somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কোলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী– পর্ব ৪

২১ শে জানুয়ারি, ২০১৬ রাত ১০:৫৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


সরকারী ছুটি ৫৩ দিন, ছিল না কোন মুসলিম উৎসব !!

বর্ণ হিন্দু সুবর্ণ শ্রেণীকে সন্তুষ্ট করতে ইংরেজরা যে সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় উৎসবের ছুটি ঘোষনা। ১৭৮৬ খ্রিষ্টাব্দে লর্ড কর্ণওয়ালিশ গভর্ণর থাকাবস্থায় কোলকাতা কেন্দ্রিক বর্ণহিন্দু সুবর্ণ শ্রেণীকে সন্তুষ্ট করার লক্ষ্যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ থেকে কোম্পানির জারিকৃত ৫৩ দিনের সরকারি ছুটির ঘোষনা করে এবং তা শুধুই হিন্দুদের ধর্মীয় উৎসব কেন্দ্রিক ছিল। বর্ণ হিন্দু বুর্জোয়াদের খুশি করতে সরকারি ছুটি ৫৩ দিন ঘোষনাও করা হলেও এই ৫৩ দিন ছুটির তালিকায় বাঙালি মুসলমানদের জন্য কোন ধর্মীয় ছুটির উল্লেখ ছিল না।

ছুটির তালিকা নিম্নরূপ:

অক্ষয় তৃতীয়া (১দিন), নৃসিংহ চতুর্দশী (২দিন), জৈষ্ঠ্যের একাদশী (২দিন), স্নান যাত্রা (১দিন), রথযাত্রা (১দিন), পূর্ণ যাত্রী (১দিন), জন্মাষ্টমী (২দিন), শয়ন একাদশী (১দিন), রাখী পূর্নিমা (১দিন), উত্থান একাদশী (২দিন), অরন্ধন (১দিন), দুর্গাপুজা (৮দিন), তিলওয়া সংক্রান্তি (১দিন), বসন্ত পঞ্চমী (১দিন), গণেশ পূজা (১দিন), অনন্ত ব্রত (১দিন), বুধ নবমী (১দিন), নবরাত্রি (১দিন), লক্ষীপুজা (১দিন), অন্নকুট (১দিন), কার্তিক পূজা (১দিন), জগদ্ধাত্রী পূজা (১দিন), রাস যাত্রা (১দিন), অগ্রহায়ন নবমী (১দিন), রটন্তী অমাবশ্যা (২দিন), মৌনী সপ্তমী (১দিন), ভীমষ্টমী (১দিন), বাসন্তী পূজা (৪দিন), শিবরাত্রি (২দিন), দোলযাত্রা (৫দিন), বারুনী (১দিন), চড়ক পূজা (১দিন) এবং রামনবমী (১দিন)।

এমনি এক অবস্থায় লন্ডনের কমন্স সভা থেকে নির্দেশ এলো ভারতে বিরাজমান নাজুক পরিস্থিতিতে ইংরেজদের পক্ষে এমন কোন সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত হবে না যাতে ইংরেজদের পরীক্ষিত এবং একান্ত অনুগত কোলকাতা কেন্দ্রিক বাঙালি বর্ণ হিন্দুদের স্বার্থহানি ঘটে। লন্ডনের কমন্স সভায় যখন খ্রিষ্টধর্ম প্রচারের প্রস্তাব করা হলো তখন সিদ্ধান্ত নেয়া হলো ধর্ম প্রচারের অনুমতি যাতে দেয়া না হয়। কেননা ইংরেজ শাসিত এলাকায় খ্রিষ্টধর্ম প্রচারের অনুমতি প্রদান করা হলে কোলকাতা কেন্দ্রিক ধর্মভীরু বাঙালি বর্ণ হিন্দুদের জন্য নিশ্চিতভাবে মনোকষ্টের কারণ হবে এবং আনুগত্যে ঘাটতি দেখা দিতে পারে। তাই ইংরেজরা নিজেদের ধর্মীয় স্বার্থের উর্দ্ধে সাম্রাজ্যের স্বার্থকে স্থান দিলেন। কমন্স সভায় এই মর্মে আইন পাস হলো, আপাতত ১৮১৩ খ্রিষ্টাব্দ অবধি ভারতে ইংরেজ শাসিত এলাকায় খ্রিষ্টান মিশনারিরা খ্রিষ্টধর্ম প্রচার করতে পারবে না। ইতিমধ্যে যারা খ্রিষ্টধর্ম প্রচারের জন্য ভারত বর্ষে এসেছিলেন তাদেরকে বিতাড়িত করা হয়। যারা চুপচাপ থেকে গিয়েছিল তারা বসে না থেকে বিভিন্ন ভারতীয় ভাষা, বিশেষ করে বাংলা ভাষাকে সম্পুর্ণভাবে রপ্ত করা ছাড়াও বাংলা ভাষায় বাইবেল অনুবাদের কাজ সম্পন্ন করে। এরই ফলে উপমহাদেশে নবাগত ইংরেজ কর্মচারীদের বাংলাভাষা শিক্ষা এবং স্থানীয় সংস্কৃতি ও লোকাচার সমন্ধে জ্ঞানদানের লক্ষ্যে ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দে কোলকাতা লালবাজারের কাছে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ স্থাপিত করা হয় কিন্তু শর্ত জুড়ে দেয়া হয় খ্রিষ্টধর্ম প্রচার করা যাবে না।

