লম্বাগলা জিরাফ
পাশ দিয়ে ছফুট লম্বা কেউ হেঁটে গেলে আমরা গলা লম্বা করে তাকায় বাব্বাহ কত লম্বা ! আজ যার কথা বলব সে প্রায় চার মানুষের সমান। হাঁ ঠিকই ধরেছেন । কথা বলছি পৃথিবীর সবচাইতে লম্বা প্রাণী জিরাফকে(G. Camelopardalis) নিয়ে । দৈর্ঘ্য একটি জিরাফ প্রায় ১৮ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়। এছাড়া জিরাফের লম্বা উঁচু বলে উচ্চতম প্রাণীদের কাতারেও জিরাফের অবস্থান প্রথম সারিতে। শুধু কি পাতা খেতেই এই লম্বা গলা ? নাকি আরও অবাক হবার কিছু আছে অরও। সে গল্পও শোনাব আজ।
জিরাফের গলা লম্বা!
প্রানী জগতের মধ্যে অসাধারণ সুন্দর জিরাফ। প্রানীটি দেখতে ভীষণ আদুরে হলেও অন্য প্রনীর ছেয়েও আকারে অনেক বড়, বিশাল উচু তার দেহ, প্রনীটির ৪টি পা শক্তিশালী এবং তেমনই শক্তিশালী তাঁদের গলা। জিরাফকে দেখায় অনেক সুন্দর হওয়ার কারণ হলো শরীরের চাইতে অনেক উচু গলা। কখনো ভেবেছেন কি, জিরাফের গলা এতটা লম্বা কেন? লামার্কের যুক্তি হল, জিরাফের গলা লম্বা হয়েছে উঁচু গাছের পাতা খুঁজতে গিয়ে। ডারউইনবাদের যুক্তি হল, জেনেটিক মিউটেশনের ফলে যে জিরাফগুলোর গলা লম্বা হয়ে ছিল সেগুলো প্রতিযোগিতায় টিকে যায়, কারণ উঁচু গাছগুলোর পাতা খেতে লম্বা গলা বিশিষ্ট জিরাফগুলোর সুবিধা হচ্ছিল। এভাবে ক্রমান্বয়ে 'ডারউইনিয়ান সিলেকশন প্রেসার' এর মধ্য দিয়ে জিরাফের গলা লম্বা হয়। তবে জিরাফ এর গলা কেন লম্বা হল তার বিবর্তনীয় সমাধান এখনো হাইপোথিসিস পর্যায়ে রয়েছে। তবে, বিবর্তনবাদীদের কাছে এই হাইপোথিসিসগুলোই বড় প্রমাণ।
[মাথাহীন জিরাফ ! ইনসেট: চিত্রগ্রাহক অর্নো পিটারসেন .ছবিটি তোলা হয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকার একটি সাফারি পার্ক থেকে]
মাথাহীন জিরাফ
প্রথম দেখায় মনে হবে জিরাফটির মাথা নেই। ভালো করে লক্ষ করে কেউ কেউ হয়তো বলতে পারেন ফটোশপের কারসাজির মাধ্যমে গলাসহ মাথা কেটে বাদ দেওয়া হয়েছে।
আসলে এসবের কিছুই ঘটেনি। ছবিটিতে ফটোশপের কোনো কারসাজি নেই। আবার মাথাবিহীন দিব্যি জীবিত জিরাফও নয় এটি।মাথাহীন জিরাফ রহস্যের প্রকৃত ঘটনা হলো ফটো তোলার অ্যাঙ্গেল। ফটোগ্রাফার এমন অ্যাঙ্গেল থেকে ছবিটি তুলেছেন যে জিরাফের মাথাটি তার শরীরের অন্য পাশে ঢাকা পড়েছে।
জিরাফের গলা কিন্তু সুধু পাতা পারতেই নয় , শুত্রুর বিরুদ্ধে বা অন্য জিরাফের সাথে লড়াইতে এটিই কিন্তু ওদের প্রধান অস্ত্র।
বিশাল হৃদয়
লম্বা গলায় রক্ত সঞ্চালনের জন্য জিরাফের হার্ট অনেক বড় আর শক্তিশালী। জিরাফের গলা লম্বা হওয়ার সাথে সাথে কিভাবে তার মাথায় রক্ত পৌছানোর জন্য ক্যারোটিড আর্টারিও লম্বা হল। জিরাফের গলা যখন লম্বা হল তখন এর মাথা থেকে রক্ত হার্টে নিয়ে আসার রক্তনালী 'জুগুলার ভেইন' এর ভিতর ভাল্ভ তৈরী হল, যেন পানি পান করতে মাথা নিচু করার সময় বিপুল এই রক্তের প্রেসার মাথায় রক্তক্ষরণ না করতে পারে।
শিং আছে জিরাফের
জিরাফের মাথায় দুই থেকে চারটি শিং দেখা যায় । যদিও বিজ্ঞানীরা একে শিং হিসাবে মানতে নারাজ। আসলে তরুনাস্থি দিয়ে মাথার ত্বকের উপরের এই শিং আসলেই cornual process of skull নয় ।
