•
ফেইসবুক আইডি লগআউট করে কম্পিউটার টেবিল ছাড়ল সুজন। ক্ষীণ ব্যঙ্গাত্মক তীক্ত হাসিটা তখনো ঠোঁটে ঝুলে আছে। আজকেও আট নয়টা ছাগু আইডি আনফ্রেন্ড করেছে। হাসিটা অবশ্য সে কারণে নয়, কোন এক ছাগুর পোস্ট দেখে তাকে ব্লক মারতে হয়েছে। ‘অশান্তির বিষবাস্প পুরো দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে আগেই। আস্তে আস্তে তার জ্বালা আরো তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। শান্তির খোঁজে তাই হণ্যে হয়ে গেছে সবাই। আমরাও। অ্যালকোহল, ইয়াবা আর উদ্দাম নৃত্যে সাময়িক আশ্রয় মিললেও নেই কোন মুক্তি। সুঠামদেহী যান্ত্রিক সভ্যতার বিদ্রুপাত্নক হাসিতে গা শিউরে উঠে। আত্নহত্যার মিছিল তো এমনি এমনি দীর্ঘ হচ্ছেনা! শান্তির সন্ধান পাওয়া কি তাহলে অসম্ভব? বাস্তবতা হল, না। নাগালের মধ্যেই মিলবে! এ প্রসঙ্গে কেবল, কোরআনের একটা আয়াত উদৃত করেই ক্ষান্ত দিচ্ছি, জেনে রেখ, আল্লাহর যিকিরে অন্তর প্রশান্তি লাভ করে। সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ: এই পোস্ট চুলকানির রোগী ও তাদের বাপ নাস্তিকদের জন্য প্রযোজ্য নয়!’ হুঁহ, শালারা কোনদিন মানুষ হবে না। গভীর ধ্যান বা মেডিটেশনে যে মনে স্থিরতা আসে, তা তো বৈজ্ঞানিক ভাবেই স্বীকৃত! বৈজ্ঞানিক তথ্যকে ধর্ম বানিয়ে দিয়ে ব্যাবসা করার স্বভাব এদের মজ্জাগত। সত্যিকারের দরদ থাকলে কি আর কোরার শরীফের দোকান ধরে পোড়াতে পারতো!
আজকে ভার্সিটিতে যেতে ইচ্ছা করছিলো না। কিন্তু উপায় নেই, অনিকা মেসেজ পাঠিয়েছে এগারোটার দিকে ক্যাম্পাসে থাকতে বলে। তাড়াতাড়ি বেরুতে হবে। পেপারটা নিয়েই নাস্তার টেবিলে গিয়ে বসল। খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে চোখ বুলাতে বুলাতে হঠাৎ এক জায়গায় গিয়ে চোখ আটকে গেল- কিশোর আলো এবার জাফর ইকবাল সংখ্যা বের করছে! দেখেই মনটা ভালো হয়ে গেল। তরুণদের আদর্শ, সুপথের দিশারী জাফর স্যার। সুশীল সমাজের কন্ঠস্বর প্রথম আলো একা একা যে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছিলো. তা অনেকটাই সাফল্যের পথে জাফর স্যারদের কারণে। এই মহামানবেরা কেন যে এতকাল পর পর জন্মান! খুব লজ্জা করছিলো, তবু আশপাশে চট করে দেখে নিয়ে পেপারে জাফর স্যারের ছবির উপর একটা চুমু দিয়ে দিলো সুজন। যা মনে আসে তাই করার সাহস থাকতে হবে। তারুণ্যের শক্তি তো এটাই!
দূর থেকে দেখা গেল রুমা আর তানিয়ার সাথে হাসাহাসি করছে অনিকা। মিসকল দিতেই সুজনের দিকে এগিয়ে এল। ‘এমন শুকনো লাগছে কেন তোমাকে? আর অজকেও তুমি সেই দেরি করেই এসেছো!
না, কিছু হয়নি। আসতে বলেছো কেন?’
‘এমনিই। আচ্ছা, তুমি এমন গম্ভীর আর সিরিয়াস হয়ে যাচ্ছো কেন দিন দিন? কোন হাসির কথা নেই, হাসি নেই। খালি গুরুগম্ভীর ভারিক্কি সব কথা- হেন করতে হবে, তেন করতে হবে। তোমার সাথে রিলেশন রাখাই মুশকিল হয়ে যাবে বোধ হয়।’
আসলেই সুজন আর সেই উচ্ছল ছেলেটা নেই। আগের মত হালকা দুট্টুমি আর ঠাট্টা তামাশাগুলো করতে পারেনা। সা¤প্রদায়ীকতা, মৌলবাদ, জঙ্গীবাদ ইত্যাদি চিন্তায় মাথাটা ভারী হয়ে থাকে সবসময়।
‘আরে ধুর, বাদ দাও তো।’ মাছি তাড়ানোর মত করে কথাটা উড়িয়ে দিলো সুজন। চুপচাপ বসে রইল দুজনে কিছুক্ষণ। বলার মত কথা খুঁজে পাচ্ছেনা।
‘হিজাব টিজাব লাগিয়ে এসেছো দেখছি!’নীরবতা ভাংলো সুজন।
‘কেন, খারাপ লাগছে দেখতে?’