অপরদিকে বাঙালি মুসলমানরা প্রথম থেকেই ইংরেজবিরোধী কর্ম পদ্ধতিতে লিপ্ত থাকায় সুবর্ণ শ্রেণী এবং নব্য জমিদার গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হতে সক্ষম হয়নি। ইংরেজ শিক্ষার মাধ্যমে বাঙালি মুসলিম মধ্যবিত্ত সমাজ গঠনের প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা গেলেও তার গতি ছিল মন্থর। পক্ষন্তরে হিন্দু সমাজের উচ্চস্তর থেকে আধুনিক বাঙালি এলিটদের উদ্ধব হয়। আর এই এলিটগোষ্ঠি ধর্ম সংস্কার ও সমাজ সংস্কার আন্দোলন হিন্দু সমাজ কেন্দ্র করেই গড়ে উঠে। ব্রিটিশের ক্রমবর্ধমান প্রশাসন যন্ত্রের নিম্ন শ্রেণীর চালক ও কর্মচারী সরবরাহের্ জন্য যে আধুনিক ইংরেজি শিক্ষা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধির প্রবর্তন করা হয়েছিল, তা হিন্দুরাই বেশি আয়ত্ত করেছিলেন বলে এই স্তরের চাকরিজীবীদের মধ্যে শিক্ষিত বাঙালি হিন্দুদের প্রাধান্য ছিল। ধনিক ও মধ্যবিত্তের স্তরে বাঙালি হিন্দুদের সঙ্গে বাঙালি মুসলমানদের বিচ্ছেদ তো হয়েছিলই, শিক্ষিত এলিটদের স্তরেও ঘটেছিল। তাই আধুনিক জাতীয়তাবোধের উন্মেষ ও ক্রমবিকাশ ঘটেছিল মুলত হিন্দু জাতীয়তাবাদকে কেন্দ্র করে।

এরপর বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্ত শ্রেণী গঠনের লক্ষ্যে সত্যিকার অর্থে ইংরেজি ভাষা শিক্ষা ও ইউরোপীয় কালচারকে রপ্ত করার যখন প্রক্রিয়া শুরু হলো, তখন মুসলিম সমাজ সংস্কারক ও সংস্কারপন্থী নেতৃবৃন্দের দায়িত্ব পালন অত্যন্ত দুরহ ছিল। কারণ, ইংরেজ শাসনামলের ১৯০ বছরের ১৫৫ বছরই ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী ছিল কোলকাতা মহানগরীতে। তৎকালিন সময়ের সবচেয়ে অগ্রসরমান বাঙালি হিন্দু বুর্জোয়া শ্রেণীর শক্তিশালী দুর্গ ছিল কোলকাতা। কোলকাতা কেন্দ্রিক এই বাঙালি হিন্দু বুদ্ধিজীবী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণী রাজশক্তির সম্পুরক হিসেবে যে কেবলমাত্র বঙ্গীয় প্রদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ অপর সম্প্রদায়কে কোণঠাসা করে রেখেছিল তাই নয়, উপমহাদেশের পূর্বাঞ্চল এবং উত্তর এলাকার অন্যান্য প্রদেশের সকল ধর্ম, বর্ণ ও ভাষাভাষীর জন্য প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাড়িয়েছিল।

শিক্ষাক্ষেত্রে ভয়াবহ দুরবস্থার চিত্র

১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দে যখন কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম স্থাপিত হলো তখন ম্যাট্রিক পরীক্ষার্থী ছিল মাত্র ২৪৪ জন। ১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ এর সংখ্যা প্রায় ৩৫ গুন বেড়ে দাড়াল ৩০০০ জন এবং এর প্রায় সবাই হচ্ছেন বাঙালি উচ্চবর্ণের হিন্দু। ১৮৫৮ সালে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বিএ পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল মাত্র ১৩ জন। ২৩ বছরের ব্যবধানে ১৮৮১ সালে গ্রাজুয়েটের সংখ্যা হচে।ছ ১৭১২। এর মধ্যে ১৪৮০ জনের মতো বাঙালি বর্ণহিন্দু। বাকিদের মধ্যে বিহারী, আসামী, ওড়িয়া এবং বাঙালি মুসলমান। ১৮৮১ সাল নাগাদ উপমহাদেশের সমস্ত প্রদেশের একত্রিত হিসাব এমএ পাস মোট শিক্ষিত লোক ছিল ৪২৩ জন। এর মধ্যে ৩৪০ জনের মতো বাঙালি হিন্দু।

