পলাশীর বিজয়ের পরও ৫৬ বছর বন্ধ ছিল উপমহাদেশে খ্রিষ্টধর্ম প্রচার !!
অবাক করার মত বিষয়, মোগল ও মুসলিম নবাবদের শাসনামলে খ্রিষ্টান ধর্ম প্রচারের অনুমতি থাকলেও ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে লর্ড ক্লাইভের নেতৃত্বে ইংরেজদের বিজয়ের পর থেকে প্রথম ৫৬ বছর অর্থাত ১৮১৩ সাল পর্যন্ত এদেশে খ্রিষ্টধর্ম প্রচার নিষিদ্ধ বেআইনী ছিল !!
ইংরেজ জাতির ইতিহাস পাঠ করলে দেখা যায়, কয়েক শত বছর ধরে সমগ্র বিশ্বের পাঁচটি মহাদেশের বিশাল ভুখন্ডে এবং অগনিত রাজ্য ইংরেজদের করতলগত হলে সর্বত্রই তারা দলে দলে ইংরেজ খ্রিষ্টান পাদ্রীদের খ্রিষ্টধর্ম প্রচারে লিপ্ত হয়েছিল। কিন্তু ১৮১৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্ন্তো ইংরেজ শাসিত বঙ্গীয় তথা পূর্ব ভারতীয় এলাকার জন্য কেন বতিক্রমধর্মী ব্যবস্থা?
উপমহাদেশে ইংরেজ রাজশক্তির ধর্মীয় বিশ্বাস খ্রিষ্টধর্ম এবং খ্রিষ্টান মিশনারিদের প্রচেষ্টায় ইংরেজি শিক্ষার প্রসার ও প্রচারটা কবে থেকে আর কিভাবে শুরু হয়েছিল আমরা অনেকেই জানি না।
১৭৯৩ সাল সরাসরি ব্রিটেনের রানী কর্তৃক সনদপ্রাপ্ত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ভারতবর্ষ শাসন করছিল নতুন করে আবার ২০ বছরের জন্য নবায়ন করতে গেলে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট কমন্সসভায় তুমুল বাকবিতন্ডার সৃষ্টি হয়। ভারতে কেন শুধু ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী বাণিজ্য করবে যেখানে ঐ কোম্পানীর থেকে বেশি মুলধনী কোম্পানী রয়েছে যারা কেন সেই অধিকার পাবে না। ব্রিটিশ সরকারে তখন খ্রিষ্টান রক্ষণশীল টোরী পার্টি ক্ষমতাসীন ছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর সাথে টোরী পার্টির দহরম মহরম ও অকল্পনীয় প্রভাব বিরাজমান ছিল। তাছাড়া ভারত উপমহাদেশে ইংরেজ রাজত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত করতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী বেশ ভালো ভুমিকা রাখায় ১৮৯৩ সাল পর্যন্ত ভারতে একচেটিয়া বাণিজ্যের আইনসঙ্গত অধিকার লাভ করে। তার আগে থেকেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী লুটপাটের নিমিত্তে কিছু এজেন্সি হাউজ নিয়োগ দেয়। এজেন্সি হাউজগুলো সাধারণত তিন-চার জন করে অংশীদার থাকত এবং সকলেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর কর্মচারী। হাউজগুলো প্রতিষ্ঠার সময় অংশীদারদের নিজেদের কোন মুলধন ছিল না, কোম্পানীর কর্মচারীদের আমানত থেকে মুলধন সংগ্রহ করা হতো। এ দেশীয় ধণিক বণিকরাও এইসব হাউজে অর্থ জমা রাখতো। এভাবে এজেন্সি হাউজগুলো লাভবান হতে থাকলো (স্কেল অব কমার্শিয়াল রিসোরসেস : লন্ডন ১৮৩৭)
এবার আসা যাক কেন দীর্ঘ ৫৬ বছর ইংরেজরা শাসন করার পরও তাদের ধর্ম প্রচার বন্ধ রাখলো- বিষয়টি বুঝতে হলে আবার প্রসঙ্গে ফিরে যেতে হবে, তখন এজেন্সিগুলো ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর এজেন্ট হিসেবে কাজ করতো এবং মধ্যস্বত্বভোগী হিসেবে মুনাফা অর্জন করতো। এজেন্সি হাউজগুলোর দায়িত্ব ছিল দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে পণ্য সংগ্রহ করা আর এই কাজটি অর্ডারের ভিত্তিতে দেয়া হয় এদেশীয় কিছু কোম্পানীকে যাদের বলা হয় বেনিয়ান। আশ্চর্জের বিষয়, কোলকাতা কেন্দ্রিক সবগুলো বেনিয়ান প্রতিষ্ঠানই ছিল বাঙালি বর্ণ হিন্দু মালিকানায়। আর ইংরেজদের মন জয় করতে বর্ণ হিন্দুরা নেমে যায় প্রতিযোগীতায় কে কত নতজানু হতে পারে বিনা পুজিতে বড় লোক হওয়া বিদেশী কোম্পানীর মালিক কর্মকর্তাদের কাছে।