‘না, তা না। পুরো বোরকাওয়ালী মৌলবাদীদের মত লাগছে দেখতে। কবে আবার বোমাবাজি শুরু করো কোন ঠিক আছে!’
‘দেখ, আমার কাপড় চোপড় নিয়ে কথা বলবেনা।’ রেগে গেছে অনিকা। ‘আমার ইচ্ছা করেছে আমি পরেছি। আব্বু আম্মুও এটাই পছন্দ করেন। তোমার সাথে শুধু প্রেম করছি, তাতেই এই কথা। বিয়ের পর হলে তো মনে হয় টান দিয়ে স্কার্ফটাই খুলে নিতে! বোমা টোমা মারলে তোমাদের আর তোমার স্যারদের উপরেই আগে মারতাম। শুধু একটা স্ক্ার্ফ পরায় যা তা বলছো তোমরা।’
রাগ লাগলেও কিছু বললো না সুজন। কথায় অনিকার সাথে পারবেনা। ডিপার্টমেন্টের নামকরা বিতার্কিকদের একজন অনিকা। তার উপর এখন আবার রেগে আছে।
‘হ্যারাসমেন্টের কারণে ক্লাসেও আসতে ইচ্ছা করেনা জানো। আনু স্যারের ক্লাসে আসাই তো বন্ধ করেছি এ কারণে। মার্কের কি হাল হবে কে জানে।’ রাগ কমানোর জন্য থামলো একটু অনিকা। সুজনও কিছু বলছেনা। মনোযোগ দিয়ে শার্টের নিভাঁজ মসৃণ কোণাটাকে সমান করার চেষ্টা করছে।
এই, আমার এখনই বাসায় যেতে হবে। দেরি হয়ে যাচ্ছে। গেস্ট আসবে বাসায়। যাই আমি, ফোনে কথা হরে। চলে গেল অনিকা।
মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেছে সুজনের অনিকার কথাবার্তায়। রাফি সুমনদের দেখেও আর আড্ডায় যোগ দিতে ইচ্ছা করলো না। বাসায় চলে এল।
রাত সাড়ে দশটা। স্কাইপ অন করেই দেখল রবার্ট অনলাইনে। রবার্ট আমেরিকান, স্কাইপেই পরিচয় ওদের। প্রায়ই কথা বলে ওরা। বিশ্ব, খেলাধুল, অর্থনীতি, রাজনীতি, ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দ সবকিছু নিয়েই কথা হয় ওদের মাঝে। ফ্রি আছে কিনা লিখে মেসেজ দিতেই কল করলো রবার্ট:
‘ হাই রবার্র্র্ট, কি অবস্থা। কেমন চলছে?’
‘হাই, ভালোই। তোমার সবকিছু ঠিকঠাক তো সুজান?’
‘এই সময়ে তুমি লাইনে! ক্লাসে যাওনি?’
‘উইকএন্ডে আবার কিসের ক্লাস?’
‘ওহ, খেয়ালই করিনি। সরি। আমাদের উইকএন্ড দুই একদিন আগে চলে গেছে তাই গুলিয়ে ফেলেছি।’ ‘নো প্রবলেম। বিকালে একটা পার্টিতে এটেন্ড করব, তাই বাইরেও যাইনি আজকে।’
‘ও। কি পার্টি? কারো বার্থডে টার্থডে নাকি?’
‘না, না। আমরা ইয়ং আর টিনেজার বন্ধুরা স্রেফ মজা করার জন্য আয়োজন করছি।’
‘ও, মেয়েরাও তাহলে থাকবে নিশ্চয়? ইঙ্গিতপূর্ণ সুরে বললো সুজন।’
‘ওরা তো আসেই। আর না এলেও হয়, ফান করতে চাইলে ওদের ছাড়াও তো করা যায়, না?’
‘হ্যাঁ, তাই তো। তোমরা কত ভালো আছো, দেখেছো? আমাদের দেশে গোঁড়া মৌলবাদীরা পরিবেশটা বিষাক্ত করে রেখেছে। হোমোসেক্সের কথা বললেই তুলকালাম ঘটিয়ে ফেলবে। আমরা প্রেম করি, তাতেই গেল গেল রব তুলছে সারাক্ষণ! মানুষকে লাইফটা এনজয়ও করতে দেবেনা (লেখার অযোগ্য গালি!)। নোবেল পাওয়া ড. ইউনুসকে পর্যন্ত আক্রমণ করতে ছাড়েনি ওরা সমকামী অধিকারের পক্ষে কথা বলায়! যারাই করে এখনো চুপে চাপে করতে হয়।’
‘তা ঠিক। আমরা কে কি করছি অন্য কেউ ফিরেও দেখেনা, বাগড়া দিবে তো দূরের কথা। অ্যাই, আমেরিকায় সুজান কিন্তু মেয়েদের নাম রাখে, জানো?’ কথা ঘুরানোর জন্য বললো রবার্ট।
‘জানি তো। তুমি বাংলা উচ্চারণ করতে না পেরেই তো আমাকে সুজান বানিয়েছো। তোমার সমস্যা হলে আমাকে ছেলেদের নামেও ডাকতে পারো। যেমন- রেমন্ড।’
‘আরে- না না, কি বলো। তোমার নামেই ডাকবো আমি। আচ্ছা সুজান, তোমার গলা এমন শোনাচ্ছে কেন? এনিথিং রং?’
