somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রিভিউঃ বিষাদ লিখি না, তোমাকে লিখি

১৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ দুপুর ২:০১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


বই রিভিউঃ “ বিষাদ লিখি না, তোমাকে লিখি ”
লিখেছেনঃ ঋদ্ধি সরকার

‘যে বালিকা মরে গেল তার প্রেমিকের হৃদয়ে
অমরত্বের কৌশল তার চেয়ে ভালো আর কে জানে?’
(কবিতাংশঃ সুভা একটি কবিতার নাম)

কবিতা মূলত সৃষ্টির শুরু থেকেই একই ভাষার আর অনুভবের। এত লক্ষাধিক কবিতা, তবু সব আলাদা। ভালোবাসি শব্দটাকে কে কত সুন্দর করে বলতে পারলো মূলত এখানেই প্রেমের কবিতার স্বার্থকতা। আমার বিশ্বাস কবি কাজী মেহেদী হাসান সেটা পারেন। এই দু’লাইন যেন ঠিক দুইটা লাইন নয়, আরও অনেক কিছু। কবির সাথে আমার পরিচয় খুব অল্পদিনের, কথাও যে বিস্তর হয়েছে তাও নয়। তারপরও নিজে থেকে বাধ্য হয়েছি এই বইটার রিভিউ লিখতে। তবে এই কবি আর তার কবিতার সাথে মানুষের ভালোবাসা সুদীর্ঘকাল থাকবে বলেই আমার ধারণা।

‘আচমকা দ্যাখা হলে—
তোমার যে হাত ছুঁয়েছিলাম সংখ্যাতত্ত্বের নিয়মের বাইরে
যে হাত মিছিলে যেত আমার হাতের সমান্তরাল
যে হাত ঘুমিয়ে গ্যাছে বহুবার আমাকে ভালোবেসে
সেই হাত—
সেই নাতিশীতোষ্ণ হাত ধরে থাকে যে অন্য লোক
তাকে কুশল জানাবো;
এক সিগারেট দূরত্বে দাঁড়িয়ে বলবো— 'লোকটা সুখী হোক'।’
(কবিতাংশঃ অদ্বিতীয়)

কবিতায় প্রেমের ব্যবহার বহুমাত্রিক। একরকম হয় নিজেকে শ্রেষ্ঠত্বের সর্বোচ্চ আসনে নিয়ে যাওয়া। অন্যদিকে নিজেকে পতনোন্মুখ ফিনিক্স পাখির মতো জ্বালিয়ে দেয়া। ‘অদ্বিতীয়’ কবিতায় কবি মূলত তাই করেছেন। পাঠককে নির্দিষ্ট স্রোতে ভাসিয়ে নিয়ে যান এবং আচমকা তাকে ফেলে দেন এমন একটা জায়গায় যেটা সে ধারণা করেনি। এই যে আচমকা ধাক্কা দিতে পারেন আর তা পাঠককে অদ্ভুত ভালোলাগার ঠিকানায় পৌছে দেয়ার ক্ষমতা রাখে, সেই কলমের দীর্ঘজীবীতা আমাদের ভালো কিছুই দেবে।

‘একসময় বেবাক কিছু চুপ মাইরা যায়
কান্দনের আওয়াজ;
কান্দনের মতো পাখির আওয়াজ;
পাখির মতো ছাইড়া যাওনের দুঃখের আওয়াজ;
রাইত-বিরাইতে এহনও উজান বাতাস আইসে, বাত্তি নেভে না।
কারা জানি কথা কয় দূরে-চুল ছুয়া যায় সরলার
বিড়বিড় করতে থাকে—
‘মরণ আর কতদূরে নিবার পারে, যহন পরানেই আছো আমার।’’
(কবিতাংশঃ অতঃপর সরলা)

ভাষা মূলত মাটিরই হয়। তবে আঞ্চলিকতায় থাকে অন্য রকমের ঘ্রাণ। আর সেটাকে যখন মানুষকে ছুঁয়ে দেবার উপজীব্য হিসেবে ব্যবহার করা হয় তখন সেই সাহসকে আমি প্রথমে অভিবাদন জানাবো তারপর মুগ্ধ হবো। কবির কাছে শুনেছি এই কবিতার প্রথম অংশটা বছর খানেক আগের হলেও দ্বিতীয় অংশটা এ বছর লিখেছেন। অথচ দুটি কবিতাতেই সারল্যতার কি অদ্ভুত সামঞ্জস্যতা। পড়তে গেলে কবিতার চরিত্র গ্রামের সরলা’কে অনুভব করা যায়। সেই সাথে নিখাদ প্রেম। গ্রাম্য চিন্তাধারা আর সবশেষে তার প্রভাব।

