চির অম্লান হাসি
তোমার কুঁড়েঘর ছিলো। ছিলো ভাঙ্গা মাটির দেয়াল।
জননেতা তোমার বাসায় আসলেন।
তোমার সাথে হাত মিলালেন।
হাতের স্পর্শে তুমি মুগ্ধ হয়ে হাসো।
গ্রীষ্মের দাবদাহে মাঠ পুড়ে ছারখার। শস্যক্ষেতে হাহাকার।
তুমি লাঙল আর গোয়াল গরু মাঠে রেখে নেতার মিছিলে সামিল হলে।
নেতা বক্তৃতা দিলেন।
আশ্বাসের বাণী শুনে তুমি বড় মুগ্ধ হয়ে হাসো।
বর্ষায় প্লাবন তোমার কুঁড়েঘর ভেঙ্গে হানা দিলো।
বই, খাতা বৃষ্টির জলে ধুঁয়ে গেলো তোমার সন্তানের।
নেতা সফেদ পান্জাবী পড়ে সামনে এগোলেন।
নেতাকে দেখে তুমি শুধু মুগ্ধ হয়ে হাসো।
শরতের দিনগুলোতে বুভুক্ষু তুমি।
ঘরের ছাউনির ভিতর থেকে দেখা যায় সাদা আকাশ।
বাজারের টেলিভিশনে নেতার চেহারা ঝলঝল করে ।
টেলিভিশনে নেতাকে দেখে তুমি আজো মুগ্ধ হয়ে হাসো।
হেমন্তে তোমার ঘরের মাটির দেয়াল একে একে ক্ষয় হয়।
গ্রামে ওঠলো সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন দালান।
জননেতার জনসেবার ঘর।
এ ঘর দেখে তুমি আবারো মুগ্ধ হয়ে হাসো।
শীতে তোমার শরীরে কাঁপন ধরে।
সারারাত সন্তানেরা খড়কুঠো পুড়িয়ে শীতের সাথে অসম যুদ্ধ করে।
নেতা শীতার্তদের বাঁচার সেমিনার করেন।
নেতার মহত্বে তুমি এখনো মুগ্ধ হয়ে হাসো।
বসন্ত কি সে তুমি আর বোঝনা। কোকিলের ডাক শুনলেই তুমি শুধু বুঝতে পারো মহাজনের ৃণ পরিশোধের সময় এসেছে।
জননেতার কালো চকচকে গাড়ি আসে তখন গ্রামে।
তুমি অবাক চোখে নেতার গাড়ী দেখো আর মুগ্ধ হয়ে হাসো।
গ্রীষ্মে,বর্ষা,শরতে, হেমন্তে, শীত, বসন্তে দিনে দিনে তোমার সন্তান বড় হয়।
হাতের পেশী শক্ত হয় একটু একটু করে।
একদিন ভোরে তোমার সাথে এসে বিরান মাঠে লাঙলের ফলা বসায়।
আর নেতার ছেলে তখন আকাশে ওড়ে।
আকাশে উড্ডীয়মান উড়োজাহাজ দেখে বাপ-ছেলে মুগ্ধ হয়ে হাসো।
১৬ কোটি মানুষের গণতন্ত্র
গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত বসন্তে তুমি এভাবেই হাসতে থাকো।
ছাউনির ভিতর দিয়ে বজ্রপাত হানা দিক,
ভয়াবহ শীতের কাঁপন তোমার শরীরের হাড় বিদীর্ণ করুক
মহাজনের লাঠিয়াল ক্ষেতের শস্য, গোয়ালের গরু লুঠে নিয়ে যাক,
তোমার সন্তানেরা বুভুক্ষু হয়ে পড়ে থাকুক,
ক্ষমতার মসনদে বাংগালি আর বাংলাদেশী জাতীয়বাদ
জয়বাংলা অথবা বাংলাদেশ জিন্ধাবাদের পালাবদল ঘটুক।
তাতে তোমার কিছুই আসে যায়না।
তুমি শুধু মুগ্ধ হয়েই হাসো।
এতিম হাফেজ শাপলা চত্বরে কীসের প্রলোভনে শহীদ হয়,
তাও তুমি বুঝনা।
মাস্টার বাড়ীর সবচেয়ে প্রগতিশীল ছেলে কেন শাহবাগে রাতভর
আলোর প্রদীপ জ্বালে , তাও তুমি বুঝনা।
সুইচ ব্যাংকে কার ঘামের টাকা কীভাবে হাজার কোটি ছাড়িয়ে যায়,
তাও তুমি বুঝনা।
ব্রিটিশ, ফরাসী, পর্তুগীজ, ওলন্দাজ,পাকি আর নব্য বাণিজ্যিক মাফিয়া ভারত সবকিছু কেমন করে লুঠে নিয়ে যায় -তাও তুমি বুঝনা।
কেন সীমান্তে বছরের পর বছর লাশ পড়ে থাকে-
তাও তুমি বুঝনা।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাওয়া ছেলে কেন সহপাঠীর গুলিতে খুন হয়
তাও তুমি বুঝনা।
কেন মানুষ আরকেজন জ্যন্ত মানুষকে সাপের মতো পিটিয়ে মেরে ফেলে
তাও তুমি বুঝনা।
কেন গার্মেন্টস ফ্যাক্টরী গুলোতে আগুন ধরে,
কেন ক্যাম্পে জীবন্ত মানুষ শুকনো কাঠের মতো পুড়ে,
কেন সংখ্যালঘুরা ভিটে মাটি ছাড়া হয়
তাও তুমি বুঝনা।
তুমি শুধু বুঝ প্রতি সূর্যোদয়ের আগেই তোমাকে মাঠে হাজির হতে হবে।
তুমি শুধু বুঝ মাটির শানকিতে কিছু সাদা ভাত সন্তান,বউ আর বৃদ্ধ বাবা মায়ের মুখে তোলে দিতে হবে।
তুমি শুধু বুঝ হাতে কাস্তে আর চোখে শস্যের স্বপ্ন।
আর শোনো সংসদে নেতার সত্য ভাষন-
দেশের মানুষের সব দুঃখ দূর হবে।
তুমি অবিরাম শোনো আর মুগ্ধ হয়ে হাসো।
জননেতার ছেলে আবার নতুন জননেতা হতে বিদেশ থেকে ফিরেছেন।
তুমি শোনো আর মুগ্ধ হয়ে হাসো।
আর এভাবেই সত্য শুনেই শুনেই একদিন আসল সত্যের মৃত্যু হবে,
মৃত্যু সময়েও সত্যের মুখে সেই চির মুগ্ধতার হাসি রয়ে যাবে।
যে কাস্তে তুমি শক্ত হাতে ধরেছিলে,
যে নতুন শস্যের শীষ তোমার কপাল স্পর্শ করেছিলো,
যে নৌকার পাল তুমি নীল আকাশে উড়িয়েছিলে,
যে জমির আইলের উপর বসে তুমি বিশ্রাম নিয়েছিলে
যে ছেড়া গামছা তোমার ঘাম মুছে দিয়েছিলো,
ঘরের ফিরার পথে যে জলে তুমি সাঁতার দিয়েছিলে -
ওরা শুধু জানে সবকিছু লুঠপাট হয়ে গেলেও -
তোমার সেই চির অম্লান ,চির দীপ্তিমান, চির প্রশান্তিময় মুগ্ধতার হাসি
কেউ লুঠে নিতে পারবেনা, কেউ কোনোদিনও না।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জুন, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