছে? কেউ বলতে পারে না, কেউ বুঝতে পারে না। ঊনিশ শতকের মাঝামাঝি পথের সন্ধান দেন ইমার্সন নামের একজন। তিনি জাতীয় সত্তা ও স্বকীয়তার দিকে মার্কিনীদের উদাত্ত আহবান জানালেন। তিনি অবিশ্রান্ত কলম চালিয়ে এবং যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন রাষ্ট্রে বক্তব্যে মার্কিনীদের যা বললেন তার মুল কথা একটি: ‘স্বকীয়তা ধর। অনুকরণ ছাড়। অনুকরণ আত্মহত্যার শামিল। স্বকীয়তাতেই মুক্তি’।
ইমার্সনের এই সাবধান বানীর গুরুত্ব বুঝতে মার্কিনবাসীদের আরো ৫০ বছর সময় লেগে গেল। বিশ শতকের গোড়ার দিকে তারা বুঝতে পারলো, ইংরেজদের থেকে তারা রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা হাসিল করেছে বটে কিন্তু কৃষ্ট-সাহিত্যে তারা আজো ইংল্যান্ডের অনুকারী-অনুসারী ছায়া মাত্র।
মার্কিনীদের ধর্ম ইংল্যান্ডের খ্রিষ্টান ধর্ম। তাদের কৃষ্টি-ঐতিহ্যও ইংরেজী। কাজেই কি ভাষায় কি ধর্মে কি কৃষ্টিতে কি ঐতিহ্যে কোন দিক দিয়ে মার্কিনীদের ইংরেজদের হতে স্বতন্ত্র সত্তার কোনও যুক্তি ছিল না। দৃশ্যত কোন আবশ্যকতাও ছিল না। মার্কিন মুল্লুক ছাড়াও আরও অনেক দূর দেশে ইংরেজ জাতি উপনিবেশ স্থাপন করেছে। বাড়ির পাশে ঐ কানাডীয়রাও তো তাই। তারা কিন্তু ইংল্যান্ডের রাজার অধীনতা ছিন্ন করে নাই। তাহলে মার্কিনীরা করলো কেন?
মার্কিনীরা উপলব্ধী করলো ইংরেজদের অনুকরণ বর্জন করতে হবে। এই লক্ষ্যে বিশ শতকের গোড়ায় দিকে কতিপয় সাহিত্যিক মার্কিনীদের কৃষ্টিক স্বকীয়তায় উদ্বুদ্ধ করতে শুরু করেন। তারা বলতে থাকলো, ইংরেজদের কৃষ্টিক বন্ধন হতে মুক্তি পেতে হলে মার্কিনবাসীকে আগে ইংরেজী ভাষা ও সাহিত্যের কবল হতে মুক্ত হতে হবে।
ইংরেজী শুধু অধিকাংশ মার্কিনীদের ভাষা নয় বরং দুনিয়া জোড়া সমস্ত বৃটিশ উপনিবেশের সাধারণ ভাষা। বিশ্বের সবচেয়ে সমৃদ্ধশালী প্রসারণবাদী ভাষা ইংরেজী। ইংরেজী সাহিত্য দুনিয়ার ইংরাজীভাষী ভুখন্ডেরই শুধু নয় সারা দুনিয়ারই প্রেরনাদাতা আদর্শ সাহিত্য। ইংল্যান্ডের ধর্ম খ্রিষ্টানিটির ও ইংল্যান্ডের ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী হয়ে সেই ইংরাজী ভাষা ও সাহিত্যের কবল হতে মুক্তির আশা দৃশ্যতই অবাস্তব কল্পনা। কিন্তু মার্কিনবাসী অতি অল্পদিনেই এই অবাস্তব কল্পনাকে বাস্তব সত্যে পরিনত করে।