‘মাথার ভেতর বোমারু বিমান নিয়ে মানুষ ছুটছে
ঘরহারা মানুষ;
আতঙ্কিত মানুষ;
মানুষের ভয়ে মানুষ;
রক্তের ক্যামোফ্লেজ নিয়ে ছুটছে
বউ কথা কও আর ধানশালিকের দেশ।’
(কবিতাংশঃ ডিসেম্বর ব্লাড)

মূলত প্রেমের কবি হলেও দেশ নিয়ে তার চিন্তাগুলোও স্পর্শ করবার মতো। সেটা তার এই কবিতায় দেখা যায়। কি চমৎকার সব লাইন। মনে হবে কবি সবসময় এরকম কবিতাই লেখেন। এই কবিতার শেষ স্তবকে একটা লাইনে তিনি লিখেছেন ‘নয় মাইল লম্বা রক্তের ট্রেইল ধরে ঘুমিয়ে পড়েছি’। একটা স্বাভাবিক লাইনে কতটা বিষাদ থাকতে পারে সেটা এই লাইনে বোঝা যায়। ‘বিষাদ লিখি না, তোমাকে লিখি’ বইয়ের এক একটা কবিতা পড়ে মনে হবে বিষাদের আড়ালে এই তুমিটা একজন প্রেমিকা, কখনও মনে হবে সেটা মূলত মানুষ আবার মনে হবে এই তুমিটা ‘দেশ’। কবির এই সামর্থকেই আমি সাধুবাদ জানাই।

‘আমি তোমাকে আর একটিবারও ফিরতে বলবো না নীরু
বলবো না খোঁপায় চন্দ্রমল্লিকা গুঁজে দিলে তোমাকে আশ্চর্য সুন্দর লাগে
সঠিক স্থানে হৃদয়ের মতো কপালের টিপ সরে গেলে আমি দুঃখ পাই
মাথার কসম, বলবো না।’
(কবিতাংশঃ মানুষের গান)

কিংবা,

‘চলে যাওয়া—
সে তো, হৃদয়ে চিরস্থায়ী হবার কৌশলমাত্র!’
(কবিতাংশঃ তৃতীয় চোখ)


চাওয়া আর প্রস্থানের মাঝে শুধু ভালোবাসার গভীরতাই নয়, সেই সাথে যেন প্রগাঢ় দর্শনকে টেনে এনেছেন এই কবি। কবিতার বইয়ের পাঠক হয়তো কম, তবে এটাকে শুধু কবিতার বই বলবো না। আরও বেশি কিছু।

‘শেলেট ঘষে লিখে রাখি নামতাসমুহ
মক্তবের বারান্দায় আল্লাহর নিরানব্বই নাম
মানুষের ইশকুলে এ এক অব্যর্থ পাঠ
নিতাই স্যার বলতেন— মানুষ হলো মন্দির
তাকে এড়িয়ে যাওয়া অধর্ম
মৌলভী স্যার বলতেন— মানুষই কুরআন
তাকে ভুল উচ্চারণে পড়তে নেই।’
(কবিতাংশঃ মানুষ পাঠ)


মানুষ শব্দটা কতটা উর্ধে এই কবিতায় তা স্পষ্ট। যিনি মানুষের জন্য লিখেন। বলেন, মানুষের কাছেই রয়ে যেতে চান। স্বল্পভাষী এই কবির সেই সামর্থ্য যেন তাকে একদিন সময়ের গায়ে লিখে রাখে সেটুকু প্রার্থনা করা যেতেই পারে।

আরও দুইটি কবিতার কথা বলতে চাই। প্রথমত ‘চারু মিত্র’ কবিতাটি। এই কবিতার কোন অংশ দিচ্ছি না। একটা অংশ দিলে তা এই কবিতাকে তুলে ধরতে অক্ষম কিংবা অন্য অংশগুলোকে ছোট করা হবে। বাংলা ভাষারই একটি উল্লেখযোগ্য কবিতা হয়ে থাকবে ‘চারু মিত্র’ কবিতাটি এই কথা যদি আমার ক্ষুদ্র মস্তিষ্ক বলেই ফেলে তবে তাকে আমি দোষী করবো না।
অন্য কবিতাটি ‘আমার বাবার কোন গল্প নেই’। এটারও কোন অংশ দিচ্ছি না। একই কথা প্রযোজ্য। একজন কবির বাবার দুঃখবোধ শুধু নয় বরং সমাজবাস্তবতায় ‘কবি’ শব্দটা আজও কতটা অপাংক্তেয় হয়ে আছে তাই যেন লিখতে চেয়েছেন তিনি।


