রুপগন্জ স্টেশনে আমি পরের বাসের অপেক্ষায় বসে আছি। দেখি,এক ছোট ছেলে হাঁক দিয়ে দিয়ে চা বিক্রি করছে।পিচ্চির কাছে চা চাইলো-এক সুবেশী যুবক।পিচ্চি চা কাপে ঢালতে না ঢালতেই ,আরেক হকারের কুনুইয়ের ধাক্কা খেয়ে ছলাত করে যুবকের শার্টে পড়লো।যুবক পিচ্চিকে এমন জোরে চড় মারলো-আমার পুরো অন্তরাত্মাই কেঁপে ওঠলো।
আমার পাশে বসা ভদ্রলোক,সব লক্ষ্য করে বললেন-আহারে যুবক-কেন যে মিছেমিছি চড় মারলে? যা হবার তা তো হয়েই গেছে।আসলে তোমার সুলাইমানের গল্পটা জানা দরকার ছিলো।বলেই আমার দিকে ফিরে থাকালেন।আমার ও সময় কাটেনা। আমি বলি ,সুলাইমানের গল্পটা কেমন?
ভদ্রলোক অতি আগ্রহ নিয়ে গল্প বলা শুরু করলেন-
একজন নিরীহ প্রাইমারী ইস্কুলের শিক্ষকের ছেলে সুলাইমান এমন জালিম ছিলো-তারপর আবার কেমন করে যে এতো সাধু হয়ে গেলো তা একবারে আজিব ব্যাপার।
সুলাইমান ছিলো প্রচন্ড বদমেজাজি। এতো অভদ্র যে একদিন সে রিকশা থেকে নেমেই ড্রাইভারকে চড়াতে শুরু করলো শুধুমাত্র একটা টাকা বেশী চাইছিলো বলে। এরপর সে বাড়ীএসে দেখে উনুনে এখনো ভাত।সুলাইমানের মাথা গরম ভাতের মতো গরম হয় আর সিদ্ধ ভাতের ধোঁয়ার মতো মাথা থেকে ভাঁপ বের হতে থাকে।রাগের মাথায় মারলো কাজের মেয়ে জরিনারে প্রচন্ড জোরে এক চড়।
সুলাইমানের পিতা আকমল মাস্টার রাতে বাসায় এসে যথারীতি ছেলের এসব কীর্তি শুনেন। ছেলেকে কিছুই বলেন না। রাতার খাবার খেয়ে ঘুমাতে যান।
ভোরে পূবাকাশে আলো ফুটছে।চারদিকে প্রশান্তির বাতাস বইছে,ফুরফুরে হিমেল হাওয়া।আকমল মাস্টার সুলাইমানকে ঘুম থেকে তোলেন।হাত মুখ ধূয়ে বাপ আর ছেলে অল্প কিছু পেটে চালান দিয়ে গ্রামের আল ভরাভর হাঁটতে থাকেন গন্জের দিকে।
সুলাইমানের বায়ুচড়া মন বড় বেশি উচাটন। মনে নানা রকম চিন্তা।বাপ আজ সকাল বেলায় তারে নিয়ে কোথায় রওয়ানা দিলেন।
দুজনে রহমত ব্যাপারীর ভূষিমালের দোকানে আসে।নানারকম সওদা শেষ করে।তারপর মাস্টার মশাই, সুলাইমানকে বলেন-ছটাক তিনেক পেরেক কিনে নিতে। পূবাকাশের আগুনের গোলা মাথার উপর ওঠতে না ওঠতেই দুজনে আবার বাড়ি ফিরে আসে।
আকমল মাস্টার ছেলে সুলাইমাকে নিয়ে খেতে বসেন।খাওয়া দাওয়া শেষ করে , ছাতিম গাছটার নীচে আসেন।তারপর তিনি পেরেকের থলেটি ছেলের হাতে দেন। শান্ত-ধীরে ছেলের মাথায় হাত রেখে বলেন-যখনই তোমার মেজাজ চড়া হবে -কারো সাথে অভদ্র ব্যবহার করবে,কাউকে চড় মারবে, মারধর করবে তখনই একটি করে পেরেক এই ছাতিম গাছে বিঁধবে।
তোমার জন্মদাতা বাপ হিসাবে এই অনুরোধটুকু কি বেশী হয়ে যাবে?
