somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নজরুলের সেই লেটো গান

১৯ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ১:১৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

"লৌহ কারার দুয়ার ভাঙো, দুয়ার ভাঙো বন্দী আজি মহান রাজা।

কে রাজাকে বন্দী করে, কোন বিদেশিনী, দেয় সে সাজা;

ভাঙ ঐ কারার দুয়ার জোরসে টান,

অত্যাচারীর মাথার উপর খড়গ হান,

পালারে অত্যাচারী জেগেছে আজ সকল প্রজা ॥

লাথি মার লাথি মার কারার দ্বারে,

ঝনঝনিয়ে ভাঙুক কারা ভয় কারে রে

মায়াবিনী বিদেশিনী দ্বীপবাসিনীর দিব সাজা॥"


লেটো গান পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানে প্রচলিত এক প্রকার লোকসঙ্গীত। এটি যাত্রাগানের প্রকারভেদ। যাত্রাগানের মতোই পালার আকারে রচিত এ গান নৃত্য ও অভিনয়সহ পরিবেশন করা হয়; সঙ্গে থাকে বাদকদল।

লেটো গান শুরু হয় বন্দনা দিয়ে। সখি, সঙদার, পাঠক বিভিন্ন নামে নট-নটীরা গান ও নাচ পরিবেশন করে। কিশোর বালকরা মেয়েদের পোশাক পরে নটী সাজে। এর বিষয়বস্ত্ত সামাজিক রঙ্গরস ও আটপৌরে গ্রামীণ জীবন; পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক বিষয় নিয়েও পালা রচিত হয়। কাজী নজরুল ইসলাম শৈশবকালে লেটোদলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাঁর রচিত রাজপুত্রের সঙ, চাষার সঙ, আকবর বাদশা প্রভৃতি লেটো গানের সন্ধান পাওয়া গেছে।

লেটো গানে অনেক সময় দুটি দলের মধ্যে প্রতিযোগিতাও হয়; দলের প্রধানকে বলা হয় ‘গোদা কবি’। সাধারণত শীতের ফসল ওঠার পরে কৃষকের অবসর সময়ে লেটো গানের আসর বসে। লোকমনোরঞ্জনই এর প্রধান উদ্দেশ্য। প্রধানত মুসলমান সমাজে লেটো গানের সমাদর বেশি; তবে সব ধরনের শ্রোতাই এ গান উপভোগ করে।
লেটো গানের পরিবেশনায় ছিল- ‘ছোট ছোট’ প্রেমগীত, ডুয়েট, ইলামী গান, রাধা-কৃষ্ণ বিষয়ক গান, চাপান- উতোর সং এবং বিভিন্ন ধরনের পালা।
দুখুমিয়ার লেটো গান’ শীর্ষক গ্রন্থটি নজরুলকে নিয়ে আলোচনার নতুন দ্বার খুলে দিয়েছে। নজরুলের অনেক রচনাও সূত্রও পাওয়া গেছে এতে। সে সময় লেখা হয়েছিল লেটো-সাহিত্যের জন্য এবং পরবর্তীতে সেই রচনাসমূহের সাথে আধুনিক সাহিত্যের জন্য উক্ত রচনাসমূহের বিস্তৃতায়ন খুলে দিয়েছে সাহিত্যের জন্য নতুন তোরণদ্বার।
নিমশা গ্রামে লেটো গানের দলের পরিচালক, গোদা কবি ও ওস্তাদ ছিলেন কাজী বজলে করীম। তার সহযোগিতা-প্রশিক্ষণ পেয়ে দুখু মিয়া নাচ-গান-অভিনয়ে এবং বাদ্যযন্ত্রেও দক্ষ হয়ে ওঠেন। জানা যায়, বজলে করীম গানে সুরারোপ, সং ও পালা পরিচালনা এবং অভিনয় পদ্ধতি দেখিয়ে দিতেন। বজলে করীম হয়ে ওঠেন দুখু মিয়ার লেটো গানের গুরু।

