পবিত্র কুরআনের আলোকে তাক্বলীদের প্রমানঃ
হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মদ জসীম উদ্দীন
মহান আল্লাহ তাআলা মুমিনদের সম্বোধন করে ইরশাদ করেন, অর্থাৎ- “হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা.)এর আনুগত্য কর এবং উলুল আমর (আমীর)এর অনুসরণ কর”। (আলে-ইমরান, আয়াত- ৫)।
আলোচ্য আয়াতে কারীমায় তিনটি বিধান রয়েছে।
যথাঃ-
১। আল্লাহ তাআলার আনুগত্য করা,
২। রাসূলুল্লাহ (সা.)এর আনুগত্য করা,
৩। উলুল আমর (আমীর)এর অনুসরণ করা।
আলোচ্য বিধানসমূহের মধ্যে প্রথম দু’টির ব্যাপারে আহলে ইসলামদের মাঝে কোন মতানৈক্য নেই। কারণ প্রত্যেক মুসলমানের উপর সর্বপ্রথম হুকুম ও কর্তব্য হলো, আল্লাহ তাআলা ও তাঁর রাসূল (সাঃ) এর অনুসরণ ও অনুকরণ করা। তাদের আনুগত্য থেকে বিমুখ হওয়া বিদ্রোহী, নাফরমানী ও ভ্রষ্টতার নামান্তর।
প্রথম দুই বিধান সর্বসম্মতিক্রমে পালনীয় কর্তব্য হওয়ার কারণে আমরা তার আলোচনায় মনোনিবেশ না করে তৃতীয় বিষয়ের আলোচনা পেশ করলাম। কারণ, এবিষয়ে উলামাগণ মতানৈক্য করেছেন।
একথা সর্বসম্মতিক্রমে স্বীকৃত যে, মুসলমানদের উপর মুসলিম আমীরের অনুসরণ করা জরুরী। বিধর্মীদের অনুসরণ করা থেকে নিষেধাজ্ঞা এসেছে। এমনকি তাদের অনুসরণ করার দ্বারা গুনাহ্গার হতে হবে। আলোচ্য আয়াতে মহান আল্লাহ তাআলা “মিনকুম” শব্দ দ্বারা স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, তোমাদের উপর আমীরের আনুগত্য করা সেই সময় জরুরী হবে, যখন সে তোমাদের (মুসলমানদের) অন্তর্ভুক্ত হবে। আল্লাহ তাআলা আলোচ্য আয়াতের শুরুতে- “ইয়া আইয়্যুহাল্লাযীনা আমানূ” বাক্য বললেও “মিনকুম” শব্দের উল্লিখিত অর্থ উদ্দেশ্য হওয়ার প্রতি ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
একথাও প্রণীত উসূলের অন্তর্ভুক্ত যে, আমীরের নির্দেশ যদি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সাঃ) এর বিধানের বিপরীত হয়, তাহলে তা মান্য করা নাজায়েয ও গুনাহ।
এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) স্পষ্ট ভাষায় ইরশাদ করেন যে, “আমীর আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা.)এর অবাধ্য কোন কর্মের নির্দেশ দিলে তা শ্রবণ করাও যাবে না এবং মান্য করাও যাবে না”। (বুখারী শরীফ- ২/১০৫৭ পৃষ্ঠা)।
আমীর আল্লাহ তাআলা ও তাঁর রাসূল (সাঃ) এর আনুগত্যশীল হলে, তার অনুসরণ করা জরুরী।
স্বয়ং আল্লাহ তাআলা তার অনুসরণ করার উপর জোড় তাগিদ দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) পরিষ্কার ভাষায় ইরশাদ করেন- “যে ব্যক্তি আমার আমীরের অনুসরণ করলো, সে আমার অনুসরণ করল। আর যে ব্যক্তি আমার আমীরের নাফরমানী করল, সে আমার নাফরমানী করল”। (বুখারী শরীফ- ২/১০৫৭ পৃষ্ঠা)।
প্রিয় পাঠক! উল্লিখিত আলোচনা দ্বারা আমীরের আনুগত্য ও এ সম্পর্কিত শর্তসমূহের ব্যাপারে স্পষ্ট নির্দেশনা লাভ করা যায়।
এখন জানা আবশ্যক যে, আলোচ্য আয়াতে “উলুল আমর” দ্বারা কারা উদ্দেশ্য?
