ঘটনা প্রাগৈতিহাসিক যুগের।নিখিল চাটুয্যে তখন সবে মাত্র পঞ্চম শ্রেণীর বৈতরণী পার হইয়া ষষ্ঠ স্রেনীতে পদার্পণ করিয়াছে।এই পদার্পণ উহাকে বালক হইতে কিশোরে রূপ প্রদান করিলেও নিজে তাহা তিরস্কার পূর্বক সে যে কত বড় হইয়া উঠিয়াছে ইহাই তাহার মনে বার বার উকি দিয়া যাইতেছে।তাই জ্যাঠামশায়ের সেভিং রেজর দিয়া নিজের প্রায় মলিন গোঁফের রেখাকে বার বার করিয়া চাছিয়া,বাবার সিগারেটের প্যকেট হইতে সিগারেট চুরি করিয়া সোৎসাহে টানিয়া নিজে যে বড় হইয়াছে ইহা উহার থেকে বছর চারেকের পারাত বড় বন্ধুকুলের নিকট প্রমান করিয়া ছারিয়াছে।লাভের মধ্যে এই হইয়াছে যে বাবা কিরুপে যেন টের পাইয়াছেন যে নিখিল উহার সিগারেটের সৎকার করিতেছেন এবং উহার ফল সরূপ ব্যদম প্রহারপূর্বক তিন বেলা আহারাদি বন্ধ করিয়া বাড়ি হইতে বাহির করিয়া দিয়াছেন।এইবেলা আসিয়া নিখিলের বন্ধু, জ্যাঠাত ভাই অপূর্ব চাটুয্যের কিছু বর্ণনা দেই।অপূর্ব ষষ্ঠ শ্রেণী হইতে দুই বারের চেষ্টায় সপ্তম শ্রেণীতে উঠিবার গৌরব অর্জন করিয়াছে।ইতোপূর্বে ইনি পাড়ার বড় ভাইদের কাছ থেকে বড় হইবার সার্টিফিকেট হাতে পাইবার আশায় পাশের পাড়ার কমলা দিদিকে প্রেম পত্র দেওয়ায় কমলা দিদির কাছে জুতার বারি সমেত পাড়ার লোকজনের কাছ থেকে লুল সার্টিফিকেট যোগার করিয়া ফেলিয়াছে।শুধু তাই নয় বাবার পকেট কাটিয়া পাশের দোকান হইতে রাজা বেলুন কিনিয়া ফুলাইতে ফুলাইতে আসিবার সময় বাবার হাতে ধরা পড়িয়া ব্যদম প্রহার পূর্বক বারি হইতে তিরস্কৃত হইয়াছে।দুই বন্ধুই এখন ঘরছাড়া।উহাদের বাবারা উহাদের মাকে এই বলিয়া শাসাইয়াছেন যে এই দুই হতচ্ছাড়াকে যদি উহারা বাড়ির ত্রী সীমানায় দেখেন তাহলে দা দিয়া উহাদের কল্লা ফেলিয়া দিবেন।এই কারনেই এই দুই হতচ্ছাড়া বাড়ির ঠিক বিপরীতমুখে উদ্দেশ্যহীন যাত্রা করিয়াছে।হঠাৎ পথে উহাদের থেকে বছর চারেকের বড় ভবেন দা কে দেখিয়া দুইজনেই বেশ পুলকিত হইয়া উঠিল।ভবেন উহাদের জিজ্ঞাসা করিল কি হে সব ঠিক তো?
অপূর্ব প্রায় কাঁদ কাঁদ স্বরে কহিল দাদা বাড়িতে আমাদের নামে বনধ জারি করা হইয়াছে।বাড়িতে গেলেই কপাকুপি হইবে।
ভবেন কহিল বলিস কি?তোরা তো বড় হইবার একেবারে দ্বারপ্রান্তে পৌঁছিয়া গেছিস হে।ভবেনের এই এক দোষ।ছোট বড় সবার সহিত কথা বলিবার সময়ই সে ‘হে’ শব্দটি ব্যবহার করিয়া থাকে।এই হে শব্দটি তাহার একবার মরণের কারণ হইয়া দাঁড়াইয়াছিল।ঘটনাটা এরকম ভবেন ম্যাট্রিক পরীক্ষায় ফেল করিবার পর উহার বাবা জিজ্ঞাসা করিলেন তুই ফেল মারিয়াছিস?ভবেন কহিল জী হে।কয়টাতে মারিয়াছিস।আজ্ঞে তিনটিতে হে।কারণ জানতে পারি তোর পিছনে একজন জাইগির মাস্টার সমেত মোট তিনটা টিউশন মাষ্টার নিয়গের পড়েও রেজাল্টের এহেন অবস্থা কেন?ভবেন বেশ বুক ফুলাইয়া কহিল বাবা আপনি নিশ্চয়ই জানেন পিলার ইস দা ফেইলিউর অব সাকসেস হে।এঁর বাংলা মানে কি?ভবেন মুখ চুলকাতে চুলকাতে বলিল আজ্ঞে জানি নে হে।হঠাৎ ভবেন তাঁর বাম গালে কি একটা গরম তাপ অনুভব করিল।কিছুক্ষণ পড়েই ভবেন মাথা ঘুরিয়া চিৎপটাং।জ্ঞান ফিরিবার পরে ভবেনের কোন সমস্যাই রইলো না শুধু বাম কানে একটু কম শোনা ছাড়া।