ইংল্যান্ডের ইংরেজী থেকে মার্কিনীরা মুক্তি চেয়েছিল এ কথার অর্থ এই নয় যে, তারা তাদের পৈত্রিক সাহিত্য ও ঐতিহ্যের প্রতি অশ্রদ্ধা দেখিয়েছে। এটা তাদের কৃষ্টিক সাহিত্যের স্বকীয়তার দাবি। যা ছিল তাদের বেঁচে থাকার তাগিদ। তারা ইংরেজীর বদলে অন্য ভাষা গ্রহন করতে চায়নি। তারা চেয়েছিল ইংরেজী ভাষা সাহিত্যের মধ্যে মার্কিনী প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতে। ইংরেজী ভাষা ও সাহিত্যে মার্কিনী অনুভূতি ঝংকৃত করতে। ইংরেজীকে করতে চেয়েছিল মার্কিন জনগনের মুখের ভাষা।
কিন্তু কেমন করে? তাদের যুক্তি ছিল, ইংরেজী হরফ ও ইংরেজী শব্দই ব্যবহার করবে কিন্তু ইংরেজী শব্দের উচ্চারণ তাদের ইংরেজী শব্দের মানে হবে মার্কিনী। ইংরেজী ভাষায় অগনিত শব্দ সম্পদ রয়েছে সত্য কিন্তু তারা ইংল্যান্ডেই বিচরণ করে। তারা সেসব শব্দকে মার্কিন মুল্লুকের কর্কশ কঠোর মাটিতে নামিয়ে আনবে। এই মাটির মাঠে-ঘাটে তারা তাদের নিয়ে খেলা করবে। তাদের ঘনিষ্টভাবে আপন করে নিবে। মাতৃভূমিতে আশা নিরাশার নিত্য নতুন যে শব্দ তৈরী হচ্ছে এইসব শব্দ ইংরেজী শব্দের শামিল হবে।
২.
কিন্তু মার্কিনীরা একদিনে তা পারেনি। সহজেও পারার কথাও নয়। আমরা বর্তমানে যে হীনমণ্যতায় ভুগছি মার্কিনীরাও এককালে ভুগেছিল। আমাদের লেখক-সাহিত্যিকরা আজ যেমন আমাদের নিজের ভাষায় স্থলে পশ্চিম-বাংলার ভাষাকেই অধিকতর সভ্য, ভদ্র, শালীন ও সাহিত্যের উপযোগী ভাষা করেন, এককালে মার্কিন লেখক-সাহিত্যিকরাও ইংল্যান্ডের ইংরেজীকে তাই মনে করতো। পুরো ঊনিশ শতক ধরে, এমন কি বিশ শতকের প্রথম ভাগেও মার্কিন লেখক-সাহিত্যিকদের এই মনোভাব বিদ্যমান ছিল। এটা অভ্যাসের দোষ। পরাধীনতার রেশ। সদ্য স্বাধীনপ্রাপ্ত লোকেরা যেমন নিজেদের দেশের শিল্পজাত দ্রব্যের চেয়ে বিদেশী জিনিসকে অধিকতর সস্থা ও সুন্দর মনে করে, নিজেদের মাতৃভাষার স্থলে পরের ভাষাকেই তাই মনে করে। মার্কিনীদের এহেন অবস্থা দেখে তখন ফরাসী রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এলেক্সি মন্তব্য করেছিলেন, ‘মার্কিন লেখকরা আমেরিকায় বাস করেন না, তারা বাস করেন ইংল্যান্ডে। তারা ইংরেজ লেখকদের ভাষাকেই মডেল মনে করেন।’ খোদ মার্কিন পন্ডিত হেনরি ক্যাবট লজ তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘স্টাডিম-ইন-হিস্ট্রি’তে লিখেছেন, ‘যেসব আমেরিকান সাহিত্য ক্ষেত্রে প্রবেশ করতে চান, নিজেদের মার্কিন পরিচয় গোপন করে ইংরেজ হওয়ার ভান করাই তাদের প্রথম পদক্ষেপ। এটা তাঁদের করতে হয় ইংল্যান্ডের সাহিত্যিকদের প্রশংসা পাওয়ার জন্য নয়, নিজের দেশবাসীর স্বীকৃতি পাওয়ার জন্যই।’