অপরদিকে বিহার এলাকার সবগুলো কলেজের ছাত্র ছিল ২০৫ জন যেখানে কোলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র সংখ্যা ছিল ৫৬১ জন। উড়িষ্যার অবস্থা ছিল আরো শোচনীয়। এক খতিয়ানে দেখা যায়, ১৯০৫ সালে কটকের বিখ্যাত রাভেন্শ কলেজ থেকে বিএ পরীক্ষার্থী ছিল মাত্র ২ জন। উড়িষ্যার বালেশ্বর গভর্নমেন্ট ইংরেজি স্কুল থেকে যে একজন মাত্র ছাত্রকে এন্ট্রান্স পরীক্ষা দেওয়ার জন্য কোলকাতায় পাঠানো হয়েছিল, অবাক করা বিষয় হচ্ছে, তিনি ছিলেন একজন বাঙালি হিন্দু। নাম রাধানাথ রায়। পরবর্তীকালে ইনিই হচ্ছেন রায় রাধানাথ রায় বাহাদুর। উড়িষ্যাবাসীদের সন্তুষ্টির জন্য এর পরিচয় হচ্ছে উৎকল নিবাসী বঙ্গীয় কায়স্ত। প্রথমে বাংলায় এবং পরবর্তীতে ওড়িয়া ভাষায় কবিতা রচনা করে রাধানাথ বাবু বিখ্যাত হয়ে রয়েছেন।

আসামের অবস্থাও ছিল ভয়ংকর। সমগ্র আসামে একটি মাত্র আর্টস কলেজ ছিল। ছাত্র সংখ্যা মাত্র ৩০ জন। অথচ কোলকাতায় ইংরেজি শিক্ষার জন্য হিন্দুকলেজ স্থাপিত হয়েছিল এর ৮২ বছর আগে কোলকাতা কেন্দ্রিক বাঙালি বর্ণহিন্দুরা এর পূর্ণ সুবিধা আদায় করে নেয়। মুলত এরা বঙ্গীয় এলাকার মুসলিম সম্প্রদায়কে বঞ্চিত করা ছাড়াও বিহার, উড়িষ্যা ও আসামের সর্বত্র ইংরেজ ছত্রচ্ছায়ায় ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিল। (চলব)
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জানুয়ারি, ২০১৬ রাত ১০:৫৮
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পাশ্চাত্যের তথাকথিত নারীবাদ বনাম ইসলাম: বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একটি সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ

লিখেছেন নতুন নকিব, ০৩ রা মে, ২০২৫ বিকাল ৪:২৪

পাশ্চাত্যের তথাকথিত নারীবাদ বনাম ইসলাম: বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একটি সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ

ছবি কৃতজ্ঞতা এআই।

ভূমিকা

নারীর অধিকার নিয়ে আলোচনা ইতিহাসের এক দীর্ঘ অধ্যায়। পাশ্চাত্যে নারী আন্দোলন শুরু হয় ১৮শ শতকের শেষভাগে, যার ফলশ্রুতিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি স্মার্ট জাতির অন্তঃসারশূন্য আত্মজৈবনিক !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৩ রা মে, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:৩৪


একটা সময় ছিল, যখন জাতির ভবিষ্যৎ বলতে বোঝানো হতো এমন এক শ্রেণিকে, যারা বই পড়ে, প্রশ্ন তোলে, বিতর্কে অংশ নেয়, আর চিন্তা করে। এখন জাতির ভবিষ্যৎ মানে—ইনফ্লুয়েন্সার। তারা সকাল ১০টায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ক্ষমতায় যাবার আগেই নারী বিদ্বেষ শুরু

লিখেছেন অপলক , ০৩ রা মে, ২০২৫ রাত ১০:১১

সংবাদ সম্মেলন থেকে বের করে দেওয়া হলো নারী সাংবাদিককে, যা বললেন মুফতি ফয়জুল করিম

বরিশালে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সিনিয়র নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করিমের এক নারী সাংবাদিক মনিকা চৌধুরীকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইসলামী দলগুলো নারী বিদ্বেষী - এটা একটি মিথ্যা প্রোপাগান্ডা

লিখেছেন সত্যপথিক শাইয়্যান, ০৩ রা মে, ২০২৫ রাত ১১:২৯

আরবের দেশগুলোকে আমাদের দেশের নারী আন্দোলনের নেত্রীরা দেখতে পারেন না হিজাব ইস্যুর কারণে। অথচ, আরব দেশ কাতার বি,এন,পি'র চেয়ারপারসনকে চার্টারড প্ল্যানে করে দেশে পাঠাচ্ছে। আরো কিছু উদাহরণ দেই। আওয়ামী লীগ... ...বাকিটুকু পড়ুন

নারীনীতি ইস্যুতে তথাকথিত চুশীলদের নিয়ে কিছু কথা

লিখেছেন নতুন নকিব, ০৪ ঠা মে, ২০২৫ সকাল ৮:৫৩

নারীনীতি ইস্যুতে তথাকথিত চুশীলদের নিয়ে কিছু কথা



ইদানিং নারীনীতি নিয়ে দেশে নানা তর্ক-বিতর্ক চলছে। আলেম-ওলামা এবং ইসলামপন্থীরা যখন পাশ্চাত্যঘেঁষা নারীনীতির সুপারিশকে দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রত্যাখ্যান করলেন, তখনই মূলত এই আলোচনার বিস্তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×