সে যাক গে আসল কথায় আসি ভবেন ওই দুই হতচ্ছাড়া কে কহিল তাহলে আজকে তোদের শেষ পরীক্ষা হইবে বড় হইবার।ইহাতে যদি তোরা পাস করিতে পারিস তাহলেই অত্র লুল সমাজে তোদের কে বড় বলিয়া মানিয়া লওয়া হইবে হে।
এই কথা শুনিয়া দুই ভাইয়ের চোখ চক চক করিয়া উঠিল।ভবেন কহিল আজ আমাবশ্যার রাত এই রাতে ১২ টার সময় উত্তর পাড়ার শ্মশান থেকে একখানা মড়া মানুষের হার নিয়ে আসতে পাড়লেই বোঝা যাবে তোরা বড় হইয়াছিস।রাত্রে সাড়ে এগারটায় পাড়ার যে কালী মন্দির টা আছে ঐখানে আমাদের সহিত সাক্ষাত করিবি।ওইখান হইতেই হইবে তোদের যাত্রা শুরু।সাড়ে এগারোটায় ভবেন পাড়ার দুজন ছেলেকে লইয়া মন্দিরে উপস্থিত হইয়া দেখিল দুই খগেন আরামে ঘুমাইতেছে।উহাদের ডাকিয়া ভবেনের সঙ্গে থাকা চিরাগুড় উহাদের খাইতে দেয়া হইলো।এদিকে ওই দুই হতচ্ছাড়া কে খুজিতে যে লোক বাহির হইয়াছে ইহা ভবেন কোনোমতেই প্রকাশ করিল না।খাওয়া পর্ব শেষ করিয়া ভবেন কহিল কি হে পারিবি তো?
নিখিল খানিকটা দমিত হইলেও অপূর্ব কহিল তুমি দেখে নিও দাদা ঠিক পারিব।তবে আর দেরি কেন যা আমরা এইখানে আছি তোরা হার লইয়া এইখানে আসিবি।
দুই হতচ্ছাড়া বড় হইবার আশায় উত্তর পাড়ার স্মশান ঘাটে চলিল।সামনে অপূর্ব, ঠিক এক কদম পিছনেই নিখিল।নিখিল কহিল দাদা এ যাত্রা মনে হয় আর রক্ষে হল না রে।এই বারই বুঝি যমরাজের হাতে পরিতে যাচ্ছি।অপূর্ব বিরক্ত হইয়া কহিল তুই চুপ করিবি।এই চলে এলাম বলে।
হাটিতে হাটিতে ওঁরা শ্মশান ঘাটে পৌঁছিয়া গেলো।অপূর্বর মনে এতক্ষণ একটা সাহস থাকিলেও তা আর বুঝি টিকিল না কিন্তু তা যেন কোনভাবেই প্রকাশ হইয়া না পড়ে ছোট ভাইয়ের সামনে তাই বুঝি বারে বারে বলিতে লাগিল ভঁয় পাস নে নিখিল আমি আছি তো ভঁয়ের কিছু নেই।শ্মশানের মাঝে নামিতেই দু জনের কেমন যেন গা কাটা দিয়া উঠিতে লাগিল।খুব আসতে পা ফেলিয়া অপূর্ব একটু সামনে আগাইয়া গেলো।নিখিল আর আগাইবে কি আগাইবে না করিয়া ঐখানেই ঠাই দারাইয়া রহিল।হঠাৎ করিয়ায় নিখিল আবিষ্কার করিল পাশের ঝোপ হইতে কি একটা ফিসফিসানির আওয়াজ আসিতেছে।নিখিল ভাবিল এইবারই বুঝি তাহার ইহলীলা সাঙ্গ হইবে।এই বুঝি যমরাজ তাহাকে ধরিয়া আচ্ছা করিয়া ঝাঁকাইবে।কিন্তু অনেকক্ষণ কিছু না হইতে দেখিয়া নিখিল যেন একটু সাহস ফিরিয়া পাইল।সাহস করিয়া ঝোপের মাঝে উকি দিয়া দেখিল কিন্তু অন্ধকার রাতে তেমন কিছুই ঠিক নজর করিতে পারিল না।কিন্তু ফিস ফিসানি আওয়াজে নিখিল বুঝিয়া নিল ওখানে একজন পুরুষ আর একজন নারী।তবে কি দেব দেবী এইখানে নামিয়া আসিয়াছেন।গত পরশু ও পাড়ার সুবীর কাকা যে মরিয়া গেলেন বুঝি উনার স্বর্গ নরক নির্ধারণ করিতেই এই দেব দেবীর শ্মশানে আগমন।ভীত নিখিল তবুও কাকার স্বর্গ না নরক ঠিকানা জানিবার জন্যে এক পা দু পা করিয়া আগাইতে থাকে।