উপরোক্ত দুই পন্ডিত ব্যক্তি ঊনিশ শতকের মার্কিন লেখক-সাহিত্যিকদের সম্বন্ধে যা বলেছেন, আমাদের দেশের বর্তমান লেখক সাহিত্যিকদের সমন্ধে তা হুবুহু সত্য। এদেরও মডেল পশ্চিম-বংগের কথ্য ভাষা। এরাও মনের দিক হতে বাস করেন পশ্চিম-বংগে, পূর্ব-বাংলায় নয়। এরা যেন সত্য সত্যই বিশ্বাস করেন পশ্চিম-বংগের কথ্য ভাষায় না লিয়ে পূর্ব-বাংলার কথ্য ভাষায়, এমন কি শুদ্ধ বা কেতাবী ভাষায়, বই লিখলে পূর্ব-বাংলার পাঠকরা তা ক্রয় করবে না, পূর্ব-বাংলার সাহিত্য সমাজে তা স্বীকৃতি পাবে না। ধারণাটা একেবারে ভিত্তিহীন নয়। আমাদের নাট্যকারদের কারো কারো মুখে শুনা যায়, তারা তাদের নাটকের চরিত্রগুণের মুখে পূর্ব বাংলার ডায়ালেক্টের বদলে পশ্চিম বাংলার ডায়ালেক্ট দেন এই কারণে যে নামযাদা অভিনেতারা পূর্ব বাংলার ডায়ালেক্টে অভিনয় করতে অনিচ্ছুক। অভিনেতাদের জবাব এই যে, পশ্চিম-বাংলার ডায়ালেক্টে অভিনয় করতে-করতে ওটাই তাদের মুখে সহজে আসে। তাদের কথাও ফেলে দেয়া যায় না। আমাদের অধ্যাপক শিক্ষক, অফিসার-কেরানী, ব্যবসায়ী-নাগরিকদেরও অনেকের কলমে বাংলার চেয়ে ইংরেজীই সহজে বাহির হয়। এটা অভ্যাসের ফল।
এটাই চলেছিল আমেরিকায় পুরো দেড়শ বছর। আমাদের আজকালরা মঞ্চ-সিনেমা, রেডিও-টেলিভিশনের মতোই মার্কিন মুল্লুকেরও ঐসব ক্ষেত্রে মার্কিন ইংরেজীর বদলে বিলাতী ইংরেজী চলেছিল বিশ শতকের তৃতীয় দশকের শেষ পর্যন্ত। বিখ্যাত ভাষা বিজ্ঞানী ডা. হেনরি এল, ম্যানকন তার বিশাল গ্রন্থ ‘আমেরিকান ল্যাংগুয়েজ’-এ লিখেছেন, ‘এমন এক সময় ছিল যখন সমস্ত মার্কিন অভিনেতারা লন্ডনের ওয়েস্টএন্ডের ডায়লেক্টে অভিনয় করতেন। কঠোর অধ্যাবসায়ে তারা ও রেডিও-টেলিভিশনের সংবাদ পাঠকরা ঐ ভাষা ও উচ্চারন শিখতেন। সে উদ্দেশ্যে বহু স্কুল স্থাপিত হয়েছিল। হলিউডের চলচিত্র-শিল্প ও বিভিন্ন ব্রডকাষ্টিং স্টেশনের সাহসিকতায় ১৯৩১ হতে ১৯৩৯ সালের মধ্যে ঐ প্রথার অবসান হয়।’
ইংরেজী সাহিত্য যতই সমৃদ্ধ হোক, ইংরেজী ভাষা যতই বিপুল বিশাল হোক, তার প্রভাব যতই শক্তিশালী হোক, ইংরেজের কৃষ্টি যতই সর্বগ্রাসী হোক, তাদের সাম্রাজ্য যতই শক্তিশালী হোক, স্থান ও কালের এই দুর্বার দাবির নিকট সকলের নত হতে হলো। ইংল্যান্ডের শান্তশীতল আবহাওয়া হতে, বিশ্ব-শাসক ইংরেজের আভিজাত্যের প্রসাদ হতে, ইংরেজী ভাষাকে নেমে আসতে হলো মার্কিন মুল্লুকের রক্ষ শক্ত মাটিতে। আভিজাত্যের শুভ্র পরিচ্ছন্নতা শালীনতা অক্সনিয়ান সাধুতা আর তার থাকলো না। তার গায় মার্কিন মুল্লুকের কাদা-মাটির ময়লা লাগলো। ‘কয়েদীর জাত’ মার্কিন চাষা ও কুলির মুখের ‘অভদ্র ‘ ভাষা ইংরেজী ভাষা হলো। তকে আর সাহিত্যে আপাংক্তেয় রাখা গেল না।
৩.