তাফসীরের মূলনীতি দ্বারা বোঝা যায়, আয়াতে “উলুল আমর” দ্বারা দুই শ্রেণীর লোক উদ্দেশ্য হতে পারে।
এক. বিজ্ঞ আলেম ও ফক্বীহগণ।
দুই. সৈন্যদলের সেনাপতি ও শাসকদল।
আয়াতে “উলুল আমর” শব্দ থেকে উল্লিখিত দুই শ্রেণীর লোকদের মধ্যে প্রথম শ্রেণী উদ্দেশ্য হোক বা দ্বিতীয় শ্রেণী, উভয় অবস্থাতে আমাদের দাবী প্রমাণিত হবে।
সাহাবায়ে কেরাম (রাযি.)এর ভাষ্যমতে “উলুল আমর” এর ব্যাখ্যাঃ
প্রথম প্রকার তথা উলামা ও ফক্বীহ অর্থে উলুল আমর। হযরত জাবের বিন আব্দুল্লাহ (রাযি.) বলেন, “উলুল আমর; এর দ্বারা উদ্দেশ্য হল, ফক্বীহ ও সৎকর্মপরায়ণ ব্যক্তি”। (মুস্তাদরাক- ১/১২৩ পৃষ্ঠা)।
হযরত জাবের (রাযি.)এর এ ব্যাখ্যাকে ইমাম হাকেম (রাহ.) ধারাবাহিক সূত্রে তথা সনদসহ বর্ণনা করেছেন। ইমাম হাকেম ও যাহাবী (রাহ.) উভয়েই এটাকে বিশুদ্ধ বলেছেন। সমস্ত উম্মতের মধ্যে কুরআনের শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী ও ভাষ্যকার হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাযি.) থেকেও এ ব্যাখ্যাই বর্ণিত হয়েছে, “উলুল আমর দ্বারা উদ্দেশ্য হল ফক্বীহ ও আহলে দ্বীন তথা ধর্মপরায়ণ ফক্বীহ ব্যক্তি (যারা লোকদের সৎকাজে আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ করেন)। এমনকি তিনি বলেন, আল্লাহ তাআলা মানুষদের উপর তাদের আনুগত্য ও অনুসরণকে ওয়াজিব (বাধ্যতামূলক) করে দিয়েছেন”। (মুস্তাদরাক- ১/১২৩ পৃষ্ঠা)।
হযরত ইবনে আব্বাস (রাযি.)এর এ ব্যাখ্যাটিও সনদসহ বর্ণিত হয়েছে। উক্ত সনদের সমস্ত রাবী (বর্ণনাকারী) বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য “ছেকাহ”। আর সাহাবায়ে কেরামের (রাযি.) তাফসীর ও ব্যাখ্যার ব্যাপারে উলামায়ে কেরাম বলেন, “সাহাবায়ে কেরামের (রাযি.) তাফসীর ও ব্যাখ্যা মুসনাদ (রাসূল (সা.)এরই উক্তি)। সাহাবায়ে কেরামের (রাযি.) তাফসীর হুজ্জত ও দলীল। সাহাবায়ে কেরাম (রাযি.)এর তাফসীর মারফূ”। (মুস্তাদরাক- ১/১৩৩, মা’রিফাতু উলূমিল হাদীস- ২০, যাদুল মাআদ- ৪/৫২, তাদরীবুর রাবী- ৬৫, নবাব সিদ্দীক হাসান খান সাহেবের “আল জুন্নাহ”- ৯৬, তাওযীহুন নযর- ১৬৫ পৃষ্ঠা)।
যেহেতু হযরত জাবের (রাযি.) এবং হযরত ইবনে আব্বাস (রাযি.) (আয়াতে উল্লিখিত) “উলুল আমর”-এর ব্যাখ্যা উলুল ফিক্বাহ্ তথা ফক্বীহ দ্বারা করেছেন; আর উলামায়ে কেরামের উল্লিখিত সর্বসম্মত নীতিমালা ও কায়দানুসারে যেহেতু সাহাবায়ে কেরাম (রাযি.)এর ব্যাখ্যা ও তাফসীর ‘মারফূ’ হাদীস হয়ে থাকে এবং উদ্ধৃতিগুলোর সনদও বিশুদ্ধ, তাই একথা অবশ্যই মানতে হবে যে, সাহাবায়ে কেরাম (রাযি.) এই ব্যাখ্যা রাসূল (সা.) থেকেই শুনেছেন।