‘যদি জীবনকে ঋতুর সমষ্টি বলি
তবে তোমার সাথে কাটানো সময়টার নাম দেবো 'বসন্ত'।’
(কবিতাংশঃ পাণ্ডুলিপি)

এবং,

‘আমি কখনই ভ্রমন পিপাসু ছিলাম না
অথচ তোমার চোখে তাকালেই বলে ফেলি—
'এখানে এসেছি বহুবার'!’
( কবিতাংশঃ অতঃপর ফিরে আসা )

তার প্রতিটি শব্দ যেন কথা বলে। ভেতরে গিয়ে আরেকটা মানুষ হয়ে ওঠে। যে হাটে মানুষের মতো। তারও পাঁচটা আঙুল আছে। আছে বিবেকবোধ। কবির ভাষায়—

‘কবিতার শরীর খুলে দ্যাখো; সেও বিবেকশাসিত
মন ও মননে সেও মানুষ, রয়েছে মানবিক হৃদয় এক—
পাখির কোমল পালকে যে বায়বীয় ভালোবাসা
তার নাম কবিতা কি?
যে রোজ রাতে কথা কয়, খুলে দ্যায় হৃদপিন্ড
মানুষ হয়ে হাটে তোমার ভেতর...’
(কবিতাংশঃ শব্দচরিত)



বইয়ের নামঃ বিষাদ লিখি না, তোমাকে লিখি
লেখকঃ কাজী মেহেদী হাসান
প্রকাশনীঃ ঘাসফুল
স্টল নং: ১৩৭
মূল্যঃ ১০০ টাকা
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ দুপুর ২:০২
১০টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পার্বত্য চট্টগ্রাম- মিয়ানমার-মিজোরাম ও মনিপুর রাজ্য মিলে খ্রিস্টান রাষ্ট্র গঠনের চক্রান্ত চলছে?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:০১


মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রী লালদুহোমা সেপ্টেম্বর মাসে আমেরিকা ভ্রমণ করেছেন । সেখানে তিনি ইন্ডিয়ানা তে বক্তব্য প্রদান কালে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী chin-kuki-zo দের জন্য আলাদা রাষ্ট্র গঠনে আমেরিকার সাহায্য চেয়েছেন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাসান মাহমুদ গর্ত থেকে বের হয়েছে

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:১২


যুক্তরাষ্ট্রের একটি বাংলা টেলিভিশন চ্যানেল হাসান মাহমুদের সাক্ষাৎকার প্রচার করেছে। আমি ভাবতেও পারি নাই উনি এতো তারাতারি গর্ত থেকে বের হয়ে আসবে। এই লোকের কথা শুনলে আমার গায়ের লোম... ...বাকিটুকু পড়ুন

দারিদ্রতা দূরীকরণে যাকাতের তাৎপর্য কতটুকু?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:১৮



দরিদ্র দূরীকরণে যাকাতের কোনো ভূমিকা নেই।
যাকাত দিয়ে দারিদ্রতা দূর করা যায় না। যাকাত বহু বছর আগের সিস্টেম। এই সিস্টেম আজকের আধুনিক যুগে কাজ করবে না। বিশ্ব অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

শেখস্তান.....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:১৫

শেখস্তান.....

বহু বছর পর সম্প্রতি ঢাকা-পিরোজপু সড়ক পথে যাতায়াত করেছিলাম। গোপালগঞ্জ- টুংগীপাড়া এবং সংলগ্ন উপজেলা/ থানা- কোটালিপাড়া, কাশিয়ানী, মকসুদপুর অতিক্রম করার সময় সড়কের দুইপাশে শুধু শেখ পরিবারের নামে বিভিন্ন স্থাপনা দেখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের বিয়ের খাওয়া

লিখেছেন প্রামানিক, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:৪৮


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

১৯৬৮ সালের ঘটনা। বর আমার দূর সম্পর্কের ফুফাতো ভাই। নাম মোঃ মোফাত আলী। তার বিয়েটা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। বাবা ছিলেন সেই বিয়ের মাতব্বর।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×