এবার আসি, মার্কিন জাতির সাথে আমাদের অবস্থার তুলনা করা যাক।
আমরা পূর্ব-বাংগালীরা পশ্চিম-বাংগালী পৃথক হয়ে একটা স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের নাগরিক হয়েছি। এখানে মার্কিনবাসীর সাথে আমাদের পুরোপুরি মিল রয়েছে। পূর্ব ও পশ্চিম-বাংগালীদের ভাষা এক, হরফ এক। আমাদের উভয়ের সাহিত্যিক ঐহিত্যও এক। রবীন্দ্রনাথ শরৎচন্দ্র নজরুল ইসলাম সত্যেন দত্ত উভয় বাংলার গৌরবের ও প্রেরণার বস্তু। ইংরেজ ও মার্কিন জাতিরও এক ভাষা এক হরফ। একই ইংরেজী সাহিত্য একই মিলটন শেক্সপিয়ার উভয় জাতির গৌরব ও প্রেরণার বস্তু। এখানেও আমাদের সাথে মার্কিনীদের অবস্থার পুরো মিল রয়েছে।
দেশ বিভাগের আগেই বাংলা সাহিত্য বিশ্ব-সাহিত্যের দরবারে স্থান পায়। গল্পে কবিতায় বিজ্ঞানে দর্শনে সমৃদ্ধশালী হয়েছে। বাংগালী কবি বাংলা কবিতার জন্য নোভেল প্রাইজ পেয়েছেন। মার্কিনী স্বাধীনতার আগেই তেমনি ইংরেজী সাহিত্য ও বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যে উন্নীতে হয়েছে। ইংরেজী সাহিত্য বিশ্বের কৃষ্টি-শিল্পের বাহন ও বিশ্ববাসীর প্রেরণার উৎস হয়ে উঠেছে। পূর্ব বাঙ্গালীর পক্ষে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যের প্রভাব হতে মুক্ত হওয়া যেমন কঠিন, মার্কিন জাতির পক্ষেও শ্রেক্সপিয়ারের ইংরেজী সাহিত্যের প্রভাব হতে মুক্ত হওয়া ছিল তেমনি কঠিন। সুতরাং এ ব্যাপারেও মার্কিন জাতির সমস্যার সাথে পূর্ব-বাংগালীর সাহিত্যিক সমস্যার হুবুহু মিল রয়েছে।
মার্কিন জাতি ইংরেজী সাহিত্যের প্রভাব-মুক্ত হয়ে জাতীয় স্বকীয়তা-ভিত্তিক নিজস্ব সাহিত্য সৃষ্টির তাগিদ অনুভব করেছিল যে কারণে, সেটা ধর্মীয় বা ঐতিহ্যিক তাগিদ ছিল না। পুরোপুরি কৃষ্টির তাগিদও ছিল না। কারণ ইংরেজ জাতির মতো মার্কিন জাতির ধর্মও ছিল খ্রিষ্টান এব চার্চও ছিল বিলাতী। ধর্ম-ভিত্তিক কৃষ্টিও ছিল তেমনি তাদের অবিভাজ্য। সুতরাং স্বকীয়তা ও নিজস্বতা তাগিদ ছিল তাদের নিছক রাষ্ট্রীয় স্বতন্ত্র সত্তার তাগিদ। ধর্মে ঐতিহ্যে ও কৃষ্টিতে মুলত মার্কিন ও ইংরেজ এক গোত্রীয় হলেও রাষ্ট্রীয় ও ভৌগলিক সত্তায় মার্কিনীরা ছিল ইংরেজ হতে সম্পূর্ণ আলাদা। একমাত্র এই রাষ্ট্রীয় সত্তার তাগিদেই তারা উপলব্দী করেছিল, কৃষ্টিক ভাষিক ও সাহিত্যিক স্বকীয়তা ছাড়া রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা রক্ষা বিকাশ ও প্রসার অসম্ভব।
এ ব্যাপারে মার্কিন জাতির সাথে পূর্ব-বাংলার মিল তো আছেই, বরঞ্চ বেশি তাগিদ আছে। অধিকার ও আবশ্যকতাও আছে বেশি।
৪.