এখন দেখা যাক যে, গায়রে মুকাল্লিদ হযরতগণ রাসূল (সা.)এর এ ব্যাখ্যাকে গ্রহণ করেন, নাকি অন্যান্য মুফাসসিরীনে কেরামের ব্যাখ্যাকে গ্রহণ করে নিজেদের মত ও পছন্দনীয় কথার উপর অনঢ় থাকতে পীড়াপীড়ি করেন।
আমরা যদি একথা মেনেও নেই যে, সাহাবায়ে কেরাম (রাযি.)এর তাফসীর ও ব্যাখ্যা ‘মারফূ’ হাদীসের হুকুমে নয়; তবুও আল্লাহর রহমতে বিজয় আমাদেরই হবে। গায়রে মুকাল্লিদদের পথপ্রদর্শক ও গুরু নবাব সিদ্দীক হাসান খান সাহেব বলেন, “এমনিভাবে হযরত সাহাবায়ে কেরামের (রাযি.) তাফসীর ও ব্যাখ্যার হুকুম তাদের পরবর্তী লোকদের ব্যাখ্যার তুলনায় অনেক বেশি বিশুদ্ধ”। (আল-জুন্নাহ- ৯৬ পৃষ্ঠা)।
এমনিভাবে হযরত তাবেঈনদের ব্যাখ্যাও উক্তির ব্যাপারে খান সাহেব লিখেছেন যে, “এমনিভাবে তাবেঈনদের ব্যাখ্যা ও উক্তি হুজ্জত ও দলীল”। (আল-জুন্নাহ- ৯৬ পৃষ্ঠা)।
তাবেঈনদের ভাষ্যমতে “উলূল আমর”- এর ব্যাখ্যাঃ
একাধিক তাবেঈন হযরতদের থেকে বর্ণিত আছে যে, “উলুল আমর” দ্বারা উদ্দেশ্য হল আলেম-উলামা ও ফক্বীহ।
হযরত আতা বিন আবি রবাহ (মৃত্যু- ১১৪ হিঃ) থেকে সনদসহ বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেন, “উলুল আমর হল আলেম ও ফক্বীহগণ”। (দারেমী- ৪০ পৃষ্ঠা)।
আবু বকর আল-জাস্সাস র্আরাজী (মৃত্যু- ৩৭০ হিঃ) উলুল আমরের তাফসীরে লিখেন, অর্থাৎ- “উলুল আমরের ব্যাখ্যায় মতানৈক্য রয়েছে। সুতরাং হযরত জাবের বিন আব্দুল্লাহ (রাযি.) ও ইবনে আব্বাস (রাযি.) থেকে ‘মারফূ’ সূত্রে এবং হাসান আতা ও মুজাহিদ (রাযি.) থেকে বর্ণিত আছে যে, উলুল আমর হলেন ফক্বীহ ও আলেমগণ। আর হযরত ইবনে আব্বাস (রাযি.) ও আবু হুরায়রা (রাযি.) থেকে বর্ণিত যে, উলুল আমর হলেন সেনাদলের আমীর। উভয়টিই উদ্দেশ্য হওয়া সম্ভব। কেননা সেনাদলের আমীর সৈন্যদের বুহ্য রচনা, সঠিক পরিচালনা, শত্রুদলের সাথে বীর বিক্রমে যুদ্ধ করা ইত্যাদি কাজ যথাযথভাবে আঞ্জাম দিয়ে থাকেন। আর ফক্বীহ ও আলেমগণ দ্বীন ও শরীয়তের রণাবেণ, হালাল-হারাম ও জায়েয-নাজায়েযের সীমা নির্ধারণসহ ধর্মীয় সমস্ত কাজের দায়িত্ব আঞ্জাম দিয়ে থাকেন”। (আহকামুল কুরআন- ২/২১০ পৃষ্ঠা)।
উক্ত উদ্ধৃতিটি “উলুল আমর”-এর ব্যাখ্যায় স্বীয় ভাব ও অর্থ প্রকাশে সুস্পষ্ট।
তিনি অন্যত্র লিখেন, অর্থাৎ- “হযরত হাসান বসরী, কাতাদা ও ইবনে আবি লাইলা (রাযি.) বলেন যে, উলুল আমর হলেন আলেম ও ফক্বীহগণ।
সুদ্দী (রাহ.) বলেন, উলুল আমর হলেন আমীর ও শাসকগণ।
