একবার আমাকে প্রায় তিন মাস একটানা হাসপাতালে থাকতে হয়। দীর্ঘদিন হাসপাতালে থাকার ফলে ডাক্তার, নার্স সহ হাসপাতালের অন্যান্য সবাই বেশ আপন হয়ে যায়। হাসপাতালের ছয় তলার জানালা থেকে আমি দেখতাম ভোরের আলো ফুটছে। সকাল হয়ে যাচ্ছে। একেকটা গাড়ি এসে পার্ক করছে। সবাই কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। কাজ শেষে বাড়ি ফিরে যাচ্ছে। সূর্যের আলো মরে আসছে।পার্কিং লট আবার ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। শনিবার -রবিবার পার্কিং লট একেবারে ফাঁকা।
মাঝে মাঝে দেখতাম ফাঁকা পার্কিং লটে একজন লোক পাখিদের খাবার ছিটাচ্ছে। অনেক পাখির ভিতর একটা পাখির ছিলো ভাঙ্গা পা। শুধু এই পাখিটাকেই আলাদা করতে পারতাম। আর এই পাখিটাকে দেখার অপেক্ষায় বসে থাকতাম।
নানা রোগী আসতো। কেউ সপ্তাহ দু সপ্তাহ থেকে সুস্থ হয়ে চলে যেতো। অনেকে তাদের জন্য ফুল, বেলুন , চকলেট ইত্যাদি নিয়ে আসতো। জন্ম দিনের কেক নিয়ে আসতেও দেখেছি। অসুস্থ হয়েছে কি হয়েছে। জীবনের অনুষ্ঠানতো তো আর থেমে থাকেনা। আবার অনেকের জীবনের সব অনুষ্ঠান সাঙ্গ হয়ে যেতো। বিষাদের ছায়া তখন স্বজনের চোখে মুখে। কারো ফুঁফানো, কারো গোঙ্গানো কারো আহাজারি হৃদয়টাকে ব্যথিত করে দিয়ে যেতো। ফাঁকা বেডে আবার আরেকজন নতুন রোগী এসে ভর্তি হতো।
রোগীদের স্বজনদের সাথেও বেশ আলাপ হতো। একবার দেখলাম একজন পৌঢ় সাদা ইয়া লম্বা ভদ্রলোক আমার পাশের কক্ষের সামনের চেয়ারে বসে আছেন। রুমে আসা যাওয়ার পথে হাই হ্যালো বলতে বলতে উনার সাথে বেশ আলাপ জমে ওঠে।
ভদ্রলোক বলেন- আমি গ্রামের মানুষ। গ্রামেই স্বস্তি পাই। আটলান্টা শহরে এতো গাড়ী আর গাড়ী। আমারতো এখানে গাড়ি চালিয়ে আসতেই ভয় করে।
কিছুটা অবাক হলাম। আমেরিকায় থেকেও গাড়ি চালাতে ভয় করে।
ভিতর থেকে গোঙ্গানির শব্দ এলো। উনি তাড়াতাড়ি ভিতরে গেলেন। কিছুক্ষণ পর বের হয়ে এসে বললেন- আমার আগের স্ত্রী। বেচারীর কষ্ট হচ্ছে খুব। তুমি বসো। আমি একজন সিস্টার ডেকে নিয়ে আসি।
ওনার সাথে আমার খুব সুসম্পর্ক হয়। গল্পে গল্পে কত কথা জানা হয়।
উনি বলেন- অতিরিক্ত ড্রিঙক করে শরীরটাকে একেবারে নষ্ট করে দিয়েছে। যখনই বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ে তখনই আমার ডাক পড়ে।
আর আমি সব কিছু ছেড়ে চলে আসি। আমি ছাড়াতো বেচারীকে দেখার মতো আর কেউ নেই।
মাঝে মাঝে নিদ্রাহীন গভীর রাতে আমি বারান্দায় পায়চারী করি। পায়ের শব্দ শুনে উনি বলতেন- ভিতরে আসো।
দেখতাম ঘরের ভিতরে মৃদু আলোতে তিনি মহিলার পা দুটো কোলে নিয়ে চুপচাপ বসে আছেন।
জানিনা, মহিলার চেতন আছেন নাকি ঘুমিয়ে পড়েছেন, নাকি একেবারেই অবচেতন। শরীরের একেক অংশ একেক মেশিনের সাথে সংযুক্ত।
ভালো আছেন উনি। ডাক্তাররা কি বললো?
ওরাতো কিছুই বলেনা। শুধু নানা রকমের টেস্ট করে। আর আমাকে নানা রকমের নাম্বারের পরিসংখ্যান দিয়ে যায়। এসব কিছু কি আমি বুঝি।
আপনি যে উনাকে এতো ভালোবাসেন । এই যে উনার পা দুটো কোলে নিয়ে বসে আছেন। সেটা কি উনি বুঝতে পারেন।
ভালোবাসি সেটাতো অবশ্যই বুঝতে পারে। তা না হলে যখন খুব অসুস্থ হয়ে যায়। তখন আমাকে ডাকবে কেন? পা কোলে নিয়ে বসে আছি মায়ায়। ও বুঝতে না পারলে আমিতো বুঝতে পারছি।
শুধু এদের দেখে না। আরো নানা জায়গায় এরকম বিচ্ছেদ হওয়া পরিবার দেখে বুঝেছি- আমাদের বিচ্ছেদ হওয়া মানে যেমন জীবনে আর কারো মুখ দেখা দেখিনা। এদের তেমন না। ডিভোর্স মানেই এরা একজন আরেক জনের চোখের বিষ না।
আবার এও ভাবছি এতো ভালোবাসা, মমতা , দরদ , অনুভূতি থাকার পরও বিবাহ বিচ্ছেদ হলো কেন?
জানিনা, মানুষের মনতো আর অংকের খাতা না। তাই, জীবনের সব হিসাবে এখানে অঙ্কের মতো মিলেনা।