পশ্চিম বাংলার বিশিষ্ট গবেষক অতুল সুর- এর বক্তব্য ছিল এমন, “হিন্দুর পালা পার্বণে যেখানে ব্রাহ্মণ, আত্মীয় ও স্বজনবর্গ নিমন্ত্রিত হতো, সেখানে হিন্দু বুর্জোয়া শ্রেণী ইংরেজ সাহেবদের অনুগ্রহ লাভের জন্য তাদের সঙ্গে যোগ দিলেন সাহেব-মেমরা। পুজা বাড়িতে তখন প্রবেশ করল বিদেশী সুরা ও নিষিদ্ধ খানা। সঙ্গে সঙ্গে আরও প্রবেশ করল যবনী নর্তকীর দল। শহরে এক নতুন অভিজাত সম্প্রদায়েরে সৃষ্টি হলো। সাহেব মেমরা পালকি চাপা ও হুক্কায় তামাক খাওয়ার একটা বনেদি স্টাইল চালু হলো। এদিকে কোন কোন সাহেব আবার হিন্দু ভাবাপন্ন হয়ে পড়েছিল তাদের মধ্যে হিন্দু স্টুয়ার্ড যে মেজর চার্লস স্টুয়ার্ড নামে পরিচিত ছিল। তিনি প্রত্যেকদিন খালি পায়ে হেটে গঙ্গাস্নানে গিয়ে ব্রাহ্মণ পুরোহিত দিয়ে পুজা করাতেন। তার বাড়িতে বহু হিন্দু দেবদেবীর মুর্তি ছিল।” (আঠারো শতকের বাঙলা ও বাঙালি : সাহিত্যলোক কোলকাতা-৬ এপ্রিল ১৯৮৫, পৃ্ষ্ঠা- ১২৭)
ইংরেজদের সঙ্গে বৈরী ভাবাপন্ন এদেশীয় এক বা একাধিক শক্তি ছিল। বাণিজ্য ও উপনিবেশ একসাথে চালানো তাছাড়া মোগল ও মুসলিম নবাবদের বিশ্বাস করাও সম্ভবপর ছিল না তাদের পক্ষে এবং বাংলা ও বিহার অঞ্চলের মুসলিম এবং নিম্ন শ্রেণীর হিন্দুদের মনের ভাব বোঝাও দুরহ ছিল। এদিকে মারাঠা ও দক্ষিণ ভারতের মুসলিমরা তখন পূনরায় শক্তি সঞ্চয় করতে শুরু করে। এই প্রেক্ষাপটে ধর্ম প্রচার থেকে বিরত থাকে তারা। সেসময় তাদের সহায়ক হিসেবে বর্ণ হিন্দু বুর্জোয়া শ্রেণীকে বেছে নেয়। বর্ণ হিন্দু বুর্জোয়াদের খুশি করতে সরকারি ছুটি ৫৩ দিন ঘোষনাও করা হয়। এই ৫৩ দিন ছুটির তালিকায় বাঙালি মুসলমানদের জন্য কোন ধর্মীয় ছুটির উল্লেখ ছিল না।
কোলকাতা কেন্দ্রিক বাঙালি হিন্দু সুবর্ণ শ্রেণী এবং পরবর্তীতে তাদের উত্তরসূরী বাঙালি হিন্দু উচু সমাজ ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ইংরেজদের জন্য সবচেয়ে নির্ভরশীল সম্পূরক শক্তি। বাঙালি বর্ণ হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে মাত্রাতিরিক্ত ফায়দা আদায় করার জন্য ইংরেজরা তাদের পূর্ণ ব্যবহার করেছে তেমনি বর্ণ হিন্দুরাও তাদের স্বার্থ রক্ষার্থে পিছপা কখনই হয় নি।
ইংরেজরা কোলকাতা কেন্দ্রিক বর্ণ হিন্দুরে উপর এতটাই খুশি ছিল যে ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জারিকৃত ৫৩ দিনের সরকারি ছুটির মধ্যে ছিল শুধুই হিন্দুদের ধর্মীয় উৎসব কেন্দ্রিক। ছুটির তালিকা নিম্নরূপ:
অক্ষয় তৃতীয়া (১দিন), নৃসিংহ চতুর্দশী (২দিন), জৈষ্ঠ্যের একাদশী (২দিন), স্নান যাত্রা (১দিন), রথযাত্রা (১দিন), পূর্ণ যাত্রী (১দিন), জন্মাষ্টমী (২দিন), শয়ন একাদশী (১দিন), রাখী পূর্নিমা (১দিন), উত্থান একাদশী (২দিন), অরন্ধন (১দিন), দুর্গাপুজা (৮দিন), তিলওয়া সংক্রান্তি (১দিন), বসন্ত পঞ্চমী (১দিন), গণেশ পূজা (১দিন), অনন্ত ব্রত (১দিন), বুধ নবমী (১দিন), নবরাত্রি (১দিন), লক্ষীপুজা (১দিন), অন্নকুট (১দিন), কার্তিক পূজা (১দিন), জগদ্ধাত্রী পূজা (১দিন), রাস যাত্রা (১দিন), অগ্রহায়ন নবমী (১দিন), রটন্তী অমাবশ্যা (২দিন), মৌনী সপ্তমী (১দিন), ভীমষ্টমী (১দিন), বাসন্তী পূজা (৪দিন), শিবরাত্রি (২দিন), দোলযাত্রা (৫দিন), বারুনী (১দিন), চড়ক পূজা (১দিন) এবং রামনবমী (১দিন)।
১৭৮৬ খ্রিষ্টাব্দে লর্ড কর্ণওয়ালিশ গভর্ণর থাকাবস্থায় কোলকাতা কেন্দ্রিক বর্ণহিন্দু সুবর্ণ শ্রেণীকে সন্তুষ্ট করার লক্ষ্যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি থেকে এ ধরনের একটি সরকারি ছুটির তালিকা ঘোষনা করা হয়েছিল।
চলবে-
(তথ্যসূত্র- #কোলকাতা_কেন্দ্রীক_বুদ্ধিজীবি)
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জানুয়ারি, ২০১৬ বিকাল ৪:২৫