আবু বকর জাস্সাস (রাহ.) বলেন, উলুল আমর দ্বারা ফক্বীহ ও শাসক; উভয় শ্রেণীর উদ্দেশ্য নেয়া সঠিক। কেননা উলুল আমর শব্দটি উভয় অর্থেই ব্যবহৃত হয়”। (আহকামুল কুরআন- ২/২১৫ পৃষ্ঠা)।
এ উদ্বৃতি দ্বারা একথা দিবালোকের ন্যায় সুস্পষ্ট হয়ে গেল যে, উলুল আমর শব্দ দ্বারা উভয় অর্থ উদ্দেশ্য নেওয়ার মাঝে কোন দ্বন্দ্ব বা বৈপরিত্ব নেই। এমনকি তাতে বর্ণনাগত ও যুক্তিগত কোন সমস্যাও নেই।
সারকথা হল, যখন একথা পূর্ণভাবে প্রমাণ হল যে, উলুল আমর দ্বারা উদ্দেশ্য হল ফক্বীহ, আলেম ও সৎকর্মপরায়ণ ব্যক্তি; তাহলে কুরআনে কারীমে আল্লাহ তাআলা তাদের আনুগত্য করারই আদেশ দিয়েছেন। আর একথা নিশ্চিত অসম্ভব যে, আল্লাহ তাআলা শিরক, বিদআত বা কোন মন্দ কাজের আদেশ দিবেন।
পবিত্র কুরআনের আদেশ সূচক বাক্য “আত্বিঊ” (তোমরা আনুগত্য কর)এর প্রতি ভালভাবে লক্ষ্য করা উচিত।
গায়রে মুকাল্লিদদের পথপ্রদর্শক নবাব সিদ্দিক হাসান খান লিখেন- “আদেশগুলো তথা আমরের মধ্যে আসল মূলনীতি হল আদিষ্ট বিষয়টি ওয়াজিব সাব্যস্ত হওয়া”। (বুদুরুল আহিল্লা- ২২ পৃষ্ঠা)।
আরবীতে ‘আমর’ বা নির্দেশ সূচক শব্দ দ্বারা যেহেতু ওয়াজিব সাব্যস্ত হয়, সেহেতু এ ওয়াজিবের উপর আমল করলে শিরক হয় কিভাবে? এ ওয়াজিব পালনকারীদের উপর এত ঘৃণ্য ও জঘণ্য মন্তব্যের হেতু কি? গায়রে মুকাল্লিদ হযরতরা আল্লাহ তাআলাকে ভয় করা উচিত যে, মাযহাবের ইমামদের তাক্বলীদকারীদেরকে মুশরিক বলার দ্বারা কি কি অনিষ্টতা অপরিহার্য হয়ে যায়? আর এ অনিষ্টতার কুফল ও তি কাদের উপর পতিত হয়? আর জগৎ বরেণ্য ইমামদের শানে এটা কী ধরণের সম্মান প্রদর্শন হয়?
তাকলীদের স্বপক্ষে দ্বিতীয় আয়াতঃ
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, অর্থাৎ- “আর যখন তাদের কাছে পৌঁছে কোন সংবাদ শান্তি সংক্রান্ত কিংবা ভয়ের, তখন তারা সেগুলোকে রটিয়ে দেয়। আর যদি সেগুলো পৌঁছে দিত রাসূল পর্যন্ত কিংবা উলুল আমর পর্যন্ত, তখন অনুসন্ধান করে তারা তার যথার্থতা নির্ণয় করতে পারত”। (সূরা নিসা- ৮৩ আয়াত)।
আলোচ্য আয়াতে জনসাধারণকে সতর্ক করা হয়েছে যে, সব ধরণের কথা তাদের বোধগম্য হবে না। সুতরাং নিরাপত্তা বা ভীতিজনক কোন অবস্থার কথা যখন তারা শুনবে, তখন তাদের কর্তব্য হল রাসূল এবং উলুল আমর তথা শরীয়তের গভীর জ্ঞানের অধিকারী ব্যক্তিদের থেকে জিজ্ঞাসা করা; তারা অবস্থানুপাতে যা কল্যাণকর মনে করে, তাদেরকে জানিয়ে দিবেন, সে অনুযায়ীই তারা আমল করবে।
লেখকঃ মুফতী ও মুহাদ্দিস, দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।