লেটো গানে কিশোররা মেয়ে সেজে নাচ করে। তাদের বলা হয় বাই, ছোকরা ও রাঢ়। রাজকন্যা বা রাণী সাজে যারা তাদের বলা হয় রাণী। পাঠক বলা হয় যারা রাজা, মন্ত্রী, রাজপুত্র ও সেনাপতি সাজে। আর যারা নাচ, গান, অভিনয় ও সংলাপ ইত্যাদির দ্বারা দর্শক-শ্রোতাদের হাসায় তাদের বলা হয় সংদার বা সঁংগাল।
দুখু মিয়া ছোকরা সেজে গানে অংশ নিতেন কিনা এমন কোনো তথ্য পাওয়া যায়না। তবে সং সেজে যে নাচ-গান অভিনয় করে মানুষ হাসাতেন তার তথ্য রয়েছে।
কবি স্বভাব তার কৈশোরেই উন্মোচিত হতে দেখা যায় লেটো গানে। বেঙাচি হিসেবে দলে আবির্ভাব ঘটলেও দুখু যখন পাল্লাপাল্লি লেটোর গানের আসরে বিপক্ষের গোদা কবিকে হারিয়ে দিতেন, তা দেখে তাঁর চাচা লেটো গুরু বজলে করীম বলতেন, দুখু ‘বেঙাচি নয় গোখরো’, কিছুদিনের মধ্যেই গুরুর উৎসাহে ও দলের প্রয়োজনে দুখু রচনা করেন বিভিন্ন পালা, রচনা করেন, ‘প্রেম গান, ইসলামী গান, ডুয়েট গান, রাধা-কৃষ্ণ বিষয়ক গান। হাসির গান ও অন্যান্য গান, হাস্যরসাত্মক সং।’ শুধু তাই নয়, “তাঁর অন্য আর একটি বৈশিষ্ট্য ছিল, তা হলো সং ও পালার সঠিক স্থানে। সঠিক রসের গানের সংযোজন। এসব গান তিনি নিজেই রচনা করতেন। যার জন্য সং ও পালাগুলো আকর্ষণীয় হয়ে উঠতো। লেটোর আসরে হাস্যরসাত্মক নাট্যশ্রিত গান এবং এক মুখো কমিকের প্রচলন তিনি করে গিয়েছিলেন।”
বয়সের ভারে বজলে করীম দল ছাড়ার আগে দুখু-কে লেটো দলের ওস্তাদ পদে নিযুক্ত করেন। ওস্তাদ হবার পর তাঁর লেটো দলে আসে নতুন করে গতি।
এ ব্যাপারে সমালোচক যথার্থই মন্তব্য করেছেন, ‘ওস্তাদের পদ গ্রহণ করে তাঁর পরিচালিত লেটো দলকে ঢেলে সাজালের তিনি। নানা ঢঙের লেটো গান, নানা রসের সং, হাস্যরসাত্মক- করুনরসাত্মক একমুখো কমিক এবং নানা স্বাদের পালা রচনা করে, পুরাতন-নতুন লেটো শিল্পীদের নিয়ে অনুশীলন শুরু করলেন তিনি।ঃ সুর যোজনা, অভিনয়, পরিচালনা ও বাজনার ব্যঞ্জনার মধ্য দিয়ে, তাঁর ঐকান্তিক চেষ্টায়, লেটো গান সু-সংবাদ, সু-সমৃদ্ধ হল ও পূর্ণতা লাভ করলো।” লেটো দলের নবাগত শিল্পী হিসেবে বেঙাচি’ হয়ে অংশ গ্রহণ ছিল দুখুর। ওস্তাদ হয়ে দল পরিচালনার পর তাকে ক্ষুদে ওস্তাদ’ উপাধি দেওয়া হয়। জানা যায়, ‘এ উপাধি তিনি পেয়েছিলেন, বীরভূম জেলার দুবরাজপুরে, গ্রাম্য মেলার এক লেটো গানের আসরে।’
তারপর তিনি লেটো গানের জন্যে উপাধি পান ‘ভ্রমর কবি বা ভোমর কবি’ হিসেবে। মুহম্মদ আয়ুব হোসেন এ ব্যাপারে জানিয়েছে লেটো দলে ওস্তাদ রূপে বরিত হয়ে, লেটো শিল্পীদের দ্বারা এই উপাধিতে ভূষিত হন তিনি। দুখু মিয়ার সমসাময়িক লেটো শিল্প শেখ আব্দুল ওয়াজেদ মাস্টার, শেখ আব্দুল লথিব, শেখ মুবাই সংদার ও এদের পরবর্তী আলী আহমদ দফাদার ইত্যাদি আমাকে এই নামকরণ ও তার দুইটি ব্যাখ্যার কথা শুনিয়েছেন। প্রথমত ভ্রমর ফুল হতে মধু আহরণ করে তা জমা করে মৌচাকে। আমরা সেই মিষ্টি মধু পান করি।
ভ্রমর কবির রচিত গান-সং পালাগুলো মধুর মতই মিষ্টি, সেগুলো জমা হয় লেটো গানের দলে, আর মানুষ গীত অভিনয়ের মধ্য দিয়ে তা আস্বাদন করে। দ্বিতীয়ত ভ্রমরের হুল খুব সূক্ষ্ম আর তার জ্বালা বৃশ্চিক ইত্যাদির মত নয়। লেটো গানের আসরে বিপক্ষ দলের প্রতি যে চাপান গান ও সং গীত-অভিনীত হত তা মিষ্টি। অর্থাৎ তার চাপান গান ও সং মিষ্টি মাখা হুল।’
দুখু তার অল্প বয়সের ‘ভ্রমর কবি’ উপাধিকে গ্রহণ করেছিলেন ভিতর থেকেই। গৌরববোধও করতেন তার উপাধি নিয়ে। আর সে কারণেই হয়তো তার একটি গানে ভ্রমর কবি ভানতা যুক্ত পঙক্তি পাওয়া যায়। যদিও নজরুল তার বিখ্যাত একটি গানের শেষে ভ্রমর’-এর স্থলে গাঁথিস’ শব্দটি ব্যবস্থার করেছেন। গানটির প্রথম কলি “চেয়োনা সুনয়না আর চেয়োনা এনয়ন পানে।” মুহম্মদ আয়ুব হোসেন তার গ্রন্থে তথ্যসহ দেখিয়েছেন দুখু মিয়া গানটি লেটোর গানে পরিবেশনের জন্যে লিখেছিলেন। গানটির প্রথম ও শেষে দুই পঙক্তি করে চারপঙক্তি উল্লেখ করা হলো:
চেয়োনা সুনয়না আর চেয়োনা, এনয়ন পানে।
জানিতে নাইকো বাকি সই ও আঁখি কি জাদু জানে ।।
মিছে তুই কথার কাঁটায় সুর বিঁধে হায় রে ভ্রমর কবি।
বিকিয়ে জায়রে মালা, আয় নিরালা আঁখির দোকানে।।
বর্তমানে গানটির ‘ভ্রমর’ শব্দের স্থলে ‘গাঁথিস’ ব্যবহৃত। গানটি যে লেটোর গানের জন্যেই রচিত এ ব্যাপারেও মুহম্মদ আয়ুব হোসেনের দেয়া তথ্য এরকম ‘এই গানটি আছে, কবির লেটো জীবনের বন্ধু, চুরুলিয়া নিকটবর্তী কোলজোড়ার শেখ ফকির মন্ডলের লেটো গানের খাতায়।’ দুখু-র গানগুলো তখন দুখু মিয়ার গান ও দুখুর গান হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিল। এখনও সে হিসেবেই পরিচিত। শিয়ারসোলের স্কুলে ভর্তি হয়ে রাণীগঞ্জ মুসলিম হোস্টেলে চলে গেলে লেটো গানের দল ছেড়ে দেন দুখু মিয়া। তবে শিয়ারসোল-রাণীগঞ্জের ছাত্র জীবনেও দুখু মিয়া অনেক লেটো গান, সং ও পালা রচনা করেছিলেন। লেটোর গানকে নতুন করে জনপ্রিয় করে তুলবার ক্ষেত্রে এবং কৃষিজীবী শ্রমজীবী মুসলমান সমাজের চিত্তবিনোদনের জন্যে দুখু মিয়ার অবদান বাংলা লোক সাহিত্যে অনন্য সংযোজন।