ইংরেজ ও মার্কিন জাতির ধর্মীয় কৃষ্টিক ঐতিহ্যেক অবিভাজ্যতা ছিল মার্কিনী স্বকীয়তার পথে বাধা। আমাদের পথে বাধা নেই। পূর্ব ও পশ্চিম-বাংলার মধ্যে ধর্ম কৃষ্টি ও ঐতিহ্যের ব্যাপারে কোনও অবিভাজ্যতা নাই। এইখানে মার্কিনীদের সাথে পূর্ব-বাংলার কোন মিল নেই। এ অমিল আমাদের সমাধান সহজতর করেছে।
মার্কিন জাতি যখন স্বাধীন হয় এবং তারা যখন কৃষ্টিতে ভাষায় ও সাহিত্যে তাদের স্বকীয়তা প্রতিষ্ঠার উদ্যম শুরু করে, তখন তাদের নিজস্ব কৃষ্টি ভাষা ও সাহিত্য বলে কিছু মিল ছিল না। রাষ্ট্রীয় স্বাধীন সত্তার প্রয়োজন পৃথক জাতীয়তার তাগিদে তারা সৃষ্টি ও নির্মান শুরু করে একেবারে ‘কিছু না’ হতে। ‘কিছু না’ হতেই আজ তারা একটা আত্মমর্জাদাবান জাতি, একটা বিপুল কৃষ্টি, একটা সমৃদ্ধশালী সাহিত্য সৃষ্টি করেছে।
এখানে মার্কিন জাতির সমস্যার সাথে আমাদের মিল নেই। দেশ বিভাগের সময় আমাদের নিজস্ব ভাষা, ইতিহাস, নিজস্ব ঐতিহ্য ও নিজস্ব কৃষ্টি ছিল এবং আছে। কাজেই আমাদেরকে ‘কিছু না’ হতে শুরু করতে হবে না। আমাদের সমস্যা মার্কিন জাতির সমস্যার মতো কঠিন নয়। আমাদের অবস্থা তাদের মতো নৈরাশ্যজনকও নয়।
আমাদের বর্তমান কৃষ্টি ঐতিহ্য ইতিহাসকে বুনিয়াদ করে অনেক সহজে আমরা নিজস্ব জাতীয়তা ও স্বকীয়তা সাহিত্য সৃষ্টি করতে পারি। স্বকীয়তার মর্যাদাবান পুর্ব-বাংলার সাহিত্যে ভাষঅয় ব্যকরণে অভিধানে আমরা এমন উন্নতি সাধন করতে পারি, যা পশ্চিম বাংলার অনুকরণ অনুসরনের যোগ্য হতে পারে।
ইংরেজী ভাষার সংস্কারে মার্কিনী প্রচেষ্টাকে ইংরেজরা গোড়ায় যতই কুনজরে দেখে থাকুক না কেন, এখন সে সংস্কারের অনেকগুলি ইংরেজদের কাছে গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হচ্ছে। (চলবে)
(তথ্যসূত্র: বাংলাদেশের কালচার: আবুল মনসুর আহমদ, পৃষ্ঠা: ৪৭-৫২)
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা মে, ২০১৬ বিকাল ৪:৫৭