‘হ্যাঁ, মেজাজ খারাপ হয়ে আছে। ঐযে মৌলবাদ সমস্যার কথা বললাম তোমাকে, আজকে গার্লফ্রেন্ডের সাথে এটা নিয়ে লেগেছিলো। আসলে এই বক ধার্মিক মৌলবাদীদের গোড়া থেকে উৎখাত করতে হবে। এদের জন্যই আমাদের দেশটাতে এত সমস্যা।’ নিজের সব ক্ষোভ রবার্টের কাছে উগড়ে দিতে থাকে সুজন। রবার্ট সান্ত্বনা দিয়ে বলে, ‘এখন তোমরা তরুণেরা তো জেগেছো। তোমরাই পারবে বদলে দিতে।’ দীর্ঘক্ষণ চলে কথা।
‘এই জানো, সামনের সামার ভ্যাকেশনে ঘুরতে বেরুব ভাবছি। বাইরের কোন দেশে যেতে হবে।’ হঠাৎ মনে পড়ে যাওয়ার ভঙ্গিতে খুশি খুশি গলায় বললো রবার্ট।
‘দূরে ঘুরতে যাবে, আমাদের সবুজ শ্যামল বাংলাদেশেই চলে এসো না। দেখার নতুন অনেক কিছু পাবে।’
‘ভাবছিলাম শুনে তুমিই প্রস্তাবটা দাও কি না। এটা আমিও চিন্তা করেছি। ভালোই তো হয়। দেখি।’
‘হ্যাঁ, এসে পড়। মজা হবে। তোমার সাথে দেখাও হবে। ভালো লাগবে আমার।’
‘হ্যাঁ, এলে তোমার সাথে দেখা করতে হবে। দুজনে মিলে অনেক জায়গা ঘুরে ঘুরে দেখব আমরা। ট্যুরটা এনজয় করব। তুমি স্পেশাল আর হিস্টোরিক্যাল সাইটগুলো ঘুরিয়ে দেখাবে। আমাদের মধ্যে ফিজিক্যাল রিলেশনও হতে পারে। ট্যুরটা খুব জমবে মনে হচ্ছে।’
সুজনের মনে হল ভুল শুনছে সে। ‘কি, কি বললে তু ত্তুমি?’ কথা আটকে যাচ্ছে মুখে।
‘মানে তুমি সম্মত থাকলে ফিজিক্যাল রিলেশন হতে পারে আমাদের মধ্যে। জাস্ট ফ্রেন্ডলি।’ উত্তর দিলো রবার্ট। সাথে সাথে মেসেজে একটা ছবি পাঠালো। দেখেই শরীর হাত পা জমে গেল সুজনের। ছবিতে সঙ্গমরত দু’জন মানুষ দেখা যাচ্ছে। দু’জনেই পুরুষ!
‘মানে, মানে, রবার্ট? তুমি শেষ পর্যন্ত আমাকে...’ কথা শেষ করতে পারলোনা। মাথা হাত পা কিছুই কাজ করছেনা!
‘কি ব্যপার, তুমি শকড নাকি? স্যরি। তোমরা এশিয়ানেরা আসলেই গোঁড়া। গেলাম, বায়।’ কল কেটে দিলো রবার্ট।
জঘন্য ছবিটার দিকে বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সুজন। হঠাৎ সংবিত ফিরে পেয়ে ওয়াক ওয়াক করতে করতে বাথরুমে বেসিনের দিকে ছুটে গেল সুজন। কিন্তু বমি হচ্ছেনা। গা ঘিন ঘিন করছে। কাপড় চোপড় সহই সোজা গিয়ে ঝর্ণার নীচে দাঁড়িয়ে পুরোটা ছেড়ে দিলো। গায়ের কাপড়গুলোও অসহ্য লাগছে, সব খুলে ফেললো। নগ্ন দেহে অঝোর ধারায় পড়ছে শীতল পানি, তবু গা ঘিনঘিন ভাব দূর হচ্ছে না। মনে হচ্ছে গায়ের উপর কাদার মোটা পরত পড়েছে। তার উপর কিলবিল করছে লাখে লাখে রোমশ পোকা। এগুলো ধুয়ে সরানো যায়না। ইশ, এখন যদি মহাসাগরে ঝাঁপ দেয়া যেত! ডুব দিয়ে চলে যাওয়া যেত অতল মারিওন ট্রেঞ্চে! খুব ইচ্ছা করছে।
ভয়ংকর সেই ছবিটা স্ক্রীণে তখনো জ্বলজ্বল করছে!
•
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই মে, ২০১৪ দুপুর ১২:৪৩