সুলাইমান বাপের কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারেনা। তবে, নীরবে সম্মতি জানায়।
মাস দুয়েক পর-
চৈত মাসের প্রচন্ড গরম পড়েছে।আকমল মাস্টার শীতল বাতাসের টানে ছাতিম গাছটার নীচে এসে বসেন।দেখেন অনেকগুলো পেরেক ছাতিম গাছটায় বিঁধে আছে। এবার সুলায়মানকে ডাকেন।বলেন-ও আরেকটি কথা,যে পর্যন্ত তোমার মেজাজ নিয়ন্ত্রনে থাকবে -কারো সাথে ভালো ব্যবহার করবে, বিনয়ী হবে, শালীন, মার্জিত রুচি নিয়ে কথা বলবে তখন একটি করে পেরেক এখান থেকে তুলে ফেলবে।
কয়েক মাস যায়। আকমল মাস্টার ছাতিম গাছের নীচে এসে দেখেন, আর একটিও পেরেক গাছে বিঁধে নেই। তিনি খুব খুশী হন। ছেলেকে নিয়ে ছাতিম গাছের পাশে যান। তারপর বলেন-আমার ভালো লাগলো তোমার মেজাজের পরিবর্তন হয়েছে দেখে।
যাদের সাথে প্রতিনিয়ত খারাপ ব্যবহার করতে ,রিকসা ড্রাইভার,কাজের মেয়ে, স্বজন, বন্ধু, পরিজন সবার সাথে ভালো ব্যবহার করছো।কিন্তু গাছটার দিকে একবার চেয়ে দেখো-সেই বিঁধে যাওয়া পেরেকগুলো আর নেই ,কিন্তু দাগগুলো ঠিকই সেখানে রয়ে গেছে।এ দাগুগুলো কিন্তু কখনোই মুছে যাবেনা। কখনোই না।
শারীরিক আঘাতের চিহ্ন যেমন দাগ রেখে যায়, ঠিক তেমনি, মানসিক আঘাত,খারাপ ব্যবহার, কোনো তাচ্ছিল্য ,কোনো অবহেলা,অহমিকা,বড়ত্বের অহংকার,রাগের চোটে অসাবধানতাবশতঃ কোনো অর্বাচীন বাক্যও মানুষের মনে চিরস্থায়ী দাগ রেখে যায়।
সেদিন যে ড্রাইভারকে চড় মেরেছিলে বাজারে, মনে আছে?শুনেছি সে আর নেই, ট্রাকের চাপায় পড়ে মারা গেছে।আমার বড় কষ্ট হচ্ছে তোমাকে ক্ষমা করার জন্য ও আর পৃথিবীতে রইলো না। তাই, সবসময় ভুল করে যে আবার ক্ষমা চাইবে ,সে সুযোগ ও আর কোনোদিন নাও আসতে পারে।
ইতোমধ্যে আমার বাস এসে দাঁড়িয়েছে। আমি বলি, হুম শুনলাম,আপনার গল্প। অনেক কিছু শিখার আছে ,কিন্ত আমাকে এবার যেতে হবে। যদি ,আপনার নামটা অনুগ্রহ করে বলেন-
লোকটি বলেন-আমার নাম হলো সুলাইমান। সেই আকমল মাস্টারের বদমেজাজি ছেলে।
বাড়ী ফিরার পথে গাড়িতে বসে আমি চিন্তা করছি-এই ছোট জীবনে কত জনের বুকে যে কত পেরেক বিঁধে রেখেছি, মুছাতো যাবেনা,কিন্তু সব তোলে ফেলার সময় পাবোতো?
(একটি ইমেইলের সূত্র অবলম্বনে) © বিহঙগ
তিন কন্যা -মনিরা সুলতানা, নুসরাত সুলতানা আর না পারভিন আমার অগল্পগুলোকে গল্প বলে আমাকে দারুন লজ্জায় ফেলে দেন। আমি একাই কেন লজ্জিত হবো। এ অগল্পটি আপনাদের উৎসর্গ করলাম। দেখেন লজ্জা কেমন লাগে?