ফিসফিসানি এখন বেশ স্পষ্ট।দেবার কণ্ঠটি কেমন জানি ও পাড়ার শিব কাকার বলিয়া মনে হয় তবে দেবীর কণ্ঠটি কাহারও সাথে মিল নাই।আরও একটু আগাইতেই নিখিল ছায়ামূর্তি দুইটা দেখিতে পাইল।একটি আরেক টির উপর পড়িয়া আছে।উহাদের গায়ে যে কাপড় নাই উহা নিখিল এই ঘোর অন্ধকারেও বুঝিতে পাইল।এইবার নিখিল নারীটিকে চিনিল এ যে আর কেউ নয় ও পাড়ার কমলা দিদি।সে এক দৌড়ে অপূর্বকে ডাকিয়া আনিতে গেলো এবং বলিয়া রাখি যে,সে উত্তেজনায় ভুলিয়ায় গেলো যে সে শ্মশানে উপস্থিত।একটু দূরে একটি ছায়া মূর্তিকে ঠাই দাড়িয়ে থাকতে দেখিয়া নিখিল ফিস ফিস করিয়া বলিল অপু দা।অপু কাঁদ কাঁদ স্বরে কহিল ওরে নিখিল আমাকে বাচা ওরে কারা যেন আমাকে জোর করিয়া ধরিয়া রাখিয়াছে।নিখিলেরও হঠাৎ মনে পরিল উহারা তো শ্মশানে আছে।তাহলে কি বিগত যে সকল ঘটনা সে চাক্ষুষ করিয়াছে উহা ভ্রম।রাত্রিরে ঘুমানোর আগে কমলা দিদি কে নিয়ে সে চিন্তা করিলেও এই শ্মশানে আসিয়াও যে চিন্তাতে কমলা দিদি আসিতে পারে তাহা জানিয়া নিখিল নিজেই কিছুটা দমিয়াঁ গেলো।ভাবনার খরাকে হঠাৎ বাধা পরিল অপূর্বর হাকে।অপূর্ব কে বাচাইতে নিখিল একপা একপা করিয়া নিচে নামিতে লাগিল কাছে আসিয়া দেখিল একটি কাঁটা গাছের সঙ্গে অপূর্বর জামা বাধিয়া গিয়াছে।নিখিল তা বলিতেই অপূর্ব কহিল কস কি?বলিয়াই দুইজন শব্দ করিয়া হাসিয়া উঠিল।তাহাদের হাসির শব্দেই কিনা কে জানে শ্মশান জাগিয়া উঠিল।ওপর পাশ থেকে কাহারও চিৎকার শোনা গেলো ভুত ভুত।এই শুনিয়া অপূর্বও ভুত ভুত বলিয়া নিখিলের হাত ধরিয়া হেচকা টান দিয়া প্রানপণে দৌর শুরু করিল।তাদের মনে হইতে লাগিল সামনের এই মাঠ দিয়া তাঁরা গত দুই বছর ধরিয়া দৌড়াইতেছে কিন্তু মাঠ আর ফুরাইতে চাহিতেছে না।এঁর মাঝে অপূর্ব নিখিলের হাত ছারিয়ে দিয়া কহিল ওরে নিখিল আমি শেষ, বলিয়ায় ধরাম করিয়া মাটিতে পড়িয়া গেলো।নিখিল কি করিবে ঠিক করিতে না পারিয়া এক দৌড়ে বারি গিয়া বলিল মা অপু দা মাঠে পড়িয়া আছে।বলিয়ায় অজ্ঞান হইয়া পরিল।এঁর পড়ে নিখিলের আর কিছু মনে নাই।সকালে উঠিয়া দেখিল অপু দা পাশে বসিয়া তাকে পাখার বাতাস করিতেছে। অপু দা কহিল কেমন লাগছে রে এখন?নিখিল কহিল ভালো।কিন্তু অপু দা তোমার মুখ এমন শুকনো লাগছে কেন?অপু কহিল আর বলিস না ও পারায় গিয়েছিলাম শালিশ দেখিতে।নিখিল কহিল কিসের শালিশ?অপু কহিল কমলা আর শিব কাকা কে কাল রাত্রিরে একসাথে পাওয়া গিয়াছে।আমাদের খুজিতে যারা বেরিয়েছিল ওরাই নাকি ওঁদের ধরিয়াছে।নিখিল বলিল তা তোমার মন খারাপের কি কারণ?অপু কেদে দিয়া কহিল ওরে ওঁরা যে কমলার সাথে শিবের বিবাহ সাব্যস্ত করিয়াছে।বলিয়ায় নিখিল কে জড়াইয়া ধরিল।নিখিল স্মিত হাস্যে নিজেকেই বলিল এই পোড়া চোখে তাহলে যা ঘটে সব দেখি ভ্রম নয় তা মাঝে মাঝে সত্যও বটে।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জুলাই, ২০১২ রাত ১০:৫৯