আরও কিছু কথা
জিরাফের দৃষ্টিশক্তি খুব প্রখর। ফলে বহুদূরের শত্রুকেও জিরাফ সহজেই দেখতে পারে। এছাড়া জিরাফ খুব জোরে দৌড়াতে পারে। আক্রমণের শিকার হলে জিরাফকে ঘণ্টায় প্রায় ৫৬ কিলোমিটার বেগে দৌড়াতে দেখা গেছে। জন্মের সময় একটি জিরাফ প্রায় ৬ ফুট লম্বা হয় এবং এর ওজন থাকে গড়ে ৬৮ কেজি। অনেক জিরাফের মাথায় দুইটি বা চারটি ভোঁতা শিং থাকে। জিরাফের জিভও খুব লম্বা। নিজের কান পরিষ্কারের জন্য জিরাফ তার প্রায় ২১ ইঞ্চি লম্বা জিভ ব্যবহার করে।
দলবদ্ধভাবে চলাফেরা করে বলে সিংহকেও সাবধানে থাকতে হয়। কারণ জিরাফের লাথির আঘাতে সিংহ মারাত্মক আহত হতে পারে। এছাড়া আক্রমণের ভয়ে জিরাফ কখনো বসে ঘুমায় না বা বিশ্রাম নেয় না। কারণ জিরাফের বসতে যেমন সময় লাগে প্রচুর, তেমনি বসা থেকে দাঁড়াতেও অনেক সময় নেয়। এছাড়া প্রকৃতিগতভাবেই জিরাফ লম্বা হওয়ায় বসতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না। তবে দলগতভাবে থাকা অবস্থায় কিছু কিছু জিরাফ মাঝে মাঝে বসে বিশ্রাম নেয়। পানি খাওয়া, ঘুমানো কিংবা দিনের বেলা বিশ্রামের সময় অন্তত একটি জিরাফ আশেপাশে নজর রাখে শত্রুর উপস্থিতি জানানোর জন্য। খুব নিচু আওয়াজে এরা পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলে। এদের গলার আওয়াজ ২০ হার্জেরও নিচে। ফলে জিরাফের আওয়াজ মানুষ শুনতে পায় না। জিরাফ সাধারণত নিজেদের মধ্যে লড়াই করে না। তবে খেলাধুলা করার সময় কিংবা খুব বেশি রাগান্বিত হলে পুরুষ জিরাফরা মাঝেমধ্যে এক অন্যের সাথে লড়াই করে।
দীর্ঘ আকাশিয়া গাছের পাতাই এদের অন্যতম খাদ্য। অন্য প্রাণীরা অবশ্য এই লম্বা গাছের পাতা খেতেও পারে না। জিরাফের আরেকটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এরা উটের মতো পানি না খেয়ে দীর্ঘদিন কাটিয়ে দিতে পারে। স্বাভাবিকভাবে একটানা সাতদিন পানি না খেলেও এদের কোনো সমস্যা হয় না। গাছের পাতায় যে পানি থাকে, তা দিয়েই তাদের চাহিদা মিটে যায়।
নাচতে জানে জিরাফ
নিজের দীর্ঘ ঘাড় ব্যবহার করে নাচ প্রদর্শন করে জিরাফ। জিরাফের এই নাচকে ইংরেজিতে বলা হয় নেকিং (necking)। নেক মানে ঘাড়। কিন্তু জিরাফের বেলায় আমরা বলতে পারি ঘাড়তেড়ামি! মানুষের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয় হলেও আসলে দুই পুরুষ জিরাফের আধিপত্য ছড়ানোর লড়াই এটি। যাতে ঘাড়ই তাদের প্রধান ও একমাত্র অস্ত্র। লড়াইয়ে বিজয়ী পুরুষ জিরাফই স্ত্রী জিরাফের সংস্পর্শে আসতে পারে।
এত সুন্দর প্রাণী আজ বিলুপ্তির পথে। IUCN এর Red List এ নাম উঠে গেছে তার। আসুন আমরা পরিবেশের প্রতি একটু সচেতন হই। আর এই বর্ষায় অন্তত একটি করে গাছ লাগায়।
তথ্যসূত্রঃ
১।World Animal Science: Zoo Animal, Pub: Elsevier, Amsterdam-Lausanne- New York- Oxford-Shannon- Tokyo
২।https://en.wikipedia.org/wiki/Giraffe
৩।http://animals.sandiegozoo.org/animals/giraffe
৪।http://www.univnotes.com/
জিরো টু ইনফিনিটি তে প্রকাশিত ।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে আগস্ট, ২০১৬ সকাল ৯:৩৪