SourceBanglapediaOthers
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ১:২৪
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ট্রাম্প ভাইয়ের প্রেসিডেন্সিয়াল টিমের সদস্য এর মধ্যে এই তিন জন সদস্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

লিখেছেন অতনু কুমার সেন , ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৮:৪৮

প্রথম জন হলো: জেডি ভান্স, উনি মেবি ভাইস প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন। ভদ্রলোকের বউ আবার ইন্ডিয়ান হিন্দু। ওনার নাম উষা ভান্স। পেশায় তিনি একজন অ্যাডভোকেট।

দ্বিতীয় জন হলো বিবেক রামাস্বামী। এই ভদ্রলোক আরেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

দেশে ইসলামি আইন প্রতিষ্ঠা করা জরুরী?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:০২



বিশ্ব ইসলামের নিয়মে চলছে না।
এমনকি আমাদের দেশও ইসলামের নিয়মে চলছে না। দেশ চলিছে সংবিধান অনুযায়ী। ধর্মের নিয়ম কানুন মেনে চললে পুরো দেশ পিছিয়ে যাবে। ধর্ম যেই সময় (সামন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

আসল 'আয়না ঘর' থাকতে রেপ্লিকা 'আয়না ঘর ' তৈরির প্রয়োজন নেই।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১১:৩৮


স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের জুলুম থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য ৫ই আগস্ট সর্বস্তরের জনতা রাস্তায় নেমে এসে। শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যান। দীর্ঘ ১৫ বছরের শাসন আমলে অসংখ্য মানুষ কে... ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি হাজার কথা বলে

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ০৮ ই নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৩:৫৩

আগস্টের ৩ তারিখ আমি বাসা থেকে বের হয়ে প্রগতি স্মরণী গিয়ে আন্দোলনে শরিক হই। সন্ধ্যের নাগাদ পরিবারকে নিয়ে আমার শ্বশুর বাড়ি রেখে এসে পরদিনই দুপুরের মধ্যেই রওনা হয়ে যাই। আগস্টের... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। নিজের বানানো টেলিস্কোপ দিয়ে কালপুরুষ নীহারিকার ছবি

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৮ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:৩৯






ঢাকায় নিজের বাসার ছাদ থেকে কালপুরুষ নীহারিকার ছবি তুলেছেন বাংলাদেশি অ্যাস্ট্রোফটোগ্রাফার জুবায়ের কাওলিন। যে টেলিস্কোপ দিয়ে তিনি এই ছবি তুলেছেন, সেটিও স্থানীয় উপকরণ ব্যবহার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×